পরিমাণে নয়, মানেই জাতির পরিচয়

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
শরিফুল হাসান সমাপ্ত : শিক্ষা একটি জাতি গঠনের প্রধান উপাদান। একটি শিক্ষিত জাতিই পারে পৃথিবীর বুকে জায়গা করে নিতে এবং পারে একটি নতুন সভ্যতার জন্ম দিতে। সেদিক থেকে পরিসংখ্যান দেখলে সাম্প্রতিক কালে আমাদের এগিয়ে থাকারই কথা, কেননা বিগত প্রায় ১০ বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পাসের হার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সহজেই প্রতীয়মান হয় জাতি হিসেবে শিক্ষিত হচ্ছি, কিন্তু সুশিক্ষিত কি হতে পারছি? পরীক্ষা মানে একটি মান। এই মান এর একটি পাশে থাকবে ফেল আর একটি পাশে পাস। কিন্তু এখন এই মানটিকে এমনভাবে সহজলভ্য করা হয়েছে যে এই পরীক্ষা হচ্ছে পাস করানোর পরীক্ষা যেখানে ফেল নামক কিছুই থাকবে না। অথচ পরীক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যই হলো ফেল করানো, তাতে যারা পাস করে তাদের মান সঠিকভাবে যাচাই হয়। পরীক্ষা পদ্ধতি সহজ করে পাসের হার বাড়ালে অযোগ্য ছাত্র পাস করবে। তাতে পরীক্ষার আর কোনো মূল্য থাকবে না। আমাদের শিক্ষার মান এখন নামতে নামতে এতোই নিচে নেমেছে যে আর নিচে নামা সম্ভব নয়। এখান থেকে উপরের দিকেই যেতে হবে নিচে আর জায়গা নেই। আরেকটি দুর্ভাগ্যজনক কথা হলো আমাদের সরকারগুলোর সফলতা ব্যর্থতা আমরা নিরূপণ করি পরীক্ষা পাসের হার এর মাধ্যমে। যে কারণে সরকার শুধু পাসের হার বাড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হয় শিক্ষার মান না বাড়িয়ে। এটি চরম একটি নির্বুদ্ধিতার পরিচয় আমাদের। প্রশ্ন হলো, এই বিশাল অঙ্কের ছাত্র-ছাত্রীরা কোথায় যাবে এরপর? প্রশ্ন জটিল হলেও উত্তর অনেক সহজ আমাদের এই দেশে। একেবারে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে ডিগ্রি দিয়ে দেয়া হচ্ছে অনায়াসেই। গ্রাম থেকে এসে এভাবেই প্রতারিত হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী। আমাদের উচ্চ শিক্ষা আজকে প্রশ্নের সম্মুখীন। পাবলিক ইউনিভার্সিটি নতুন হয়েছে অনেকগুলো, কিন্তু সেগুলোর সংখ্যা এবং মান আরো বাড়াতে হবে। এবং হাতে গোনা দশটি ইউনিভার্সিটি ছাড়া বাকি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোর অবস্থা খুবই জঘন্য। কিন্তু ঠিকই দেখা যাচ্ছে চার বছরের মধ্যে ডিগ্রি দিয়ে দিচ্ছে। আর অন্যদিকে আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, যার অধীনে কয়েক লক্ষ্য ছাত্র পড়াশুনা করছে, তার মানোন্নয়নের দিকেও কোনো খেয়াল নেই সরকারের। অনেকবার বলা হলো বিভাগ অনুযায়ী ভাগ করে দেয়া হোক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে। তাতে করে এর মান এবং সেবা দুটোই বাড়বে। কিন্তু নানা জটিলতায় সেটাও সম্ভব হলো না। এভাবে কী পাব আমরা? হয়ত শিক্ষার হার বাড়বে, কিন্তু আমরা শিক্ষিত মানুষ পাবো না। দেশ হারাবে তার প্রাণশক্তি। তাই আধুনিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন আজ সময়ের দাবি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা কাজে মনোনিবেশ খুবই প্রয়োজন। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া বন্ধ করতে হবে, পুরনোগুলোর মান উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষার উদ্দেশ্য কী এবং কারা শিক্ষিত? এই প্রশ্নের উত্তরে ৯৯% বাংলাদেশি বলবেন শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য একটা ভালো চাকুরি, অর্থাৎ কিনা বড় চাকর তৈরি হওয়া এবং এদেশের মানুষের ধারণা বড় ডিগ্রি মানে বেশি শিক্ষিত। কিন্তু এদেশে যাদের বড় ডিগ্রি থাকে তাদের ভেতরে শিক্ষার আলো খুব কম দেখা যায় বরং যাদের ডিগ্রি নেই এমন অনেক মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো দেখতে পাওয়া যায়। এখানে একজন বড় ডিগ্রিপ্রাপ্ত মানুষ অন্যের থেকে অবৈধভাবে অর্থ নিয়ে নিজের রোজগার বাড়ান, অন্যদের গবেষণাপত্র চুরি করে নিজের নামে প্রকাশ করেন, প্রাথমিক স্কুলের বাচ্চাদের মত অন্যের সাথে ঝগড়াঝাটি করে ট্রেনে জায়গা দখল করেন। এমন শিক্ষিত মানুষও দেখা যায় যিনি পান বা সিগারেট খেয়ে স্কুলের দেয়াল বা পরিবেশ নোংরা করেন কিংবা বাস থেকে থুতু ফেলেন যেটা রাস্তায় চলমান মানুষের গায়ে গিয়ে পড়ে। পিতামাতার সম্পত্তি নিজের করায়ত্ত্ব করে পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে চালান করেন কিংবা সিঁড়ির নিচে ঢুকিয়ে দেন। ডাক্তাররা রোগীদের থেকে বেশি অর্থ রোজগারের চেষ্টা করেন। এগুলো প্রকৃত শিক্ষার নমুনা? আজ পর্যন্ত কোনো দার্শনিক কোথাও বলেন নি যে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য চাকুরি বা এইসব পাশবিক আচরণ। তাহলে বাংলাদেশিরা এটা শিখলো কোথা থেকে? আসলে বহু বছর এদেশীয়রা অন্যের গোলামি করতে করতে গোলামি করাটা তাদের জন্মগত অধিকার বলে ধরে নিয়েছেন এবং গোলামি করতে করতে তাদের নীতি-আদর্শ সব জলাঞ্জলি হয়ে গেছে। শিক্ষা স্কুল, কলেজ, বই এসব থেকে পাওয়া যায় না, শিক্ষা মানুষের ভেতর থেকে আসে। প্রকৃত শিক্ষার জন্য স্কুলে যেতে হয় না বা ডিগ্রি লাগে না। প্রকৃত শিক্ষা মানুষের ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করে এবং সঠিক আচরণ করতে শেখায়। যে মানুষের ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও আচরণ ঠিক নেই সে মানুষই নয়। সুতরাং ডিগ্রি থাকুক বা নাই থাকুক নিজেকে প্রকৃত মানুষ তৈরি করাটাই হল শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য। যাতে সে সমাজের জন্য কল্যাণকর হয়ে উঠতে পারে। না হলে সারাজীবনের সব পরিশ্রম প-শ্রমে পরিণত হবে। তাই বলতে পারি- “পরিমাণে নয় মানেই জাতির পরিচয়”। আমরা পরিমাণ বাড়ানোর চেয়ে মান বাড়ানোর দিকে জোর দেবো–সেটাই হোক আমাদের কামনা। য় লেখক : শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা, যোগাযোগ এবং মিডিয়া স্টাডিস, বরেন্দ্র বিশ্বদ্যালয়, রাজশাহী

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..