নারী শোষণ ও শ্রম

যাদব গোবিন্দ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

সমাজ ও সভ্যতার শৈশব থেকেই নারীরা বিভিন্ন ধরনের শোষণের শিকার হয়ে আসছে। শোষণ হওয়ার সূত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হল পুঁজিতন্ত্র,ধর্মতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্র। এই তন্ত্র মন্ত্রের বশীকরণে নারী সমাজ যুগযুগ ধরে মুক্তির সূত্র খুঁজে পাচ্ছেনা। প্রাচীন সভ্যতায় সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যে ও নারীকে পুরুষতন্ত্রের সেবিকা ও কৃতদাসীর ন্যায় জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছিল যা এখনো বর্তমান। আমি গ্রীক, রোমান ও ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রের কথা যদি বলি সেখানেও নারীকে আবদ্ধ ও ভোগ্যপণ্য হিসেবেই দেখানো হত। পৃথিবী বদলে দেওয়া দার্শনিকরাও নারীর অবস্থানকে বদলাতে চাননি। সক্রেটিস, প্লেটো, হিরাক্লিটাস, সফোক্লিস, রুশো, রুমি, চার্বাক, চাণক্য, থেকে শুরু করে আধুনিক রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সবাই নারীকে প্রকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তাদের মতো করেই সাজিয়েছেন নারীকে ও তার শরীরকে। উদাহরণ দিয়ে যদি বলি যেমন- ইডিপাস নাটকে দেখতে পাই নিয়তিবাদের ফলস্বরূপ ইডিপাস তার বাবা রাজা লাউসকে হত্যা করে প্রথা অনুসারে রাণীকে বিয়ে করেন, পরবর্তী সময়ে তাদের চারটি সন্তান হয়, যখন রাজসভায় প্রকাশ হয় ইডিপাস জোকাস্টার সন্তান তখনই তিনি অপমানে আত্মাহত্যা করেন, এবং ইডিপাস নিজের দুচোখ অন্ধ করেন। সেখানে নাট্যকার সফোক্লিস যে কূটনীতির সমীকরণ করেছেন তা হল সমাজের নীতিমেনে যেখানে জোকাস্টাকে হত্যা করিয়েছেন সেখানে ইডিপাসকে দুচোখ অন্ধ করে ও নির্বাসন দিয়েই সমাপ্তি করেছেন। তাতে নাট্যকারের মধ্যে পুরুষ ও ধর্মতন্ত্রের ছাপ দেখতে পাই। কবি লেখকেরা পুরুষতন্ত্র থেকে বের হয়ে মুক্ত সমাজে কতটুকু আসতে পেরেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তর্ক। এই পুরুষতন্ত্রের কবি সমাজ নারীকে তার কাব্যে কখনো ভোগবাদে; কখনো রোমান্টিসিজমে ব্যবহার করেছেন। নিজকে তুলনা করেছেন সূর্যের সঙ্গে নারীকে তুলনা করেছেন চাঁদের সঙ্গে। নারীর শরীরকে কবিতার মঞ্চ বানিয়েছেন এই কবি সমাজ। তারা কখনো ধর্মকে আশ্রয় করেছেন; কখনো প্রকৃতিকে আশ্রয় করে সাজিয়েছেন তার কাব্য কবিতা গল্প উপন্যাস- যেখানে নারী রয়েছে তার অনুগত হয়ে। ধর্মতন্ত্র নারীকে দাসী, সেবিকা, পুরুষের বাধ্য যৌন সঙ্গী হিসেবেই দেখতে চায়। কবি বাল্মীকি তার মহাকাব্য রামায়ণে যতটুকু সীতার সতীত্বের উপর দৃষ্টি দিয়েছেন, ততটুকু দৃষ্টি উপমহাদেশের নারী সমাজের উপর এখনো পুরুষতন্ত্র দিয়ে থাকে। নারী ও তার সতিত্বকেই শ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসেবে গণ্য করে। ইউরোপে ধর্ম যাজকেরা নারীর সতীত্ব ও কুমারিত্ব রক্ষার আইন ও আন্দোলন করে থাকতো। সতীত্বহীন নারী কূলনাশা সমাজ নষ্ট করে এই উপাধি ধর্মতন্ত্রই শিখিয়েছে নারী সমাজকে। নারীও তা মেনে নিয়েছে অবলীলায়। মহাভারতের দ্রৌপদীই ছিলেন প্রথম বিদ্রোহী নারী যিনি পাঁচজন স্বামী নিয়ে সংসার করেছেন। মহাকবি ব্যাদব্যাস ঐ প্রাচীন কালেই তার কাব্যে নারীর বিদ্রোহী রূপ অংকন করতে পেরেছিলেন। এই নারী সমাজ কখনো কখনো বের হয়ে মুক্ত আকাশ দেখতে