বাংলাদেশে আদিবাসীদের ভূমি-অধিকার সংকট : আইন, সমাজ ও রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব!
আসাদুজ্জামান রাসেল
বাংলাদেশ একটি ভিন্নমাত্রার, বহু-জাতিগোষ্ঠী, বহু-ভাষিক, বহু-সংস্কৃতির দেশ। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সংবিধানের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল জাতির-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সাম্যের মূলনীতির ওপর। এই চারটি স্তম্ভ কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির জন্য নয়, বরং এ ভূখণ্ডে বসবাসকারী সকল জাতিগোষ্ঠীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। তবুও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে আদিবাসীদের বিশেষত- সাঁওতাল, ওরাঁও, মুণ্ডা, গারো, চাকমা, মারমা প্রভৃতি সম্প্রদায় বারবার ভূমি থেকে উচ্ছেদ, অধিকারহীনতা এবং সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রেরই অংশ, ‘বহিরাগত’ নয়। তাদের জমি দখল মানে কেবল কিছু মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা নয়, এটি পুরো সমাজকে বৈষম্য, অন্যায় ও শোষণের দিকে ঠেলে দেওয়া। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও যদি সাঁওতাল বা অন্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিজেদের জমিতে নিরাপদ না থাকে, তবে রাষ্ট্রের ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার অর্থহীন হয়ে পড়ে। সুতরাং, ভূমি সুরক্ষার জন্য আইন, সমাজ ও রাষ্ট্র সব পক্ষেরই এখন দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
রাজশাহী অঞ্চলের সাঁওতাল জনগোষ্ঠী এ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রায় আড়াই শত বছর আগে তারা এই অঞ্চলে এসেছিল কৃষিকাজের সন্ধানে। তারা ধীরে ধীরে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে সহাবস্থানে চাষবাস শুরু করে। আর সাধারণ বাঙালির মতো কৃষিকাজ, দিনমজুরি, ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু আজও তাদের মাথার ওপর ভাসছে ভূমি হারানোর আতঙ্ক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, প্রভাবশালী মহল জোর করে তাদের চাষযোগ্য-বাসযোগ্য জমি দখল করছে। জমি বাঁচাতে গেলে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, মিথ্যা মামলা খাচ্ছেন, এমনকি শারীরিক হামলার শিকার হচ্ছেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশে এসেও তাদের ভূমি-অধিকার সুরক্ষিত হয়নি। ভূমিদস্যু, প্রভাবশালী মহল এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের যোগসাজশে বারবার তাদের জমি-মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
এখানে ইতিহাস, আইন, সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানগত দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমি অধিকার সংকট বিশ্লেষণ করলে, যে পরিমাণ ক্ষোভ-হতাশা তা দুঃখজনক। এর ভেতরে আমাদের নানা ভিন্নমতের ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাষ্ট্রীয় কাঠামো, ভূমি আইনের চরিত্র, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, এবং সমাধানের সম্ভাব্য পথনির্দেশ হতে পারে, তেমনী এ সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব।
ব্রিটিশ শাসনের সময় সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬) উপমহাদেশের কৃষক আন্দোলনের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। এই বিদ্রোহ ছিলো ব্রিটিশ শাসকদের চাটুকার ‘জমিদার’ তথা জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে। কিন্তু বিদ্রোহ দমন করার পর, ব্রিটিশরা সাঁওতালদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর প্রতারণার মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে কৃষিকাজের জন্য নিয়ে আসে। ধীরে ধীরে তারাও স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে।
ঠিক তেমনই ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর হরে-গরের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলার বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করলেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর কোনো স্বীকৃতি দেয়নি। ভূমি সংস্কারের নামে ‘বড় জমিদার’ উচ্ছেদ করা হলেও প্রান্তিক সাঁওতাল কৃষকের জমি সুরক্ষিত হয়নি। বরং অনেক জমি মুসলিম প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে চলে যায়।
