আশা-নিরাশার বর্ষবরণ

কংকন নাগ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে শিল্পীদের দলীয় পরিবেশনা। পুরো পার্কজুড়ে ছিল আপামর মানুষের অপূর্ব মেলবন্ধন [ ছবি:  রতন কুমার দাস ]
দেশের প্রধানতম অসাম্প্রদায়িক উৎসব, বাংলা বর্ষবরণ ঘিরে প্রতিবছরের মতো এবারও নানা শঙ্কা, হুমকি, ভুল ব্যাখ্যার অবতারণা ছিল। ছিল নানাভাবে উৎসবকে ব্যাহত বা সীমাবদ্ধ করার অপচেষ্টাও। শেষ পর্যন্ত বড় কোন দুর্ঘটনা না ঘটলেও চট্টগ্রাম, বগুড়া, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজনে নানাভাবে বাধা দেয়ার অপচেষ্টা দেখা গেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই আবহমান বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক-বাহক নানা উৎসব ও আয়োজন ঘিরে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাঙলা ও বাঙালি সংস্কৃতির অনেক অনুষঙ্গকে আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত করে অহেতুক ফ্যাসিবাদী ট্যাগ দেয়ার অপচেষ্টাও করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের হাস্যকর দাবি তোলার পর তা মেনে নেয়ার মতো অভূতপূর্ব ঘটনাও দেখা গেছে। আশির দশকের মাঝামাঝি স্বৈরাচার এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে শুরু হওয়া ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে নাম পাল্টে রূপ নেয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য়। এরপর থেকেই মূলত এটি ধীরে ধীরে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বর্ষবরণ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে সেটি। যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে, প্রায় সব জেলাতেই আয়োজন হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। তবে সেই মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পাল্টানোর উদ্ভট দাবির পেছনে হাওয়া দেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টাও। শেষ পর্যন্ত উগ্র, ধর্মান্ধ, মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো মঙ্গল শব্দটির অপব্যাখ্যা করে দেওয়া দাবি মেনে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পাল্টে হয়ে যায় আনন্দ শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করা ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ নামের মোটিফ প্রথমে পুড়িয়ে দেওয়া এবং মাত্র একদিনের মধ্যে তা আবারও নির্মাণ করে শোভাযাত্রায় রাখা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। চারুকলার শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল, এবছর হঠাৎ করেই তাদেরকে বাদ দিয়ে পুরো আয়োজন করেছেন চারুকলার শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সরাসরি হস্তক্ষেপকে উৎসাহিত করা ছাড়াও, শোভাযাত্রার মোটিফ নির্ধারণ থেকে শুরু করে কোন পর্যায়েই শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এর ফলে, শোভাযাত্রাকে সরাসরি রাজনীতিকরণের ঘটনা দেখা গেছে। তবে, শোভাযাত্রায় বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বড় পরিসরে অংশগ্রহণের বিষয়টি ইতিবাচক ছিল। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, বরিশাল, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলায়ও বর্ষবরণ আয়োজনে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। চট্টগ্রামের ডিসি হিলে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বর্ষবরণ আয়োজন করা হয়। এবছর সেই আয়োজনের অনুমতি দিতে প্রায় দুই মাস ধরে টালবাহানা করে প্রশাসন। আয়োজনের দুই দিন আগে অনুমতি দিলেও সেখানে কী কী গান, কবিতা পরিবেশিত হবে সেই তালিকা জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ অভিযোগ তুলে উদীচীসহ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সবচেয়ে সক্রিয় প্রায় ২০টি সাংস্কৃতিক সংগঠনকে ডিসি হিলের পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মঞ্চে তুলতে নিষেধাজ্ঞা দেয় জেলা প্রশাসন। এছাড়া, অনুষ্ঠানস্থলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করায় পহেলা বৈশাখের আগের দিন রীতিমতো মিছিল নিয়ে গিয়ে অনুষ্ঠানের মঞ্চ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভাঙচুর করে মৌলবাদীগোষ্ঠী। হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বর্ষবরণ আয়োজন বন্ধ করতে বাধ্য হন আয়োজকরা। গান, কবিতার তালিকা চাওয়া, যেকোন সংগঠনকে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দেয়া শুধুমাত্র সংস্কৃতি চর্চায় বাধা দেয়াই নয়, বরং এগুলো শিল্পীর স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। এধরনের বিকৃত মনমানসিকতার যেসব মানুষ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন, তাদেরকে অবিলম্বে বরখাস্ত করা উচিত। এবছর বগুড়াতেও বর্ষবরণ আয়োজনে বাধা দেয়া হয়। উদীচীসহ কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে ‘দিন বদলের মঞ্চ’ ব্যানারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রশাসন বাধা দেয়। পরে, অনুমতি দিলেও নানাভাবে আয়োজন সীমিত করার অপচেষ্টা চালানো হয়। নববর্ষের দিন অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে গান, আবৃত্তি করা নিয়ে নানা ধরনের ফতোয়া দেয়ার চেষ্টা চালায় মৌলবাদীরা। তাদের হুমকির মুখে বিকেলের অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয়। অথচ, এসব মৌলবাদী, ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া, বরিশালেও উদীচীসহ কয়েকটি সংগঠনের আয়োজনে বৈশাখী মেলাকেও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়। বরিশালে প্রতিবছরই উদীচীসহ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে বর্ণিল শোভাযাত্রা, বর্ষবরণ উৎসব ও বৈশাখী মেলা আয়োজন করা হয়। কিন্তু, এবার নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে মেলার অনুমতি দিতে অপারগতা জানায় পুলিশ। অন্যান্য জেলাতেও বর্ষবরণ আয়োজনকে নানাভাবে সীমিত করার অপচেষ্টা দেখা গেছে। সব মিলিয়ে আশা-নিরাশার মিশ্রণে এবারের বাংলা বর্ষবরণ-১৪৩২ উৎসব শেষ হয়েছে। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্যে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় ঘটিয়েছিল ছাত্র-জনতা, ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এখনও বাংলা বর্ষবরণ বা বসন্ত উৎসবের মতো অসাম্প্রদায়িক আয়োজন এবং প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার উপর বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে, শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। অশুভের বিরুদ্ধে শুভশক্তির জয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে প্রত্যয় প্রতিবছর বর্ষবরণ আয়োজন থেকে নেয়া হয়, তাকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস সবাইকে সাথে নিয়ে রুখে দিতে হবে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..