ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী প্রসঙ্গে
শামছুজ্জামান সেলিম :
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীসমূহের ভূমিকা ছিল অনন্য সাধারণ। গেরিলা যোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। ‘হিট অ্যান্ড রান’ ট্যাকটিস পাকিস্তানি বাহিনীর অভ্যন্তরে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছিল। ’৭১ সালের ২৬ মার্চের পর যে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে উঠেছিল এবং যারা প্রতিরোধ যুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন পরবর্তিকালে তারাসহ লাখো মুক্তিকামী যুবক প্রশিক্ষণ নিয়ে গেরিলা যোদ্ধা হয়েছিলেন।
গেরিলা বাহিনী সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাহিনী ছিল এফ এফ বা ফ্রিডম ফাইটাররা। এ ছাড়াও কাদেরিয়া বাহিনীসহ অনেক ছোট ছোট বাহিনী ছিল। এসব বাহিনী সমুহের পাশাপাশি কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের নেতৃত্বে আর একটি ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনী’ গঠিত হয়েছিল। এই বাহিনীর নাম ছিল ‘ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী’। ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনী’ এ জন্যেই বলা হতো যে, এই বাহিনীকে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের উপযোগী করে প্রশিক্ষিত করা হয়েছিল। এই বাহিনীর নেতৃত্বকে একটা মাত্রা পর্যন্ত কমান্ডো ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল। প্রবাসী সরকারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদই শুধু জানতেন এই বাহিনী গঠন সম্বন্ধে। ‘বিশেষ বাহিনীর’ গেরিলাদের রিক্রুট করা হয়েছিল খুব যত্ন সহকারে বাছাইয়ের মাধ্যমে। এই বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডারগণ নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সদস্যদের ‘বাহিনীতে’ গ্রহণ করেছিলের।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের জেলাভিত্তিক ‘ইয়ুথ ক্যাম্প’ গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীগণ এসব ‘ক্যাম্পে’ জড়ো হয়েছিলেন গেরিলা হিসেবে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্যে। এই ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ প্রশিক্ষণের প্রধান ক্যাম্প ছিল ভারতের আসাম প্রদেশের তেজপুরে। এ ছাড়া শিলিগুড়ির ‘পানিঘাটাসহ’ কয়েকটি ক্যাম্পে ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ প্রশিক্ষণ হয়েছিল।
‘বিশেষ গেরিলা বাহিনী’ গঠন এবং পরিচালনায় আলাদা বিশেষত্ব ছিল। ‘বাহিনীর’ সদস্যরা রিক্রুট হয়েছিল কেন্দ্রীয়ভাবে। এখানে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হতো। আর গেরিলাযুদ্ধের নীতি অনুসরণ করা হতো ‘ধ্রুপদী কায়দায়’। সেন্ট্রাল কমান্ড এবং ইউনিট কমান্ডাররাই জানতেন কে এবং কারা এই বাহিনীর সদস্য।
‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ সদস্যদের শুধু মাত্র ‘খুলনা জোড়না আওর ফায়ার গিরনা এবং রেকি অ্যামবুশ ও তোড়ফোড় কা কারবাইয়ের’ মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বিশেষ করে এই বাহিনীর কমান্ডারদের উচ্চতর সামরিক কলাকৌশল সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। যেমন, আনআর্ম কমব্যাট, অবস্টাকল ক্রসিং, একপ্লোসিভের বহুমুখি ও উচ্চতর ব্যবহার, ট্রেসার বুলেটের ব্যাবহার, স্নাইপিং, জেরোইং, আকাশ থেকে যুদ্ধ বিমান গুলি করে নামানোর পদ্ধতি, সাইল্যান্ট কিলিং সহ আরও গুরুত্বপূণ বিষয় ছিল এই প্রশিক্ষণের আওতায়। প্রাসঙ্গিক হওয়ায় শুধু এটুকুই উল্লেখ করলাম। আমার বিশ্বাস এই বাহিনীর ইতিহাস একদিন যথাযথভাবে লেখা হবে।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ সদস্যদের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়েছে। বিশেষ করে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদের’ সমর্থক কিছু সশস্ত্র গ্রুপ ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ প্রতি ভয়ানক বৈরী মনোভাবাপন্ন ছিল। ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ বেশ কিছু সদস্যকে স্বাধীনতার পরে এই বাহিনীর সদস্যরা হত্যা করে। আজও এরা সুযোগ পেলে ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকার করতে ওদের গায়ে যেন ফোস্কা পড়ে। অতএব, সব সময়ের জন্যে ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনী’কে প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ সম্মান ও সুযোগ সুবিধা দেয়ার উদ্যোগ শুরু হয়। তাঁর শাসনকালে ২০১৩ সালে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের বামপন্থি ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ ২৩৬৭ জনের একটি তালিকা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। ’৪৫ বছর পরে হলেও এই ঘটনাটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এক বছর সময়কালও অতিক্রম করতে পারলো না, নবনিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী জনাব মোজাম্মেল হক সাহেব নানা ছল চাতুরি করে এই ‘গেজেট’ বাতিল করলেন। এই অবৈধ বাতিল আদেশের বিরুদ্ধে ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ অন্যতম কমান্ডার ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য হাইকোর্টে রিট মামলা করেন। মহামান্য হাইকোর্ট সরকারের ওই বাতিল আদেশ বাতিল করে এক ঐতিহাসিক রায় দেন। এই মামলা দু’বছরের বেশি সময় ধরে চলেছিল।
সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলিয়েট ডিভিশনে লিভ পিটিশন দাখিল করেন। গত ৩ জানুয়ারি (২০১৭) মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলিয়েট ডিভিশনের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সরকারের দায়ের করা লিভ পিটিশন খারিজ করে দিয়েছেন। অতএব, হাইকোর্ট প্রদত্ত রায় পুনঃরায় বহাল হলো। এখন ইচ্ছে করলে সরকার এই রায়ের ‘রিভিউ’ চাইতে পারেন। ‘রিভিউ’ এই মামলার সর্বশেষ ধাপ।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো সরকারের অভ্যন্তরে বামপন্থি ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ বিরুদ্ধে বৈরি একটি লবি এখনো সক্রিয় রয়েছে। এই ‘লবি’ মুক্তিযুদ্ধকে তাদের একক সম্পত্তি বানাতে চায় এবং মুক্তিযুদ্ধে অন্য কারোর অবদান, বিশেষ করে বামপন্থিদের অবদান স্বীকার করতে চায় না।
সম্প্রতি দেশব্যাপী তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই বাছাই করার বড় ধরনের উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল বা ‘জামুকা’। এখন প্রশ্ন উঠেছে, সুপ্রিম কোর্টের রায় পাওয়ার পর গেজেটভুক্ত ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ ২৩৬৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে কি যাচাই বাছাইয়ের সম্মুখিন হতে হবে? অভিজ্ঞ মহল সাধারণ ধারণার ভিত্তিতে বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের রায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। এর ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকার কারো নেই। আর হাইকোর্ট তার রায়ে ২৩৬৭ জনের পাওনা, সম্মান, অধিকার এবং সুযোগ সুবিধা প্রদানের নির্দেশ যে ভাষায় দিয়েছেন তাতে তাদের নতুন করে যাচাই বাছাইয়ের সম্মুখিন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। জামুকা ভারতীয় তালিকা এবং লাল তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত তালিকা হিসেবে ঘোষণা করে যাচাই বাছাইয়ের আওতামুক্ত রেখেছে। এখন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনীর’ ২৩৬৭ জনের তালিকাকে চূড়ান্ত ঘোষণা করে যাচাই বাছাইয়ের আওতামুক্ত রাখতে হবে।
এই বিষয়টি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ পর্যালোচনা করছেন। অতিশীঘ্রই তাঁদের মতামত জানা যাবে। জানা গেলে তা দ্রুত সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেয়া হবে।
লেখক : সদস্য, সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটি
বিশেষ রচনা
সংবিধান নিয়ে সিপিবির ভাবনা
Login to comment..