চেষ্টা করেছিল। তাই আমরা নারী কবিদের মধ্যে দেখতে পাই আক্কাদীয় সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মহামতি সার্গন কণ্যা এনহেদুয়ান্নাই প্রথম শৃঙ্খল ভাঙ্গেতে শুরু করে ছিলেন। তারপর গ্রীক কবি স্যাফো, জাপানি ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিখিবুকে, সিমনা দ্য ব্যয়েয়ার, ইউরোপীয় রেনেসাঁসে ইসোও নোগারোলা, কাসেন্দ্রা ফেডেল,লরা সিরেতা ও চিত্র শিল্পী প্লাউটিলা, নারীমুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। কুক্কুরিপা, খনা, চান্দ্রাবতী, রোকেয়াসহ আরও অনেকই নারী সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন। তারাও পুরুষের দাসত্বকে অস্বীকার করে একটি সুন্দর সমাজের সংগ্রাম করে ছিল। পুরুষের মন স্ত্রীলোকে আসক্ত, যা তাকে অনিয়ন্ত্রিত করতে পারে। হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাই পুরুষতন্ত্রের সৌর্যবীর্য, যেখানে নারীর পদচিহ্ন চন্দ্রগ্রহণের ন্যায় আকস্মিক। সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তনবাদে প্রকৃতি সর্বদাই পরিবর্তনশীল; বিজ্ঞানের কোন সূত্র তা বাদ দেয়নি। কিন্তু সেখানে জিজ্ঞেসাবোধক চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নারীর অস্তিত্ব! এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তার অবস্থান কতটুকু স্পষ্ট? নারী আজও কতটুকু ক্রীতদাসী? প্রাচীনকালের ক্রীতদাস নামের একটা প্রথার বিলুপ্তি হলেও পরিবর্তনীয় রূপে বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদীরা ব্যবহার করছে আধুনিক সমাজব্যবস্থায় মানুষের উপর। নারীকে বাক্সবন্দী করতে পুরুষতন্ত্র যে ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল ধর্মতন্ত্র ও পুঁজিবাদ। আর এই ধর্মতন্ত্র ও পুঁজিবাদ একে অন্যের পরিপূরক। পৃথিবীর বিখ্যাত উপন্যাস মা, সেখানে গোর্কি ফুটিয়ে তুলেছেন মা নিলভনার জীবন স্মৃতি ও বিপ্লবী মায়ের ভূমিকা। তার স্বামী মিখাইল গ্লাসভ কারখানার শ্রমিক ছিলেন। সে দীর্ঘ পরিশ্রমের পর মদ্যপ হয়ে বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করতেন । নিলভনা তা নিরবে শয়ে যেতেন। জমিদার দর্পনে নাটকে জমিদার হায়ওয়ান আলী গরীব কৃষক আবু মুল্লার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নির্মম যৌনতার মাধ্যমে হত্যা করেছিল। ‘হারমজাদী ছিনাল, বজ্জাত মাগী, খানকি বেইশ্যা, এই কসবী হারামজাদী! ঘোমটা দে’। মসজিদে যাওয়ার পথে ফেলু মিঞার উক্তি। সংশপ্তক উপন্যাসে শহীদুল্লা কায়সার তুলে ধরেছেন এ দেশের গ্রাম বাংলার বাস্তব চিত্র। নবাকভের ললিতা উপন্যাসে মধ্যে বয়স্ক প্রফেসর হামবার্ট বারো বছর বয়সী ললিতার প্রেমে পড়েছিল। ললিতার সঙ্গ পাওয়ার জন্য তার মা শালর্টকে পর্যন্ত বিয়ে করেছিল। এখানে প্রতিটা ঘটনাতেই পুরুষতন্ত্র নারীর উপর লোভ, লালাসা, নির্যাতনের চিত্র দেখতে পাই। যা আমাদের সমাজে বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক। এই সাহিত্য সংস্কৃতি ও দর্শনের ইতিহাসের মধ্যে ধর্মীয় ও পুরুষতন্ত্রের বাহিরে যিনি সুস্পষ্ট যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি হলেন কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। কিন্তু তরুণ মার্কস নারী বিষয়ে হেগেলের কিছুটা প্রভাব পড়লেও নিজের যুক্তিবাদের