
সম্প্রতি সিলেট মহানগর পুলিশ ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। এই অভিযানের অংশ হিসেবে নগরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দ করা হয়, চালকদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয় ও অটোরিকশার চার্জিং পয়েন্টের বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। প্রতিবাদ করবার কারণে পুলিশ বাসদের সিলেট কার্যালয় থেকে ২২ জনকে এবং বিভিন্ন স্থান থেকে সিপিবির ১৬ জনকে আটক করে। সিলেট মহানগর পুলিশ বাসদ ও সিপিবির নেতাকর্মীদের যেভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো অপরাধের অভিযোগ ছাড়াই স্রফে সন্দেহের ভিত্তিতে আটক করে এবং ‘তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন’ ও ‘অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির’ অজুহাত দেয়, তা বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আন্দোলন দমন পদ্ধতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
সিলেট মহানগরীর যানজট নিরসনের কথা বলে ব্যাটারি রিকশা বিরোধী এই অভিযান পরিচালনা করা হলেও সিলেটে যানজটের অন্যতম কারণ হলো কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা না থাকা। সিলেট পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন হবার পর ২৩ বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। কিন্তু গড়ে উঠেনি গণপরিবহন ব্যবস্থা। নগরের দুটি রুটে ‘নগর এক্সপ্রেস’ নামে কয়েকটি বাস চলে। এসব বাস কখন আসে কখন যায় তার কোন ঠিক থাকে না। বেশিরভাগ সিটই ভাঙাচোরা ও নোংরা। বাসগুলো থামবার কোনো নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড নেই, যাত্রী ছাউনিও নেই। যেকোনো জায়গায় থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হয়। গন্তব্যে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে।
ফলে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য মূলত সিএনজি অটোরিকশা, রিকশা, ব্যাটারি রিকশা, লেগুনা ও মোটরসাইকেলের মতো ছোট যানবাহনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এক গবেষণা অনুসারে সিলেট নগরীতে যত যানবাহন চলে তার ৩৫% রিকশা, ২৮% সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেল ১৮%, ব্যক্তিগত গাড়ি ৭%, সাইকেল ৪% এবং অন্যান্য যানবাহন ৮%। অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তায় বিপুল সংখ্যক ছোট যানবাহন চলাচল ও সেই সাথে পর্যাপ্ত পার্কিং প্লেস না থাকার কারণে যানজট থাকে তীব্র।
প্রায় ৮০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সিলেট নগরীর যানজট সমস্যার সমাধান করতে হলে ব্যক্তিগত ও ছোট যানবাহনের ওপর থেকে নগরবাসীর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। এজন্য পর্যাপ্ত বাস নামানোর বিকল্প নেই। নির্দিষ্ট রুটে পর্যাপ্ত সংখ্যক মানসম্পন্ন বাস চলাচল করলে রিকশা-সিএনজির ওপর নগরবাসীর নির্ভরশীলতা এমনিতেই কমে যাবে। কিন্তু সেই উদ্যোগ না নিয়ে সিলেট মেট্রোপলিটান পুলিশ যানজট নিরসনের নামে ব্যাটারি রিকশা উচ্ছেদ করছে। এতে আপাতদৃষ্টিতে যানজট কমবে বলে মনে হলেও নগরবাসীর যাতায়াতের জন্য গণপরিবহনের ব্যবস্থা না থাকায় ব্যাটারি রিকশার স্থান পূরণ করবে অন্য ছোট যানবাহন। ফলে ব্যাটারি রিকশা উচ্ছেদ করলে প্যাডেল চালিত রিকশা বাড়বে, প্যাডেল রিকশা উচ্ছেদ করলে সিএনজি অটোরিকশা তার স্থান পূরণ করবে।
ব্যাটারি রিকশা উচ্ছেদের যুক্তি হিসেবে সিলেট মেট্রোপলিটান পুলিশের কমিশনার ফেসবুকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে যানজট ছাড়াও দুর্ঘটনা, সীসা দূষণ ও বিদ্যুৎ সংকটের জন্য ব্যাটারি রিকশাকে দায়ী করেছেন। তিনি লিখেছেন, “একদিকে সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অগণিত পরিবার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, অন্যদিকে এটি আমাদের বিদ্যুৎ সংকট, যানজট ও পরিবেশ দূষণের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হলো- আমরা কি আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎকে ব্যাটারি রিকশার বিষাক্ত চাকায় পিষে যেতে দেবো?”
প্রথমত, পুলিশ কমিশনার সাহেব ‘বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা ফাউন্ডেশনের’ বরাত দিয়ে ব্যাটারি চালিত রিকশাকে ২০২৪ সালের এক-তৃতীয়াংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করলেও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো পণ্যবাহী ট্রাক (২৬.৬৬%)। এর পরেই আছে মোটরসাইকেল (২৫.২৪%)। দুর্ঘটনা কবলিত যানবাহনের মধ্যে থ্রি-হুইলারের হার ১৮.৫২%। থ্রি-হুইলার মানে কিন্তু শুধু ব্যাটারি রিকশা না, থ্রি হুইলার বলতে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ইজিবাইক, সিএনজি, অটোরিকশা, অটোভ্যান এই সবকিছুকেই বুঝিয়েছে। বিশেষ করে মহাসড়কে এসব থ্রি হুইলারের দুর্ঘটনার দায় সিলেট শহরের ব্যাটারি রিকশার উপরে চাপানো যুক্তিযুক্ত নয়। আরেকটা প্রশ্ন হলো, দুর্ঘটনা কারণে যদি যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিতে হয় তাহলে তো ব্যাটারি রিকশা চলাচল বন্ধ করবার আগে পণ্যবাহী ট্রাক ও মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করতে হবে। কারণ, এসব যানবাহনের দুর্ঘটনায় পড়ার হার ব্যাটারি চালিত রিকশার চেয়ে অনেক বেশি। ট্রাক বা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কমানোর জন্য যেমন নিয়মকানুন বেঁধে দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে, ব্যাটারি রিকশার ক্ষেত্রেও একই ভাবে চালকদের লাইসেন্স ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে এবং যান্ত্রিকভাবে রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, কমিশনার সাহেব লেড-এসিড ব্যাটারির মাধ্যমে সীসা দূষণের জন্য ব্যাটারি চালিত রিকশাকে দায়ী করছেন। কিন্তু লেড-এসিড ব্যাটারি শুধু ব্যাটারি রিকশাতেই ব্যবহৃত হয় না, ব্যক্তিগত গাড়িসহ আরো অনেক ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার রয়েছে। এজন্য ব্যাটারি ব্যবহার বন্ধ করবার প্রয়োজন নেই, লেড-এসিড ব্যাটারির বদলে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবহারে পৃষ্ঠপোষকতা করাই যথেষ্ট।
তৃতীয়ত, ব্যাটারি রিকশা চার্জে বিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হলে সবার আগে প্রশ্ন তুলতে হবে এয়ারকন্ডিশান আর শপিং মলের আলোকসজ্জায় বিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ে। জনগণের করের টাকায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের জীবিকা ও পরিবহনের কাজে ব্যবহার হলে তাকে অপচয় বলবার কোনো সুযোগ নেই। আর অবৈধ ব্যাটারি চার্জ বন্ধ করার জন্য ব্যাটারি রিকশা বন্ধ না করে বরং বৈধভাবে স্বল্প খরচে ব্যাটারি চার্জের ব্যবস্থা করাই যুক্তিযুক্ত।
কাজেই দেখা যাচ্ছে যেসব যুক্তি দিয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ ব্যাটারি রিকশার ওপর চড়াও হয়েছে, সেগুলোর একটাও ধোপে টিকে না। আসলে সিলেট নগরীর যানজট সমস্যার টেকসই সমাধান করতে হলে একদিকে পর্যাপ্ত গণপরিবহন চালু করতে হবে অন্যদিকে রিকশা, ব্যাটারি রিকশা, সিএনজি এগুলোকে নিয়ম কানুনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এজন্য এলাকা ভেদে ব্যাটারি চালিত রিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা, আধুনিক যন্ত্র প্রকৌশলের মাধ্যমে এগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানো, যান্ত্রিক কৌশলে এগুলোর গতি বেধে দেয়া, ব্যাটারি চালিত যানবহনকে লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসা, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট স্থানে চার্জিং এর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এতে গণপরিবহন নগরের যাতায়াত ব্যবস্থার ব্যাকবোন বা মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করবে, অন্যদিকে রিকশা-অটোরিকশার কাজ হবে লাস্ট মাইল সার্ভিস প্রদান করা।
ব্যাটারি চালিত রিকশা একদিকে হাজার হাজার রিকশা চালকের শ্রমকে সহজ করেছে ও স্বল্প খরচে মানুষের যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছে অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে এই ব্যাটারি রিকশা তৈরি ও মেরামতকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে আরো বহুসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান। নীতি নির্ধারকদের উচিত মানুষের শ্রমকে সহজ করা এই প্রযুক্তিকে উচিত স্বাগত জানানো এবং এগুলো নিরাপদ করার জন্য নানান নিয়মকানুন বেঁধে দেয়া। এর ফলে যেসব গ্রাম ও মফস্বলে গণপরিবহন ব্যবস্থা নেই সেইসব স্থানে তো বটেই, এমনকি শহুরে গণপরিবহন ব্যবস্থার অন্তর্গত অংশ হিসেবেই ব্যাটারিচালিত রিকশা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক