
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের সত্যিই এক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। ইউক্রেন ও গাজার প্রেক্ষাপটে তাঁর অবস্থানের মধ্যে যে স্পষ্ট বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে, তা অনেকের কাছেই বিভ্রান্তিকর। তিনি ইউক্রেন প্রসঙ্গে যুদ্ধ এড়িয়ে এক ধরনের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির কথা বলছেন, অথচ গাজার ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার মতো ভয়ংকর আক্রমণাত্মক। এই বিপরীতমুখী অবস্থান দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, আসলে তিনি কোন পথের পথিক? তবে এই বিভ্রান্তির মূল ট্রাম্পের ব্যক্তিগত অবস্থানে নয় বরং সমস্যার শিকড় সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃতি সম্পর্কে অপর্যাপ্ত বোঝাপড়ায়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এমন এক কোণে গিয়ে ঠেকেছে, যেখানে যুদ্ধ আরও বাড়িয়ে পরমাণু সংঘর্ষের ঝুঁকি নেওয়া বা ধীরে ধীরে আধিপত্য হারানোর বাইরে আর কোনো পথ নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প চেষ্টা করছেন সাম্রাজ্যবাদকে এই দোটানা থেকে বের করে আনতে। তিনি ‘শান্তির পক্ষে’ না ‘যুদ্ধের পক্ষে’ এই প্রশ্নটা মুখ্য নয়। আসল কথা হলো, তিনি এক বিকল্প সাম্রাজ্যবাদী কৌশল নিচ্ছেন, যা আগের ভুল নীতির তৈরি সংকট থেকে সাম্রাজ্যবাদকে রক্ষা করতে পারে। কারণ, সেই পুরোনো নীতির সঙ্গে তার জড়িত থাকা নেই।
সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ধরে রাখতে ট্রাম্প বেছে নিচ্ছেন চাপ ও লোভ দেখানোর কৌশল। ইউক্রেন যুদ্ধকে উসকে দেওয়ার পেছনে ধারণা ছিলো যে রাশিয়াকে হয়তো জোর করে পশ্চিমা শর্ত মানাতে বাধ্য করা যাবে। যা ইতোমধ্যেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের ময়দানে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। আর রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে রুবলকে ‘ধুলিসাৎ’ করার যে কথা বলা হয়েছিল, তা পুরোপুরি ব্যুমেরাং হয়েছে। রুবলের দাম সাময়িকভাবে দুর্বল হলেও পরে ডলারের তুলনায় আগের চাইতেও আরও শক্তিশালী হয়েছে। বরং এসব নিষেধাজ্ঞাই ডলারের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিশ্বে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
গত বছর ব্রিকসের কাজান সম্মেলনে ‘ডি-ডলারাইজেশন’ বা ডলারের প্রভাব কমানোর প্রশ্নটা গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। সাম্রাজ্যবাদী নিষেধাজ্ঞা যখন এক-দু’টি ছোট দেশের ওপর পড়ে, তখন তা কার্যকর হতে পারে। কিন্তু যখন সেই নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার মতো বড়, উন্নত আর সম্পদসমৃদ্ধ দেশের ওপর আরোপিত হয়, তখন সেগুলোর কার্যকারিতা অনেকটাই কমে যায়। উল্টো, এমন অনেক দেশ মিলে একটি বিকল্প জোট তৈরি হয় এখনকার ‘আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’ নামে পরিচিত পশ্চিমা আধিপত্যের পুরো কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এমনকি যেসব দেশের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা নেই, তারাও এই বিকল্প ব্যবস্থার দিকে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এই নতুন বাস্তবতাকে সামনে রেখেই ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসেন। তার চাপ ও প্রলোভনের কৌশলের ‘চাপের’ দিকটা বিশ্ববাসীর কাছে বেশ পরিচিত। তিনি ডলার ছেড়ে অন্য মুদ্রায় লেনদেন করা দেশগুলোর ওপর উচ্চ শুল্ক চাপানোর হুমকি দেন যা বেশ নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী আচরণ এবং পুঁজিবাদী নিয়মের স্পষ্ট লঙ্ঘন। পুঁজিবাদের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, লেনদেনের দুটি পক্ষ রাজি থাকলে যেকোনো দেশ তার পছন্দের মুদ্রায় বাণিজ্য করতে বা সম্পদ রাখতে পারে। কিন্তু ওই স্বাধীনতা কেড়ে নিতে শুল্ক চাপানো একপ্রকার জোর জবরদস্তি, যেটা কোনো আন্তর্জাতিক নিয়মেই বৈধ নয়। কিন্তু ট্রাম্প এমন এক নির্লজ্জ সাম্রাজ্যবাদী, যিনি এসব নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করেই প্রকাশ্যে এই চাপ প্রয়োগ করেছেন।
