শুধু সংস্কার নয়, প্রয়োজন সমাজ বিপ্লবের

মিজানুর রহমান সেলিম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি দুবাইয়ে ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটের এক অধিবেশনে আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। নির্বাচন কমিশনও সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে, তবে সে নির্বাচন জাতীয় সংসদ নাকি স্থানীয় সংস্থার অথবা গণপরিষদ নির্বাচন কি না, তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। এদিকে অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কোন নির্বাচন আগে হবে এবং নির্বাচন কখন হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। বিএনপি দ্রুত এবং আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। অন্য কোনো নির্বাচন আগে দিলে তা প্রতিরোধেরও ঘোষণা দিয়েছে দলটি। তাঁরা মূলত নির্বাচন সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের অস্পষ্টতা দূর করে একটি নির্বাচনী রূপরেখা ঘোষণার দাবিকেই সামনে নিয়ে আসছে এবং এই দাবী পূরণ না হলে আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়ার হুমকী দিচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপি-র এক সময়ের জোট সঙ্গী জামায়াত আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং তারও আগে যৌক্তিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি তুলেছে। এদিকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারী নতুন বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে একটি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এই দলটি “সেকেন্ড রিপাবলিক (২য় প্রজাতন্ত্র) প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নকে অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। তারা বলেছে, সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলাসহ ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করে গড়ে তুলে এসব প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে। যে কোন রাজনৈতিক দলের এসব কাজ করার অঙ্গীকার ঘোষণা নিশ্চই অভিনন্দন যোগ্য। তবে রাষ্ট্রের এসব সংস্কার সাধন করা যেমন কষ্টসাধ্য তেমনি এর জন্য অভিজ্ঞতা ও ধৈর্য্যরে দরকার হয়। তদুপরি এর জন্য পর্যাপ্ত সময়েরও প্রয়োজন। সংস্কারের জন্য বিএনপি এত সময় দিতে নারাজ। তারা সংসদ নির্বাচনের জন্য দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করার দাবীতে ইতোমধ্যে আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছে। কাজেই এনসিপি’র ঘোষণার প্রাথমিক লক্ষ্য বাস্তবায়নে যেসব কাজকর্ম সম্পাদন করতে রাজনৈতিক দলসমূহের একমত হওয়া প্রয়োজন সেক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মত ও উদ্দেশ্য এসসিপি’র উদ্দেশ্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। এ ছাড়াও এ দলটিকে অনেকে স্বাগত জানালেও তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও মতাদর্শ নিয়ে বিএনপি ও বাম দলগুলোর প্রশ্ন আছে। বহুমত ও পথের চর্চার কথা কিছুটা গ্রহণযোগ্য হলেও তাদের উত্থাপিত “সেকেন্ড রিপাবলিক” এবং গণপরিষদ নির্বাচন কেন কী কারণে করতে হবে তা পরিষ্কার নয়। প্রশ্ন আসছে বর্তমান রিপাবলিক কি অচল, তাই তার সবকিছু বাতিল করতে হবে? সংবিধান সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে ’৭২ এর সংবিধানের মূল চারটি মূলনীতির তিনটিকেই বাদ দিয়ে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। সেকেন্ড রিপাবলিকের আইডিয়া কি এখান থেকেই উঠে এসেছে? এসব গুরুতর বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোনো আলোচনা ও মতানৈক্য হয়নি। তাহলে সামনের দিকে এসব চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে কিভাবে কোন মতাদর্শের ভিত্তিতে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি দাঁড়াবে তা এখনই স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। সমগ্র জাতির সামনে আশঙ্কা একটাই, তা হলো- ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গৌরব-মহিমা ও তার তাৎপর্যকে আড়াল করার কোন ষড়যন্ত্র নিয়ে কেহ অগ্রসর হচ্ছে কি না? এদিকে নতুন দলের ঘোষণায় অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ও সমাজ গড়ায় দেশ ও সমাজকে আর বিভাজিত করা যাবে না তা বলা হয়েছে, কিš‘ বাস্তবে আমাদের সমাজের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যুগ যুগ ধরে যে শ্রেণি বিভাজন রয়েছে এবং এই শ্রেণি বিভাজন যেভাবে মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভয়ানক বৈষম্য সৃষ্টি করছে তা এক রূঢ় বাস্তবতা। তাই এই বাস্তবতা বদলানোর জন্য শোষণমূলক আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রগতিমুখীন বিপ্লবী পরিবর্তন ছাড়া এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। কোনো রাজনৈতিক দল প্রকৃতপক্ষে সমাজ থেকে বৈষম্যের মুক্তি চাইলে সেই রাজনৈতিক দলের মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের ঘোষণায় এই দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তা-ও নতুন দলটির ঘোষণায় উল্লেখ নেই। কাজেই তাদের ঘোষণা এবং মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বৈপরীত্য বিদ্যমান। বৈষম্যমুক্তির প্রশ্নে দেশের বামপন্থী দলগুলো সোচ্চার। তারা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন চায় এবং দীর্ঘদিন যাবৎ এই লক্ষ্যেই তারা আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। বর্তমানে দেশের উগ্রপন্থিদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বাম জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের রক্তের দাগ না শুকাতেই একটি দেশবিরোধী স্বার্থান্বেষী মহল ২০২৪ এর গনঅভ্যূত্থানের ম্যান্ডেটের বিপরীতে দেশকে উগ্রবাদের দিকে ঠেলে দেয়ার চক্রান্ত শুরু করেছে। এই বিপদ থেকে দেশকে রক্ষার জন্য বামজোটের পক্ষ থেকে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদের উত্থানের চক্রান্ত রূখে দেয়ার জন্য দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈবির লক্ষ্যে বামজোট যখন প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছে তখন একটি মহল পরিকল্পিতভাবে মবসন্ত্রাস ও বুলডোজার কর্মসূচির নামে নয়া ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ ধানমন্ডি ৩২ এর ঐতিহাসিক বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে একটি আইনবিহীন রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করছে। এবং তারা পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার উপরও আঘাত হানছে। বামজোটের আশংকা হচ্ছে এর অনিবার্য পরিণতি হবে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক উগ্রবাদ যা দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়া এবং অর্থনৈতিক সংস্কার ভাবনাকে চরমভাবে ধ্বংস করে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ব্যর্থ করে দেবে। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেভাবে অবনতি ঘটেছে বিশেষ করে ইদানিং ঢাকা-রাজশাহী রুটে চলন্ত বাসে ডাকাতির পাশাপাশি নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নিয়ন্ত্রণহীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নারীদের নিরাপত্তা বিপজ্জনকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে ওঠার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনে তাদের অর্থনৈতিক সংকটকে আরো গভীর করে তুলেছে। সবচেয়ে বড় সংকটটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি, ইদানিং প্রকাশিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মূলত সরবরাহ চেইনের দুর্বলতার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সরকার সার ও বিদ্যুতের ভর্তুকিও কমাতে পারছে না, কর ও জিডিপি অনুপাত রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির জন্য কমছে। প্রকৃত খেলাপি ঋণ এখনও বাড়ছে। গত ৬ মাসে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমছে ৭১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ সূচক নিম্নগামী। এর সাথে শিল্প-কারখানাগুলোতে লাগাতার শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। শিল্পখাতের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের ৪০ হাজার কর্মচারীর বেতন ভাতার দাবীতে রাস্তা অবরোধসহ শিল্পকারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে কারখানা মালিকের পলায়ন শিল্পখাতকেই চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে। দেশে চলমান এ ধরনের নানা বিশৃঙ্খলা এবং এর সাথে উগ্র জঙ্গিবাদী তৎপরতায় দেশপ্রেমিক জনগণ গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। যদিও অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে সরকার ‘অপারেশন ডেভিল হান্টের’ মতো একটি বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। কিন্তু এই অভিযানে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন, পক্ষপাতিত্ব এবং নিরপরাধ জনগণের নির্যাতিত হবার আলামত দেখা যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশ স্থায়ী নৈরাজ্যের মধ্যে পড়বে। জঙ্গিবাদের ঘাটি গেড়ে বসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে সমাজ ও অর্থনীতি। এমন ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে দেশের মানুষের পরিত্রাণের উপায় কী? উপায় হলো গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষায় দেশে গণতন্ত্র ও সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সকল পক্ষের আন্তরিকতা প্রদর্শন করা। গণঅভ্যুত্থানের এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সকল পক্ষ আন্তরিক হলেই সংকট জনক পরিস্থিতি থেকে আপতত উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হবে। গনআকাঙ্ক্ষা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার, আর এজন্য প্রয়োজন, একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ বিশ্বাসযোগ্য সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। উল্লেখ্য যে, এবারের গণঅভ্যুত্থানের পরে দেশে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ঠেকানোর জন্য জনমনে একটি আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে তা ঠিক, তবে তা বাস্তবায়নে শুধু একটি ফ্যাসিবাদী সরকারকে উৎখাত করলেই হয় না, প্রযোজন হয়, যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মধ্য থেকে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ঘটে সেই ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন সাধন করা। যদিও দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে এবারের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়নি। তাই ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এই দায়িত্ব পালনের জন্য সরকার গঠন করেনি। অথচ দেশে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার মধ্যে এবারের গনঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে গনতন্ত্র ও বৈষম্যমুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছে, তা বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে দেশের চলমান শোষণমূলক আর্থ- সামাজিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন করে শোষণ-নিপীড়ণ মুক্ত একটি বিকল্প আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। প্রচলিত ব্যবস্থা বহাল রাখার রাজনীতির যে উদ্দেশ্য নিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হয়েছে, তাতে এই ব্যবস্থার রাষ্ট্রকাঠামোয় কতগুলো সংস্কার সাধন করে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেই দায়িত্ব শেষ হয়। প্রচলিত ব্যবস্থাটাতো পুঁজিবাদ, পুঁজিবাদের সংকট তার মুনাফা অর্জনের অভ্যন্তরীণ প্রবণতার জন্যই সৃষ্টি হয়। এই প্রবনতা যখন লোভ ও লিপ্সায় পরিণত হয়, তখন তা নিজের কাঠামোটাকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দেয়। এটাকে রক্ষা করতেই প্রয়োজন হয় সংস্কারের। ড. ইউনূসের দায় এই সংস্কারের চেয়ে বেশি কিছু নয়। তাই এই ধরনের একটি লক্ষ্য থেকেই ড. ইউনূস ছয়টি কমিশন ও বিষয়ভিত্তিক একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করেছেন। ইতিমধ্যে অনেক গুলোর রিপোর্টও জমা পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঐক্যমতে পৌছে এসব প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যাবে। তবে এই সংস্কার কর্মসূচি সম্পন্নের মাধ্যমে এবারের গণঅভ্যুত্থানের গণআকাঙ্খা, গণতন্ত্র ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। সমাজ বিপ্লব ছাড়া অন্য কোন বিকল্প পথে জনগণের গণতন্ত্র ও সাম্য প্রতিষ্ঠার পথ খোলা নেই। এসব কিছুর পরেও সংস্কারের প্রতি জনগণের সমর্থন পেতে অবশ্যই জনগণের জীবন-জীবিকার বিদ্যমান সংকট দূর করে বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমূল্য রোধসহ নানা অর্থনৈতিক সংকট ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। কারণ সাধারণ মানুষের কাছে সংস্কারের চেয়ে সরকারের কাছ থেকে এ মুহূর্তে কি কি উপকার পাচ্ছে তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থনৈতিক সংকট ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করার পরেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হয়ে বরং অবনতি হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? এর যথাযথ উত্তর খুঁজেই সংকটের সমাধান বের করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, একটি গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এদেশের মানুষ ’৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান, ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে ৯০ সালে আরেকটি গণঅভ্যুত্থান করেও গণতন্ত্র ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, ফলে তার ধারাবাহিকতায় সেই গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে ২০২৪ সালে আবার গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে একটি ফ্যাসিস্ট দুঃশাসনকে উৎখাত করেছে। এখন প্রয়োজন এমন একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা যে ব্যবস্থার মধ্য থেকে আবার একটি অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট দুঃশাসনের উদ্ভব না ঘটে। তাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও রুটি-রুজির নিশ্চয়তা বিধান করে এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করার কোন বিকল্প নেই। এবারের গনঅভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার আকাঙ্ক্ষার যে পরিবর্তন হয়েছে তার প্রভাব গভীর ও সুদূরপ্রসারী হলেও এই পরিবর্তনকে বিপ্লব বলা যাবে না কারন, বিপ্লব দ্বারা একটি সমাজের উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থায় এবং সমাজে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে আমূল পরিবর্তন ঘটে তা এবারের গণঅভ্যুত্থানের চালিকাশক্তির সামাজিক চেতনায় উত্তরণ ঘটেনি। তাই বৈষম্যহীন প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রের চরিত্র ও রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে প্রয়োজন হবে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার একটি সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করা, যে বিপ্লব জনগণের জন্য প্রকৃত গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট একটি অংশের বক্তব্যে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঘোষণায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রেণি সম্পর্কের ধরণটি বৈষম্যমূলক নাকি সমতাভিত্তিক তার বাস্তব চিত্রের বিচার বিশ্লেষণ করে সমতার সম্পর্কের সমাজ প্রতিষ্ঠার ভাবনা ছাড়া অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা হাস্যকর। শ্রেণিগত ভাবে দেশ এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে ৯০ ভাগ অন্যদিকে ১০ ভাগ। বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা অটুট রেখে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন তারা যে দলেরই হোন না কেন, তারা প্রতিনিধিত্ব করবেন ১০ ভাগ মানুষের। কাজেই সমাজের ৯০ ভাগ মানুষের স্বার্থরক্ষার প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব ছাড়া আর যাই হোক সেই সমাজটি গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন সমাজ হতে পারে না। এজন্যই প্রকৃত গনতান্ত্রিক ও সম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রয়োজন হবে ৯০ জনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। প্রশ্ন হচ্ছে এ পথ ধরে অগ্রসর হওয়ার উপায়টা কী? উপায়টা হচ্ছে দেশের সবগুলো বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে ৯০ ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে এমন সব রাজনৈতিক দলগুলোর স্বতন্ত্র অবস্থান গ্রহণ করে শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে সমাজ বিপ্লবের আহ্বান জানানো–যে বিপ্লব পুঁজিবাদ ও ফ্যাসিবাদকে স্থায়ীভাবে বিতাড়ন করে সমাজে গণতন্ত্র ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করবে। লেখক : সভাপতি, বরিশাল জেলা কমিটি, সিপিবি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..