তুমুল বিতর্ক ও অজস্র প্রশ্ন নিয়ে বিসিবির নির্বাচন
একতা ক্রীড়া প্রতিবেদক :
বাংলাদেশের ক্রিকেটের নিয়ন্তা সংস্থা- বিসিবির নির্বাচন হয়ে গেল তুমুল বিতর্ক জাগিয়ে এবং অজস্র প্রশ্নের জন্ম দিয়ে। এবারের নির্বাচনে বর্তমান সরকার এবং ক্রীড়া উপদেষ্টা সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন বলে অভিযোগ এসেছে। ঢাকার একটি হোটেলে গত সোমবার পরিচালক পদে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ঢাকার ক্লাব সংগঠকদের একটি অংশের চোখে তিনি অবৈধ সভাপতি। তারা ঘোষণা দিয়েছেন কেবল ক্লাব ক্রিকেট নয়, জেলা পর্যায়েও সব ধরনের ক্রিকেট বন্ধ থাকবে এখন থেকে।
এই ডামাডোলের জন্য ক্রিকেট উপেক্ষিত নিদারুণভাবে। ভিসা না পাওয়ায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে টি-টোয়েন্টি সিরিজে খেলতে যেতে পারেননি সৌম্য সরকার। এসব নিয়ে ভাবার যেন সময় নেই বিসিবি কর্তাদের।
নির্বাচনকে ঘিরে নানা অভিযোগের ঝড় উঠে একদম শুরুতেই। পরে ‘নির্বাচন ফিক্সিংয়ের’ অভিযোগে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। নির্বাচনে ‘সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ’ নানারকম ‘অনিয়ম ও স্বেচ্ছারিতার’ অভিযোগ তুলে সরে দাঁড়ান মোট ২১ প্রার্থী। নির্বাচনের আগেই পরিচালক পদ পাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায় ৯ জনের!
ক্লাব ক্যাটাগরির ১২ পরিচালকের লড়াইয়ে শুরুতে ৩০ জন থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা নেমে আসে ১৫ জনে। ক্রীড়া উপদেষ্টার সাজানো ছকেই নির্বাচন হয়েছে, এমন অভিযোগ উঠেছে বিস্তর।
নির্বাচনের আগেই আল্টিমেটাম দিয়েছিল ঢাকার কিছু ক্লাব। নির্বাচনের দুই দিন পর এক সংবাদ সম্মলেন আগের অবস্থানেই অটল থাকার কথা জানায় তারা। দ্বিতীয় দফায় বিসিবি সভাপতি নির্বাচিত হয়ে আমিনুল বলেন, আল্টিমেটাম দেওয়া ক্লাবগুলোর জন্য আলোচনার দুয়ার খোলা। তবে বোর্ডপ্রধানের সেই প্রস্তাবের কথা জেনে সংবাদ সম্মেলনে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কাউন্সিলর মাসুদুজ্জামান দেন জানান প্রতিক্রিয়া, “আলোচনার তো কিছু নেই। নির্বাচনই তো আমরা মানছি না। উনার এখন বলার কিছু নেই, অবৈধ সভাপতি।”
নির্বাচনে ই-ভোট প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক ও দেশের সফলতম ওপেনার তামিম।
“খুবই হাস্যকর একটা জিনিস দেখলাম এই নির্বাচনে। ৪২ বা ৪৩ ভোট কাস্ট হয়েছে ক্লাব ক্যাটাগরিতে। এর মধ্যে ৩৪টটি ই-ভোট। ই–ভোটিং কেন হয়? আপনি দেশে না থাকলে বা ভোট সেন্টারে যেতে না পারলে। কিন্তু ৩৪টা ই-ভোটিং
করা ওই ৩৪ জনই সেদিন ভোট সেন্টারে ছিলেন। ১২ জন যারা প্রার্থী তারা প্রত্যেকে ই-ভোটিং করেছেন। এটার মোটিভ কি? উনাদের কাজকর্মেই নানা কিছু প্রমাণ হয়ে যায়।”
গুলশানের একটি হোটেলে গত বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে ঢাকা ক্লাব ক্রিকেট অর্গানাইজার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিসিসিওএ)। বিসিবি নির্বাচনে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও সরকারের হস্তক্ষেপের নানা অভিযোগে গত শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয় নির্বাচন পিছিয়ে সুষ্ঠভাবে আয়োজন করা না হলে ঢাকার লিগ ক্রিকেট বর্জন করবে ক্লাবগুলি। ৪৮টি ক্লাব এই দাবিতে একমত বলে জানানো হয়েছিল তখন। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার দুদিনের মাথায় আগের সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের কথাই জানানো হয় তাদের পক্ষ থেকে।
ক্লাবগুলির বর্জনই শেষ নয়। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জেলা পর্যায়েও সব ধরনের ক্রিকেট খেলা বন্ধ থাকবে এখন থেকে। ঢাকা তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগ শুরু হওয়ার কথা ছিল কয়েক দিন পরই। এরপর হওয়ার কথা দ্বিতীয় বিভাগ, প্রথম বিভাগ, দেশের মূল লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেট আসর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। সব টুর্নামেন্টই এখন অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল।