অন্যদিকে, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ ট্রাম্পের কৌশলের ‘প্রলোভনের’ দিক। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে বিকল্প জোট গড়ে উঠছে, তা ঠেকাতেই এই কৌশল নিয়েছেন ট্রাম্প। রাশিয়ার জন্য খুব একটা অস্বস্তির না হয় এমন কোনো শর্তে যুদ্ধ থেমে গেলে রাশিয়াকে ওই বিকল্প জোট থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে। এতে করে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা চলমান প্রতিরোধও দুর্বল হয়ে পড়বে।
অবশ্যই, আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান হলে তা সবারই স্বাগত জানানো উচিত। তবে এটাকে ট্রাম্পের শান্তিকামী চেতনা বা ইউরোপের নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে শুধুই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার কৌশল হিসেবে দেখা ভুল হবে। ট্রাম্প যেকোনো শান্তির দূত নন গাজা নিয়ে তার যুদ্ধাকাঙ্খী বক্তব্যই সেটা স্পষ্ট করে। আসলে পুঁজিবাদ চরিত্রগতভাবেই শান্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে। যেমনটা ফরাসি সমাজতন্ত্রী জ্যঁ জোরেস বলেছিলেন ‘পুঁজিবাদের ভেতর যুদ্ধ লুকিয়ে আছে, ঠিক যেমন মেঘের ভেতর বৃষ্টি থাকে।’ ট্রাম্পের এই কার্যকলাপ শান্তি নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে টিকিয়ে রাখার নতুন কৌশল। ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়েও যত কথা সবই আসলে ভাওতা। রাশিয়া কখনোই ইউরোপের জন্য সরাসরি হুমকি ছিল না। ‘রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদ’ নিয়ে যেসব কথাবার্তা চালু, তা আসলে ছিল ন্যাটোর সম্প্রসারণবাদকে বৈধতা দেওয়ার অজুহাত মাত্র। তাই ট্রাম্পের কথিত ‘শান্তি উদ্যোগে’ ইউরোপের নিরাপত্তা নষ্ট হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
ট্রাম্প ও ইউরোপের শাসক শ্রেণির পার্থক্যটা আসলে সাম্রাজ্যবাদের দুই ধরনের কৌশলের মধ্যে দ্বন্দ্ব। একদিকে আছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আগ্রাসী অবস্থান নেওয়া বাইডেনের পুরোনো কৌশল যা এখন ব্যর্থতার মুখে। আরেকদিকে আছে ট্রাম্পের বিকল্প কৌশল যা রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে পশ্চিমা আধিপত্যবিরোধী জোট থেকে দূরে রাখতে চায়। ইউরোপের নেতারা যেখানে বাইডেনের পুরোনো কৌশলেই আস্থাশীল, সেখানে ট্রাম্প সামনে এনেছে এই নতুন কৌশল। জার্মানির উগ্র-ডানপন্থী দল আফডি (অভউ)-র ইউক্রেন যুদ্ধবিরোধিতাও এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা উচিত। তাদের ফিলিস্তিনবিরোধী আগ্রাসী অবস্থান আর ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান এই বৈপরীত্য আসলে ‘শান্তিকামীতা’ বা ‘ইউরোপের নিরাপত্তা’ নিয়ে ভাবনার প্রতিফলন নয়, বরং তাদের সুনির্দিষ্ট কৌশলগত অবস্থান।
