দেশের সংকট-নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান
কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন
সংস্কার কমিশন, জুলাই সনদ, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচন নিয়ে জনগণের সংশয়, গোপন চুক্তি করে লালদিয়া চর টার্মিনাল এবং পানগাঁও টার্মিনাল বিদেশিদের ইজারা দেয়া, চট্টগ্রামের নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে দেয়ার চক্রান্ত, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের হত্যাকাণ্ডের বিচার, পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সাজা, পতিত আওয়ামী লীগের শাটডাউনের নামে নৈরাজ্য আতঙ্ক সৃষ্টি, স্বাধীনতা এবং উগ্র ডানপন্থি সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফলন, বাংলার কৃষ্টি-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির উপর আক্রমণ, বেকারত্ব বৃদ্ধি, ২৭৮টি গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ না হওয়া, সার-বীজসহ কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি এবং স্বল্পতা, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়ে দেশ মহাসংকটের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। দেশের মানুষের মনে ক্ষোভ হতাশা বাড়ছে। ২৪’র ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ক্রমশই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। বারবার এ দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে কিন্তু বিপরীতে কিছুই পায়নি।
৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশের সাধারণ মেহনতি শ্রমজীবী মানুষ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছিল। আজ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও সাধারণ মানুষের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে শোষণ বৈষম্য তো কমেইনি বরং আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা এ সময়কালে দেশ শাসন করেছে সবাই উন্নয়নের কথা বলেছে কিন্তু উন্নয়ন হয়েছে সমাজের শতকরা ১ ভাগ মানুষের। বাকি ৯৯ ভাগ মানুষের ভাগ্যের কোনো উন্নয়নই হয়নি। সাধারণ মানুষ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। লুটেরা শোষকরা তাদের শোষণ ব্যবস্থাকে বহাল রাখার স্বার্থে বারবার জনগণের ওপর স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার পর্যন্ত হরণ করেছে। তাদের সীমাহীন দুর্নীতি লুটপাট দুঃশাসন, দেশের সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের তাবেদারি করা ছাড়া আর কি করতে পেরেছে? তাদের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ বহু লড়াই সংগ্রাম করেছে। ৯০ এবং ২৪’র ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান সৃষ্টি করেও বিজয় ধরে রাখতে পারেনি। কেন বিজয় ধরে রাখতে পারেনি তা আজ সাধারণ মানুষের মনে বহু প্রশ্নে জন্ম দিয়েছে। কেনো অর্জিত বিজয়গুলো ধরে রাখা গেলো না, এর পেছনে অন্তর্নিহিত কারণগুলো আমাদের বিচার বিশ্লেষণ এবং এর সমাধানের বিষয়ে ভাবনা এবং কার্যকর করার সময় এসেছে। দেশের আপামর শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতাই ছিল এ দেশের প্রতিটি সংগ্রামের প্রধান শক্তি। কিন্তু সাধারণ মানুষের রক্ত ঘামে এসব বিজয় অর্জিত হলেও তাদের সৃষ্ট বিজয়ের ফল তাদের পাওয়ার অধিকার থাকলেও তাদেরকে বঞ্চিত করে লুটেরা ধনিক শ্রেণি সেই বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। বারবার সরকার বদল হয়েছে কিন্তু গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন যন্ত্রণা কমেনি তা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের দেড় বছরের সময়ে এসে দেখা যাচ্ছে এবারের বিজয়ও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। দেশ এখন যে গভীর ও ক্রমবর্ধমান সংকট, নৈরাজ্য অবক্ষয়ের মধ্যে রয়েছে এবং যে অধিকারহীনতা গণতন্ত্রহীনতার শাসন ব্যবস্থায় দেশ চলছে তার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারায় মৌলিক সংস্কার ছাড়া এই সংকটের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। আজ আরও স্পষ্ট হচ্ছে যে, দেশ ও দেশবাসীর জন্য সুখ-শান্তি-স্বস্তি ও প্রতিশ্রুতিময় নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে প্রগতিমুখীন বিকল্প ধারার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং তার পরিচালনায় গরিব শ্রমজীবী মধ্যবিত্ত মানুষের স্বার্থের বিকল্প ব্যবস্থায় দেশের যাত্রাপথ নিশ্চিত করা আজ জরুরি ও আবশ্যিক কর্তব্য হয়ে উঠেছে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর ধরে দেশে আমাদের পর্যায়ক্রমে চলেছে নৌকা-লাঙ্গল-পাল্লা-শীষ ইত্যাদি মার্কার সরকার অথবা মাঝে মাঝে চলেছে সাময়িক বা নাগরিক সমাজের সরকারের দুঃশাসন। এ সময়ের প্রতিটি সরকারের আমলে একদিক চলেছে অবাধ লুটপাট, শোষণ, বৈষম্য, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাফিয়াতন্ত্র ইত্যাদি। তেমনি এর পাশাপাশি অব্যাহত থেকেছে গণতন্ত্রহীনতা সামরিক, আধা সামরিক, এনজিও, আধিপত্য স্বৈরাচারী-ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা। শাসক হিসেবে এদের কুৎসিৎ ভূমিকা এবং আচরণে দেশের মানুষ চরমভাবে হতাশ, দিশেহারা এবং ক্ষুব্ধ। দেশ আজ ভয়াবহ রুগ্ণতা ও অবক্ষয়ের সাথে সাথে বিপজ্জনক সংকট এবং ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। যে ব্যবস্থায় এবং যে চরিত্রের সরকারসমূহের অধীনে এ যাবৎকাল দেশ পরিচালিত হয়েছে তার ব্যর্থতা চূড়ান্ত দেওলিয়াপনা ও অপরাধমূলক কার্যক্রম চলতি রাজনীতি সম্পর্কে মানুষের মনে অনীহা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। প্রচলিত চলতি হাওয়ার রাজনীতির রুগ্ণতা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন একটি প্রকৃত বিকল্প ধারার রাজনীতি-অর্থনীতি-সামাজিক ব্যবস্থার সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এ যাবৎকাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসক-শোষকগোষ্ঠী ও তাদের অনুসৃত শোষণ বৈষম্য ব্যবস্থা দেশে আর চলতে পারে না, চলতে দেয়া যাবে না।
রাজনীতিতে শাসক-শোষকশ্রেণির শক্তি সমাবেশের তৈরিকৃত রাজনৈতিক কাঠামোগত ব্যবস্থায় আজ এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তার সুযোগ নিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থি শক্তি দেশকে আরও পেছনে নিয়ে সংকটকে আরও গভীরতর করার অতি বিপজ্জনক চক্রান্তের খেলায় লিপ্ত রয়েছে। কোনোভাবেই এই ষড়যন্ত্র সফল হতে দেয়া যাবে না। তাই প্রতিক্রিয়াশীল-সাম্প্রদায়িক বিকল্প তো নয়, দেশ বাঁচাতে আজ একটি প্রগতিমুখীন গণতান্ত্রিক বিকল্প এবং সেই ধারায় একটি সক্ষম বিকল্প শক্তি সমাবেশ ও বিকল্প সরকার প্রয়োজন।
এখন প্রশ্ন হলো- সেই বিকল্প কোন ধারায় হবে প্রগতির ধারা নাকি মধ্যযুগীয় প্রতিক্রিয়ার ধারায়? এই পরিস্থিতিতে তাই বিকল্প গড়ে তোলার কাজকে বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি অবহেলা করলে তা হবে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক মধ্যযুগীয় শক্তিকে খালি মাঠে গোল দেয়ার মতো সুযোগ করে দেয়া। সময় যত বয়ে যাচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক উগ্র ডানপন্থি শক্তির অভ্যুদয়ের বিপদ ততই বাড়ছে। এমতাবস্থায় কালক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। যেটুকু শক্তির মধ্যে সমঝোতা করার সম্ভব সেটুকু নিয়েই কাজ শুরু করতে হবে।
বিগত দিনে জনগণের স্বার্থের বিপরীতে দেশ শাসন করেছে এবং এবং যারা নানা কায়দায় ও মাত্রায় সহযোগী ছিল তাদের বাদ দিয়েই অগ্রসর হতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের কোলঘেষা জাতীয়তাবাদী শক্তির বিচ্যুত আপসকামী অপরাপর শক্তির বাইরে সকল শক্তি যারা ৯৯ ভাগ মানুষের স্বার্থের পক্ষে তাদের ঐক্যবদ্ধ করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৫৪ বছরের ব্যর্থতা বিশ্বাসঘাতকতার অবসান ঘটানোর জন্যই বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দল ও শ্রেণি গণসংগঠন বিভিন্ন জাতিসত্ত্বা, পেশাজীবী সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক ফ্রন্ট গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। নেতৃত্বে থাকতে হবে বাম গণতান্ত্রিক শক্তি। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু সেটা মুখের কথা নয়, বাস্তবে কার্যকরি করার জন্য লড়াই-সংগ্রাম-শ্রেণি সংগ্রাম এবং জাতীয় আন্দোলনে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে অগ্রসর হতে হবে।
এই শক্তি গড়ে ওঠার বাস্তব সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তা কাজে লাগাতে হবে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিকে। নানা উদ্যোগও গ্রহণ করতে হবে। বাম সংকীর্ণতা এবং ডান বিচ্যুতিকে ত্যাগ করতে হবে। যারা শোষণ-বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চান সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ২৪’র ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে চান তাদের মধ্যে কোনো ধরনের সংশয় সন্দেহ থাকা ঠিক হবে না। যতটুকু ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করা যায় ততটুকু নিয়েই অগ্রসর হতে হবে। প্রথম পর্যায়েই সব বাস্তবায়ন হয়ে যাবে চিন্তা করা উচিত হবে না। বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করেই এই রাজনৈতিক শক্তির উন্মেষ ঘটাতে হবে। আন্দোলন ও নির্বাচন যাই হোক না কেনো সেখানে এই বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। এই উদ্যোগকে ব্যর্থ করার জন্য নানা ধরনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত হবে এটাই স্বাভাবিক কেননা লুটেরা ধনীক শ্রেণি সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদের তল্পীবাহকরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি তারা বসে থাকবে না। তাদের প্রতিরোধ করেই অগ্রসর হতে হবে।
দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা একটি বৃহত্তর বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান তা বাস্তবায়নের জন্য এদেশের বামপন্থি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
প্রথম পাতা
পীর-ফকির-বাউলদের ওপর হামলায় পুলিশকে সন্ত্রাসের পক্ষে ব্যবহার করছে সরকার
পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি
লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে চা-শ্রমিকদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে
বন্দর ইজারার সিদ্ধান্ত না পাল্টালে ৪ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে বিক্ষোভ
সংশোধনী
আরপিও’র অগণতান্ত্রিক সংশোধনী এবং নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল কর
শোষণ-বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান
‘রাষ্ট্রের চরিত্র বদল না হওয়ায় শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছে না’
অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করুন
‘মেহেরবানি’
Login to comment..








প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন