আলোর গতি নিয়ে আইনস্টাইনকে চ্যালেঞ্জ জানানো নতুন তত্ত্ব পরীক্ষার মুখে

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

একতা বিজ্ঞান ডেস্ক : আলবার্ট আইনস্টাইনের শতবর্ষ পুরোনো ধারণা-আলোর গতি একটি ধ্রুবক-এবার নতুন করে প্রশ্নের মুখে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাবিশ্বের জন্মের মুহূর্তে আলো আজকের তুলনায় অসীম গতিতে চলেছিল। এমন দাবি করেছেন ২০১৬ সালের দিকে যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের পদার্থবিজ্ঞানী জোয়াও ম্যাগুয়েজিও ও কানাডার ওয়াটারলুর ইউনিভার্সিটির নায়েশ আফশোরদি। দীর্ঘ গবেষণার পর তাঁদের নতুন তত্ত্ব এখন পরীক্ষাযোগ্য হয়েছে, যা বৈজ্ঞানিক মহলে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ম্যাগুয়েজিও ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে এ তত্ত্বের কাজ শুরু করেন। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণাপত্রে তিনি ও আফশোরদি দেখিয়েছেন কীভাবে এই ধারণা বাস্তবে পরীক্ষা করা সম্ভব। তাঁদের তত্ত্ব সঠিক হলে, বিগ ব্যাং-এর পরে সৃষ্টি হওয়া ‘কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড’ বা প্রাচীন মহাজাগতিক বিকিরণে এর স্পষ্ট চিহ্ন পাওয়া যাবে। এই বিকিরণই বর্তমান মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ও ঘনত্বের প্রাথমিক ওঠানামার ছবি বহন করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, নবজাত মহাবিশ্বের তাপমাত্রা তখন ছিল অকল্পনীয়-প্রায় দশ হাজার ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই অতি তাপায়নের সময় আলো ও অন্যান্য কণা অসীম গতিতে ছুটে বেড়াত। ফলে আলো মহাবিশ্বের প্রতিটি কোণে পৌঁছে তাপমাত্রাকে সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল। আজ মহাবিশ্ব যেভাবে প্রায় অভিন্ন দেখা যায়, তার কারণও এই দ্রুত বিচরণ। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে আলোর গতি শূন্যস্থানে স্থির ধরা হয়েছে-প্রায় ৩০ কোটি মিটার প্রতি সেকেন্ড বা ১ বিলিয়ন কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি এই স্থির মান। কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানেন, মহাবিশ্বের প্রথম মুহূর্তগুলোতে আজকের নিয়মকানুন কার্যকর ছিল না। তাই ম্যাগুয়েজিও-আফশোরদি তত্ত্ব প্রচলিত ধারণায় নতুন প্রশ্ন তুলছে। মহাবিশ্বের সমানতালে গড়ে ওঠার ব্যাখ্যায় প্রচলিত তত্ত্ব হলো ‘ইনফ্লেশন’। স্টিফেন হকিংসহ বহু বিজ্ঞানী বলেন, বিগ ব্যাং-এর ঠিক পরপরই মহাবিশ্ব প্রচণ্ড গতিতে বিস্তৃত হয়েছিল, ফলে তাপমাত্রার পার্থক্য মুছে যায়। তবে ইনফ্লেশনের পক্ষে কোনো দৃঢ় প্রমাণ নেই-কি কারণে বিস্ফোরণ হলো, বা কীভাবে হঠাৎ থেমে গেল-এই প্রশ্নগুলো আজও অমীমাংসিত। নতুন তত্ত্ব বলছে, ইনফ্লেশন নয়, বরং আলোর গতির পরিবর্তনই এই সমতা ব্যাখ্যা করে। আফশোরদির ভাষায়, “প্রাথমিক মহাবিশ্বে এমন এক তাপমাত্রা ছিল, যেখানে সবকিছু দ্রুততর হয়ে ওঠে। আলোর গতি অসীমে পৌঁছে যায়, ঠিক যেমন পানি বাষ্পে রূপান্তরিত হয়।” এই গতি মহাকর্ষের গতিকেও ছাড়িয়ে যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-এই তত্ত্ব পরীক্ষাযোগ্য। গবেষকেরা বলছেন, তাঁদের তত্ত্ব মহাবিশ্বের প্রাথমিক ঘনত্ব পরিবর্তনের একটি সুনির্দিষ্ট মান ভবিষ্যদ্বাণী করে-যাকে বলা হয় ‘স্পেকট্রাল ইনডেক্স’। তাঁরা অনুমান করছেন এর মান হবে ০.৯৬৪৭৮, যা বর্তমান মাপের (০.৯৬৮) খুব কাছাকাছি। আগামী কয়েক বছরের পর্যবেক্ষণ এই মান ঠিক নির্ধারণ করতে পারবে। যদি মান তাদের ভবিষ্যদ্বাণী থেকে দূরে সরে যায়, তবে তাঁদের তত্ত্ব অকার্যকর প্রমাণিত হবে। তবে সবাই এই নতুন তত্ত্বে একমত নন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড মার্শ বলেন, “হকিং ও অন্যদের উন্নত করা ইনফ্লেশন তত্ত্ব বহুবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। নতুন তত্ত্ব আকর্ষণীয় হলেও এখনো তা সম্পূর্ণভাবে বোঝা যায়নি।” তবু আজ একটাই নিশ্চিত-আলো, যার গতি বিজ্ঞানকে এতদিন ধরে পথ দেখিয়েছে, তাকে ঘিরে রহস্য এখনও শেষ হয়নি। নতুন গবেষণা আরও গভীর প্রশ্ন তুলছে, আর সেগুলোর উত্তরই হয়তো আমাদের মহাবিশ্ববোধকে পাল্টে দেবে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..