ট্রাম্প যেভাবে সাম্রাজ্যবাদকে সংকট থেকে টেনে বের করতে যে রাস্তা বেছে নিয়েছেন, সেটি একইসঙ্গে পুরো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী জোটের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ফের প্রতিষ্ঠার প্রয়াসও। তাঁর “গধশব অসবৎরপধ এৎবধঃ অমধরহ” স্লোগান আসলে এমন এক বিশ্ব গড়ে তোলার পরিকল্পনা, যেখানে পশ্চিমা আধিপত্য প্রশ্নাতীত থাকবে এবং তার নেতৃত্বে থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই একই কৌশলই এর আগে দেখা গিয়েছিল নর্ড স্ট্রিম২ গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংসের ঘটনার মাধ্যমে, যা ইউরোপকে আমেরিকান জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল করে তোলার অংশ ছিল। অভিযোগ রয়েছে, এই ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ‘ডিপ স্টেট’।
ট্রাম্পের কৌশলে একটা বড় ধরনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের ‘নেতৃত্ব’ দিতে গেলে একটা মূল্য দিতে হয়, কিন্তু ট্রাম্প চান মূল্য না দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রকে নেতা বানাতে। এই মূল্যটা কী? নেতা হিসেবে অন্য বড় পুঁজিবাদী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি মেনে নিতে হয়, তাদের উচ্চাকাঙ্খাকে জায়গা দিতে হয়, যাতে পুরো পুঁজিবাদী বিশ্ব সংকটে না পড়ে। ব্রিটেন তার নেতৃত্বের সময় এটা করেছিল, সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রও করছে। ব্রিটেনের ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল। কিন্তু এতে ক্ষতি হয়নি, কারণ ব্রিটেন তার উপনিবেশ থেকে অদৃশ্য আয়ের উদ্বৃত্ত দিয়ে এই ঘাটতি পূরণ করত। এই উদ্বৃত্তের বড় অংশ ছিল জোর করে আদায় করা, উপনিবেশগুলো থেকে ‘লুণ্ঠন’ করে অন্য পুঁজিবাদী শক্তির সঙ্গে হিসাব মেটানো হতো। যুদ্ধোত্তর যুক্তরাষ্ট্র এতটা ‘ভাগ্যবান’ ছিল না। অন্য বড় দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যে তারা বেশি কিনত, বিক্রি করত কম। ফলে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে।
ট্রাম্প তার ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ পরিকল্পনার মাধ্যমে এই ঋণ আর বাড়াতে চান না। তাই তিনি সব দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে শুল্ক বাড়াচ্ছেন, যাতে আমেরিকার কেনাকাটা কমে। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মানুষের কেনার ক্ষমতা বা চাহিদা বাড়ছে না। কারণ বড় বড় পুঁজিপতি আর বিনিয়োগকারীরা চান না সরকার বেশি খরচ করুক বা ধনীদের ওপর বেশি কর বসাক। সরকার যদি বেশি খরচ না করে, তাহলে অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়ে না, মানুষের হাতে কেনার মতো টাকাও আসে না। ফলে বাজারে জিনিস বিক্রি হয় না, ব্যবসা মন্দা হয়। ট্রাম্পের শুল্ক বাড়ানোর ফলে এই সমস্যা আরও জটিল হবে। বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনীতি আরও সংকটে পড়বে। এই সংকটের চাপ সবচেয়ে বেশি পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের দেশগুলোর ওপর, কারণ তাদের বাজার আরও সঙ্কুচিত হবে। সহজ কথায়, ট্রাম্প আমেরিকাকে বাঁচাতে চাইছেন, কিন্তু এতে অন্য দেশগুলোর অর্থনীতি আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে।
ট্রাম্প যেভাবে আমেরিকার পুরনো দাপট ফেরাতে চাচ্ছেন, সেটা অনেকটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’-র মতো। একদিকে তিনি বিশ্বে নেতৃত্ব নিতে চান, অন্যদিকে অন্য দেশের পণ্যে শুল্ক বসিয়ে বাজার দখলের চেষ্টা করছেন। এইভাবে নিজের উন্নয়ন আর্থিকভাবে অন্যদের ক্ষতি করে গড়া যেটা আসলে টিকেও না, চলেও না। এভাবে চললে নেতৃত্ব নয়, বরং বিরোধ আরও বাড়ে। বাইডেন যেভাবে সাম্রাজ্যবাদকে এক সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন, ট্রাম্প সেটা টেনে তুলতে গিয়েও শেষমেশ অন্য আরেক সংকটেই ঠেলে দিচ্ছেন।
অনুবাদক : খায়রুল হাসান জাহিন
সৌজন্যে : ক্রিমসন থিউরি