১৯৭২ সালের সংবিধানে ‘জাতীয়তাবাদ’কে বাঙালি জাতীয়তাবাদ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এর ফলে ‘আদিবাসী’ পরিচয়টি উপেক্ষিত হয়। ১৯৭২ সালের ভূমি আইন কার্যকর হলেও স্থানীয় প্রভাবশালী মহল প্রশাসনের সহযোগিতায় সাঁওতালদের জমি দখল করতে থাকে। ১৯৮০-এর দশক থেকে ইটভাটা, শিল্পায়ন এবং সরকারি খাস জমি বন্দোবস্তের নামে তাদের চাষযোগ্য জমি ব্যাপক হারে দখল হয়ে যায়।
বাংলাদেশের ভূমি আইন ১৯৭৪ সালে প্রণীত হয় এবং তাতে বলা হয়, যে জমি চাষ করছে, সেই কৃষকই মালিকানা পাবে। কিন্তু বাস্তবে, আদিবাসী কৃষকরা বারবার বঞ্চিত হয়। কারণ, দলিলপত্র সমস্যা, অনেক আদিবাসীর কাছে জমির মালিকানার দলিল নেই। মৌখিক চুক্তিতে তারা চাষাবাদ করে আসছিল। প্রভাবশালী দখলদাররা এই সুযোগ নেয়। অন্যদিকে প্রশাসনিক পক্ষপাত প্রবলভাবে থাকায়, থানায় বা ভূমি অফিসে গেলেও, অধিকাংশ সময় আদিবাসী কৃষকরা ন্যায়বিচার পাননি বা এখনো পাননা। আবার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় ভূমিদস্যুরা রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও রায় কার্যকর হয় না। খাসজমি বন্দোবস্ত নামে সরকার দরিদ্র জনগণকে খাসজমি দেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে এগুলো চলে যায় প্রভাবশালীদের দখলে।
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান।” তবুও আদিবাসীরা সেই সমতা পান না। এমনকি ‘আদিবাসী’ শব্দটিই সরকারি নথিতে স্বীকৃত নয়; তাদের বলা হয় “ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী”। এটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ওখঙ) ১৬৯ নং কনভেনশনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যেখানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি ও অধিকার স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।
ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বনাম সংখ্যালঘু- বড়ো আকারে সঙ্কট ছাড়া আর কিছুই না। বাংলাদেশের প্রধান সমাজবৈশিষ্ট্য হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির আধিপত্য! রাষ্ট্রের সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন সবকিছুই সংখ্যাগরিষ্ঠের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাজানো। ফলে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোকে প্রায়শই “অন্য” হিসেবে দেখা হয়।
রাজশাহী অঞ্চলের সাঁওতালরা ধান, গম, ভুট্টা, আলু চাষে দক্ষ। তারা গ্রামীণ অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, পোশাক কিংবা ধর্ম এসবকে ‘প্রধানধারার’ সমাজ সহজে মেনে নেয়নি। অনেকে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে, কেউবা ঐতিহ্যবাহী সারনা বা সনাতন ধর্ম পালন করে। অধিকিন্তু ধর্মের কারণে তাদের ওপর বাড়তি সামাজিক চাপ তৈরি হয়। এ ধারা হতে তারা বের হতে চেয়ও, অদৃম্য আরেক জালে আটকা পড়েছে, এখানে তাদের সম্প্রদায়গত দায় চাপানো হয়, আর আরেকবার তাদেও গর্তে ঢোকানো হয়। এই যে বারবার একই খেলা তা সামাজিক বৈরীতার চরম প্রমাণ। এ এক বড়ো তামাসা ছাড়া কী আর কিছু হতে পারে?
সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, এটি মূলত শ্রেণি ও জাতিগত বৈষম্যের মিশ্রণ। কারণ, তারা দরিদ্র কৃষক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, আবার জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু। ফলে তাদের ওপর দ্বিগুণ নিপীড়ন কাজ করে। আর জমি হলো উৎপাদনের প্রধান উপকরণ। যে শ্রেণি জমির মালিক, সেই শ্রেণিই সমাজের অর্থনৈতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশে আদিবাসীদের জমি দখল প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছে- ইটভাটা ও শিল্পায়ন। জমি দখল করে ইটভাটা তৈরি করা হয়। এর ফলে কৃষি জমি কমে যায়, আবার পরিবেশও ধ্বংস হয়। ফলে চাষযোগ্য জমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে স্বল্প ভূমির মালিক কিংবা কোনো আদিবাসি। আর ভূমিদস্যুরা জোর করে জমি দখল করে কোনো ঝামেলা ছাড়াই। তাছাড়া মামলা করলে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে আদালতের চত্বরে!