উপর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। নারী বিষয়ে এঙ্গেলস বলেন মানবসভ্যতার বৃহত্তর পরিবর্তন হয় ব্যক্তিগত মালিকানার সম্পত্তি উদ্ভবের ক্ষেত্রে। তিনি বললেন শোষণের স্পষ্ট পরিষ্কার রূপ দেখা দেয় পরিবার প্রথার মাধ্যমে। এক স্বামীভিত্তিক প্রথম পরিবারটি পুঁজিবাদী সমাজের প্রথম সংগঠন, এই পিতৃতান্ত্রিকতার সূত্রপাতও সেখান থেকেই। এই পরিবারতন্ত্র থেকেই যার বিকাশ সভ্যতা জুড়েই ঘটেছে। রাজতন্ত্র, দাসতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, পুঁজি ও সাম্রাজ্যতন্ত্র- এই সকল মন্ত্র তন্ত্রেই নারী তার স্বাধীনতা সহ সর্বস্ব খুয়েছে। মানুষ ইতিহাসে প্রবেশ করার সময় থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতর দিয়ে নারীর অবস্থানটিকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ মার্কসের আগে কেউ করেনি। মার্কস বলেছেন প্রকৃতি থেকে মানুষ আলাদা হচ্ছে শ্রম দিয়ে, সেই প্রকৃতিকে জয় করতে চাচ্ছে মানুষ শ্রম দিয়ে, সেই শ্রমে নারীর অবস্থান কি? তার মূল্য কি? সমাজের বর্জোয়া থেকে সর্বহারা প্রতিটি শ্রেণিতেই নারীর অবস্থান রয়েছে। কিন্তু পুরুষদের স্ত্রী হয়ে যারা সন্তান উৎপাদন, গৃহস্থালি কাজ করে সময় ও শ্রম দিয়ে থাকে। তাদের ও মুক্তি প্রয়োজন অর্থনৈতিক ও সমাজিক যেখানে প্রতিটা স্বামী একেকজন শোষক সেখানে পরিবার প্রথার বিলুপ্তি ও বিবাহ প্রথার উচ্ছেদ অনিবার্য। তাই নারীদের মুক্তিও অসম্ভব যতদিন না তারা একত্রিত হয়ে অসীম শক্তি কাজে লাগায়। পুঁজিবাদ ও সম্রাজ্যবাদী সমাজ ব্যবস্থায় আমরা দেখতে পাই নারীকে সুকৌশলে ব্যবহার করে আসছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও বৃহত্তর কোম্পানির প্রচার প্রসারে নারীকে ব্যবহার করে পুঁজির স্তম্ভ মজবুত করেছে মালিক শ্রেণী। মানবমস্তিষ্কের অবচেতন মনের সুপ্ত বাসনাকে সুকৌশলে ব্যবহার করে পুঁজি এগিয়ে যাচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীনের রসদগুলো আজ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ব্যবহার না হয়ে ব্যবহার হচ্ছে মানুষকে শোষণের হাতিয়ার রূপে। সমাজের প্রতিটা শ্রেণিতে শ্রেণিতে মানুষকে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছে শাসক দল। এবং এই শ্রেণিগুলোতে ও পুরুষের থেকে নারী আরও রূগ্ন। কোম্পানিগুলো বিভিন্ন বাহারি রকমের দ্রব্য পণ্য উৎপাদন করে নারীর রূপ সৌন্দর্য বর্ধিত করার জন্য, যেন পুরুষের জন্য সে প্রস্তুত হয়। এই প্রস্তুত হওয়ার চিন্তা নারীর মনঃস্থ থেকে বের করতে হবে। এই সমাজের সম্পদ বন্টনে নারীর অবস্থান খুবই শোচনীয়। নারীর সর্বদাই বাবা, স্বামী ও ছেলের উপর ভরসা এবং আস্থা রেখে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। তার সমগ্র জীবনের শ্রমের মূল্যের পরিমাপ হয়না এই সমাজে। ইতিহাসে তার যতটুকু চিহ্ন থাকে তা পুরুষের অধীনস্থ হয়ে। নারীর মস্তিষ্ক, চিন্তা ও আবেগের প্রকাশ হয়না,তা বিলুপ্ত হয়ে যায় অঙ্কুরেই। তার সমগ্র জীবন অতিবাহিত হয় বীভৎসময় অবস্থায়। আমাদের পুরুষতন্ত্রের কবি ও লেখক সমাজ নারীকে সুপ্তভাবে তার অনূকূলেই চায়। তাই আমি বলতে চাই পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের চিন্তাগুলো যদি প্রস্ফুটিত আমরা করতে পারি তাহলে পৃথিবীতে আরও একটি যুগান্তকারী বিপ্লব হবে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..