সবচেয়ে বড় দুর্ভাবনা ক্রিকেটারদের। জাতীয় দল ও আশেপাশে থাকা ক্রিকেটারদের বাইরে যে শত শত ক্রিকেটার, তাদের জীবিকার মূল উৎসহ এই লিগগুলো। ক্রিকেটারদের জন্য তাই হয়তো দুর্ভোগও অপেক্ষা করছে।
তবে ক্রিকেটারদের ভরসা জোগালেন ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিস (সিসিডিএম) চেয়ারম্যান আদনান রহমান দীপন। ঢাকার ক্লাব সংগঠকেরা সব ধরনের লিগে খেলা বন্ধ করার ঘোষণা দিলেও বিসিবির এই পরিচালক নিশ্চয়তা দিচ্ছেন, প্রয়োজনে ভিন্ন পথে হলেও লিগ হবেই।
“লিগ আয়োজন হবেই, এটা গ্যারান্টি দিচ্ছি। খেলা হবেই, এটা নিশ্চিত। আমি মাঠের মানুষ, ক্লাব সংগঠক। সংগঠকরা সবাই আমার সহকর্মী। কিছু দায়িত্ব আমাকে নিতেই হবে। আমি খুব আশাবাদী- কিছু একটা হবেই। এমনও হতে পারে ভিন্ন পথে হবে এবারের লিগ। অনেক কিছুই হতে পারে।”
বড় একটি অংশ নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় শুধু ক্যাটাগরি তিনের নির্বাচন নিয়ে একটু আগ্রহ ছিল ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের। সেখানে মাত্র ৭ ভোট পাওয়া দেবব্রত পাল বললেন, তিনি শুধু দেখতে চেয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা কতটা তলানিতে নামতে পারে।
“আমাদের একজন ক্রিকেটার কিন্তু একটা ফিক্সিংয়ের কথা বলেছিলেন, নির্বাচন ফিক্সিং। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, একটু সামনে তাকান ভাই, এই নির্বাচন শুধুমাত্র ফিক্সিংই নয়, এর ভেতরে আরও গভীর কিছু হয়েছে। এটার অনুসন্ধান করাটা অত্যন্ত প্রয়োজন।”
পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ার পেছনে দেবব্রতর ইঙ্গিত ক্রীড়া উপদেষ্টার দিকে।
“আমরা অনেক কিছুই বুঝি। আপনারাও অনেক কিছু বোঝেন। এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ক্রীড়ার সর্বোচ্চ ব্যক্তি জড়িত। তিনি বিভিন্ন সময় মিটিং করছেন, তিনি স্টেটমেন্টও দিচ্ছেন। কাজেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অবস্থানটা কোথায়, কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা আপনারা বিবেচনা করবেন।”
সাধারণত বোর্ড পরিচালকদের সঙ্গে আলোচনা করেই নির্ধারিত হয় বিসিবির বিভিন্ন কার্যকরী কমিটি। তবে এবার বিসিবি সভাপতি আমিনুল নিজেই সাজিয়েছেন সব কমিটি। নিজের কাছে রেখেছেন তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বিসিবির ওয়ার্কিং কমিটি, গ্রাউন্ডস কমিটি ও বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন বোর্ড প্রধান। আমিনুলের আগে সভাপতির দায়িত্ব পালন করা আরেক সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ এবার নির্বাচিত হলেও কোনো সাব কমিটির দায়িত্ব পাননি।
নির্বাচনের আগের দিন গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে নিজের চার মাসের দায়িত্বের নানা সাফল্য তুলে ধরেন আমিনুল। কিছু তিনি এড়িয়ে গেলেন, কিছুর উত্তর দিলেন নিজের মতো করে আর কিছু ক্ষেত্রে বল ঠেলে দেন নির্বাচন কমিশনের কোর্টে।
“আইডিয়াল ভোট হচ্ছে কিনা, এটা নির্বাচন কমিশন বলতে পারবে। ভোটে তো আপস অ্যান্ড ডাউন থাকবেই এবং এটা আমার জন্য প্রথম। হয়তো ভাবছি, এটাই হয়তো নরমাল।”
পর্দার আড়ালের খেলায় আগেভাগেই ভোট সেরে ফেলা হয়েছে, ঢাকার একটি হোটেলে রাতে অনেকের ভোটই নেওয়া হয়ে গেছে এবং ক্লাব কোটার ১২ পরিচালক চূড়ান্ত হয়ে গেছে বলে রোববার খবর প্রকাশিত হয়েছে একটি দৈনিক পত্রিকায়। এই প্রসঙ্গে আমিনুলের মন্তব্য, “এটা আমি জানি না। এটা নির্বাচন কমিশন বলতে পারবে।”
নির্বাচনের আগে-পরে নির্বাচন কমিশনের দেখা পাননি ক্রীড়া সাংবাদিকরা। তাই অনেক অসংখ্য প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি।
Login to comment..