এবার আছে আরেক জিনিস তা’হলো, ‘সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প’। এতে আমারা দেখি রাস্তা, স্কুল বা সরকারি প্রতিষ্ঠান করার নামে জমি অধিগ্রহণ করা হয়, কিন্তু ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় না। সাধারণের হাহাকারের কোনো মূল্যই যেনো কোথায় হারিয়ে যায়। তখন শুধু উন্নয়ন আর উন্নয়ন!
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের চাপকে কে অবহেলা করতে পারে? মানুষের প্রয়োজনে উৎপাদন করতে হবে চিনি, ভুট্টা, তামাক ইত্যাদি,যা নগদ ফসলের চাহিদা বাড়ায়, আর প্রভাবশালী গোষ্ঠী আদিবাসী কৃষকদের জমি দখল করে বাণিজ্যিক কৃষি চালু করে। এ কর্পোরেট কোম্পানির মুলধনসহ বাড়তে থাকে মুনাফা আর আর কৃষক ন্যায্যতার অধিকার হারিয়ে- খবরের কাগজে- গাছের ডালে ঝুলন্ত লাশ হয় কিংবা সহপরিবারে কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করে!
জাতিসংঘের Declaration on the Rights of Indigenous Peoples (২০০৭) স্পষ্টভাবে বলে, আদিবাসীদের ভূমি, সম্পদ ও সাংস্কৃতিক অধিকার রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে হবে। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ার অনেক দেশ এই ঘোষণা স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশও সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ করেনি। অধিকাংশের কাছে এটা শুধু খবরের কাটতি বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই না। ভারতের সংবিধানে ‘শিডিউল ট্রাইব’ হিসেবে সাঁওতালরা বিশেষ স্বীকৃতি পায়। তাদের জন্য রয়েছে সংরক্ষিত আসন, জমি রক্ষার বিশেষ আইন, উন্নয়ন প্রকল্প, তবুও ভারতের আসাম.ঝাড়খণ্ড কিংবা আদিবাসী প্রধান এলাকাগুলো দেখলে আহত হতে হয়। বাংলাদেশে সেই ধরনের নীতিগত সুরক্ষা নেই, প্রয়োগ তো আরো দুরের বাক্য। সমাধানের পথ হতে পারে,
১. আইনি স্বীকৃতি সংবিধানে ‘আদিবাসী’ শব্দের স্বীকৃতি দিতে হবে।
২. ভূমি সুরক্ষা আইন, বিশেষ আইন করে আদিবাসীদের কৃষিজমি দখলমুক্ত রাখতে হবে।
৩. স্বশাসন ও স্থানীয় প্রশাসন আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৪. শিক্ষা ও সংস্কৃতি সুরক্ষা মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় সহায়তা দিতে হবে।
৫. আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন জাতিসংঘের ঘোষণা ও ILO কনভেনশন অনুযায়ী নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
৬. সামাজিক সচেতনতা – সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সমাজকে আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার জন্মলগ্নে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়ের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু পাঁচ দশক পেরিয়েও আদিবাসী ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার সুরক্ষিত হয়নি। বরং তারা বারবার উচ্ছেদ, দখল ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
রাজশাহীর সাঁওতালরা এদেশের নাগরিক। তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, কৃষি উৎপাদনে অবদান রেখেছে। তবুও তাদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়। এটি কেবল আইনি ব্যর্থতা নয়, রাষ্ট্রের নৈতিক ব্যর্থতাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
আজ প্রয়োজন একটি মৌলিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এই রাষ্ট্র কি কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য, ধণিক শ্রেণির জন্য, নাকি এখানে বসবাসরত প্রতিটি জনগোষ্ঠীর জন্য সমানভাবে কার্যকর? মার্কস বলেছিলেন “যে জাতি অন্য জাতিকে শোষণ করে, সে নিজেও মুক্ত হতে পারে না।”
বাংলাদেশ যদি সত্যিই মুক্ত, সমান ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
Login to comment..








প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন