জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পথ খুঁজছে কমিশন
একতা প্রতিবেদক :
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নতুন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এগারটি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এসব কমিশনের মধ্যে ছয়টি কমিশন সংবিধান সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে প্রণীত হয়েছে- জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি, অধ্যাপক আলী রিয়াজকে সহ-সভাপতি করে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে সাত সদস্য বিশিষ্ট ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠিত হয়। সরকারি প্রজ্ঞাপনে কমিশনের কার্যপরিধি নির্ধারণ করে বলা হয়- ‘কমিশন আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের অর্থাৎ গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশসমূহ বিবেচনায় ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য করণের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের সঙ্গে আলোচনা করিবে এবং এই মর্মে পদক্ষেপ সুপারিশ করিবে।’
১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ অংশ নেয়। এরপর দীর্ঘ আলোচনায় ৮৪টি প্রস্তাব আলোচিত হয়। তার মধ্যে অধিকাংশ প্রস্তাবে সব দলের ঐকমত্য নেই, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ‘চূড়ান্ত দ্বিমত’ আছে। প্রস্তাবের আগে ভূমিকা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির কথা বলা হয়। ভূমিকা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে চূড়ান্ত মতভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু নোট অব ডিসেন্ট বা চূড়ান্ত দ্বিমতসহ ৮৪টি প্রস্তাবনাকে কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ নামে অভিহিত করছে।
১১ সেপ্টেম্বর থেকে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। পাশাপাশি কমিশন বিশেষজ্ঞদের সাথে বৈঠক করেছে। ৮ অক্টোবর পর্যন্ত মোট পাঁচদিন জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনা হয়। এই পাঁচদিন বাস্তবায়নের নানা পথ উত্থাপিত হয়।
এক. সংবিধানের ১০৬ ধারার মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে উচ্চ আদালতের পরামর্শ নেয়ার সুযোগ আছে কি?
দুই. সংবিধানের মৌলিক সংস্কার সংসদ করতে পারে কি?
তিন. বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের আগে বিদ্যমান সংবিধান স্থগিত করতে হবে কি?
চার. জনগণের অভিপ্রায় জানতে গণভোট করতে হলে তার আইনি ভিত্তি কী হবে?
পাঁচ. অধ্যাদেশ জারি করে গণভোট আয়োজনের কোনো সুযোগ আছে কি?
ছয়. সংবিধান সংস্কার সভা করার সুযোগ আছে কি?
এ প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনার সময় প্রথমে ১০৬ ধারা প্রয়োগের বিষয়টি নাকচ হয়ে যায়। পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদকে গাঠনিক ক্ষমতা বা কন্সটিটিউয়েন্ট পাওয়ার দিয়ে একই সাথে সংবিধানের মৌলিক সংস্কার করার সুযোগ দেয়া যায় কিনা তা আলোচিত হয়।
সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনসহ অন্যান্য প্রস্তাবগুলো সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা ছাড়া প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে নানা জটিলতা এমনকি আদালত কর্তৃক খারিজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আলোচিত হয়। নতুন সংসদ বা আইন সভার সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, যে সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়ে গঠিত হয়েছে সেই সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করার এখতিয়ার তার নাই।
আইনজ্ঞদের ভাষায়- ‘সংবিধান সংশোধন করার অধিকার সংবিধান ধ্বংস করার ক্ষমতা দেয় না।’
ফলে সমস্ত আলোচনা ঘনীভূত হয় গণভোটের মাধ্যমে ‘জনগণের অভিপ্রায়’ জেনে তা পরবর্তী সংসদে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়ার উপর।
কমিশনের আলোচনার শেষ দিন ৮ অক্টোবর বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “গণভোট অপ্রয়োজনীয়। এটা হবে মূলতঃ জনমত যাচাই। গণভোটের সিদ্ধান্ত বা ফলাফল নতুন সংসদের উপর চাপিয়ে দিতে পারবে না।”
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন বলেন, “সংসদ সার্বভৌম না হলেও সংসদের উপর কোনো বাধ্যবাধকতা তৈরি করা যায় না। ফলে গণভোট করাটা হবে শুধুমাত্র জনমত যাচাইয়ের জন্য।”
তিনি বলেন, “যদি গণভোট আয়োজন করতে হয়, তাহলে তা গণভোট ১৯৯১ আইন সংশোধন করে বা তার আদলে নতুন আইন প্রণয়ন করে সেটা করা যেতে পারে।”
৮ অক্টোবর শেষ সভায় এনসিপি সদস্যদের বাধা ও কমিশনের বারবার হস্তক্ষেপের মধ্যে তিনি বলেন, “এটি ঐকমত্য কমিশন, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করাই এর কাজ। যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হয়েছে তা একটি প্যাকেজ হিসেবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে সে বিষয়ে তাদের ‘হ্যাঁ/না’ মতামত গণভোটের মাধ্যমে নিতে পারে।”
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক ক্বাফী রতন বলেন, “সংবিধানের দুটি ভাগ আছে- একটি দার্শনিক, অপরটি অপারেটিভ বা প্রায়োগিক। প্রায়োগিক বিষয় নিয়ে আপোস করা যায়, আলোচনার মাধ্যমে কাছাকাছি হওয়া যায়। কিন্তু দার্শনিক বিষয়ে কোনো আপোস করা যায় না। সিপিবি মনে করে পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের সংগ্রাম এবং ১০ এপ্রিল ১৯৭১ এর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত অঙ্গীকার সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচারের ঘনীভূত রূপ হচ্ছে আমাদের সংবিধানের বিদ্যমান চার মূলনীতি। এর সামান্য পরিবর্তন আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এর জন্যে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত।”
৮ অক্টোবর কমিশনের রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলোচনার শেষ দিন সমাপনী বক্তব্য দিতে গিয়ে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, এর জন্য ১) একটি আদেশ জারি করতে হবে। ২) এই আদেশের মাধ্যমে গণভোট আয়োজন করতে হবে। ৩) গণভোটে দুটি আলাদা প্রশ্ন থাকতে হবে, ঐকমত্য বা বৃহত্তর ঐকমত্য আছে যে সব বিষয়ে সেগুলো নিয়ে একটি আর ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট আছে যে সব বিষয়ে সেগুলো নিয়ে আরেকটি। ৪) নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ঐ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদে গঠিত হবে। ৫) এই আদেশের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গণভোট অনুমোদন সাপেক্ষে জুলাই জাতীয় সনদ বর্ণিত সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংস্কারসমূহ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে।
কমিশনের সহ-সভাপতির এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে একতার প্রতিবেদক সিপিবির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতনকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “কমিশন পথ খুঁজছে, কী প্রক্রিয়ায় জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ বাস্তবায়ন করবে। সংবিধান বা আইনের সুনিদিষ্ট কোনো ধারা বা বিধান খুঁজে না পেয়ে তারা নানা পদ্ধতি অবলম্বন করছে। সর্বশেষ তারা গণভোট খুঁজে পেয়েছে।
“বামদলগুলোর বক্তব্যের পরেও এটাকেই তারা পথ মনে করছে। কিন্তু যে দলগুলোর উপর তাদের ভরসা সে দলগুলোর মধ্যে তারা ঐকমত্য তৈরি করতে পারছে না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা গণভোট নিয়ে চিন্তা করছি না। কারণ আমাদের দাবি অনুযায়ী ঐকমত্যহীন বিষয়গুলো বিশেষ করে সংবিধানের বিদ্যমান চার মূলনীতিকে বাদ দিয়ে মূলনীতি ধারা যদি জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয় আমাদের পার্টি সিপিবি জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর করবে না। গণভোটে অংশ নেয়া অনেক দূরের বিষয়।”
প্রথম পাতা
ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ৫০ হাজার ছাড়াল
‘আখের’
বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের অঙ্গীকার
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রাশিয়া, চীন, ভারত ও পাকিস্তান
সফল করতে দেশব্যাপী ঝটিকা সফর চলছে
‘শরৎ উৎসব’ করতে পারেনি সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী
বন্দর রক্ষায় সভা সমাবেশের কর্মসূচি বামজোটের
ফেব্রুয়ারিতেই একুশে বইমেলা চায় সংস্কৃতিকর্মীরা
ট্রাম্প ও ব্লেয়ার গাজায় আসলে কী করতে চান
খাগড়াছড়িতে ধর্ষণ ও সহিংসতায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি
বাতিল হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘মামলা ও সাজা’
Login to comment..