রাজপথে লড়ছে বামপন্থিরা

আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
দম বন্ধ হওয়া এক বিষম পরিস্থিতির মধ্যে দিনাতিপাত করছে বাংলাদেশের মানুষ। একদিকে করোনা অতিমারীতে জীবন সংশয়। অন্যদিকে কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ায় জীবিকা সংকটাপন্ন। প্রতিদিন শত শত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। সরকারের ঘোষণায় প্রতিদিন যত মানুষ করোনায় মারা যায় তার চেয়ে বেশি মানুষ করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছে। জান বাঁচাতে অসহায় মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে সরকার মানুষের অসহায়ত্ব আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। উৎপাদন সংকোচনের ফলে সংকুচিত হচ্ছে কর্মসংস্থান। এ পরিস্থিতিতে কর্মহীন মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিয়ে গণবিরোধী সিদ্ধান্তে মানুষকে কর্মহীন করছে সরকার। প্রথম দফা করোনার আক্রমণে জনজীবন যখন বিপর্যস্ত তখন সরকারি সিদ্ধান্তে ২৫টি পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে বায়ান্ন হাজার শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বায়ান্ন হাজার পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। শ্রমিকদের উপর লোকসানের মিথ্যা অভিযোগ চাপিয়ে দিয়ে কারখানাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পাটকল বন্ধের পর একই অভিযোগে চিনিকল বন্ধের পাঁয়তারা চলছে। সরকারের অভিযোগ গত ৪৯ বছরে পাটকলগুলো ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। শ্রমিকরা উৎপাদন করে, উৎপাদিত পণ্য বিপনন করে না। ৪০/৫০ বছরের পুরোনো মেশিনে শ্রমিকের কম উৎপাদন ক্ষমতার জন্য শ্রমিকরা দায়ী নয়। যাদের বিপননের অদক্ষতার ও দুর্নীতির জন্য কারখানাসমূহ লোকসান দিয়েছে তাদের চাকরিতে বহাল রেখে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর পেছনের উদ্দেশ্য পাবলিকের সম্পত্তি লুটপাট। ব্যাংকে আমানত রাখা পাবলিকের টাকা দিয়ে পাবলিকের সম্পত্তি কিনে নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করা। রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোর বিশাল ভূ-সম্পত্তি দখলে নিয়ে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা তাদের প্রধান লক্ষ্য। নাহলে বারো’শ কোটি টাকায় কারখানাগুলো আধুনিকীকরণ না করে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দিয়ে শ্রমিকদের বিদায় করার কর্মসূচি কোনো জনবান্ধব, দেশপ্রেমিক সরকার গ্রহণ করতে পারে না। সরকার শ্রমিকদের উপর লোকসানের দায় চাপিয়ে দিয়ে ক্ষমতাসীন শ্রেণির লুটপাটকে আড়াল করতে চায়। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৭৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। দুদকের তথ্যে জানা গেছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী একাই এক বিলিয়ন ডলার বা ৮ হাজার ৫ শত কোটি টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করে দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে হিসাব করে দেখা গেছে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ থেকে নেয়া ১০ লাখ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা খেলাপী ঋণ। ব্যাংক ঋণের একটা বড় অংশ হুন্ডি, আন্ডার-ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। এ টাকা কাদের টাকা? ৩৫ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিকের কষ্টার্জিত ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার আর এক কোটি প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারেরই অংশ। যখন দেশের অর্থনীতি সংকুচিত তখন এই করোনাকালে ত্রাণ আর নগদ সহায়তা লুটপাটের মধ্য দিয়ে দেশে সাড়ে ৩ হাজার নতুন কোটিপতি সৃষ্টি হয়েছে। করোনাকালে মানুষের জীবন যখন বিপর্যস্ত তখন ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ধর্ষণের ভাইরাস করোনা ভাইরাসের চেয়ে মহাশক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর নয় মাসে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণ মামলার এক’শটির মধ্যে সাতানব্বইটির কোনো বিচার হয় না। সরকারি দলের যুব ও ছাত্র কর্মীদের দ্বারা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, সিলেটের এমসি কলেজের গৃহবধু ধর্ষণের ঘটনা সকল সীমানা অতিক্রম করে গেছে। সরকার ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর না হয়ে যে সকল ছাত্র-তরুণরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে লংমার্চ করছে তাদের উপর দলীয় গুণ্ডা ও পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছিল। চাল, ডাল, আলু, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সরকারের প্রশ্রয়ে ক্ষমতাসীন শ্রেণির ব্যবসায়িরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে এ করোনা বিপর্যয়কালে মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে দুর্বিষহ করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ ভোট ডাকাতির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে লুটেরা ব্যবসায়িদের সংসদে নিয়ে এসেছে। অর্থ, বাণিজ্য, খাদ্য মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী করেছে ব্যবসায়ীদের। ফলে তারা আম জনতার স্বার্থ না দেখে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার সুযোগ করে দিচ্ছে। করোনায় শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। অনলাইন পাঠদান সমাজের নিষ্ঠুর বৈষম্যকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। অনলাইন পাঠ গ্রহণের উপযুক্ত মোবাইল, ল্যাপটপ না থাকা এবং ইন্টারনেট সংযোগ ক্রয় করতে না পেরে গ্রাম-শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। করোনাসৃষ্ট নয়া বাস্তবতা শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্যকে প্রকটতর করেছে। এদিকে সরকারের কার্যকর কোনো নজর নেই। এ সরকারের আমলে গত দশ বছরে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছে ২৯৪ জন বাংলাদেশি। ভারতের চরম শত্রু পাকিস্তান বা চীন সীমান্তে এ ধরণের হত্যার কথা তারা কল্পনাও করতে পারে না। সরকারের আমলা-মন্ত্রীরা ভারতের কাছে কড়া প্রতিবাদ জানানোর পরিবর্তে এ বিষয়ে ভারতীয় বয়ান প্রচারে ব্যস্ত। জনগণের এ ধরণের নাভিশ্বাস ওঠা পরিস্থিতিতে সরকারে নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য জনগণ বামপন্থিদের স্বল্পপ্রয়াস ছাড়া তাদের পাশে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন, যাতে দিনের ভোট রাতে হয়েছিল সেই নির্বাচনে বিরোধী দল বানিয়ে দেয়া স্বৈরাচার এরশাদের দল জাতীয় পার্টি সংসদের অভ্যন্তরে গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়েছে। সরকারের স্তুতি করা ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পর সবচেয়ে বড় দল বিএনপি প্রধান বিরোধীদল হিসেবে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। রাজপথে তাদের কোনো পদচারণা নেই। তারা প্রেস ব্রিফিং সর্বস্ব দলে রুপান্তরিত হয়েছে। দলের প্রধান নেতাদের মুক্তির দাবি ছাড়া জনগণের নিত্যদিনের সংকট মোচনের কোনো দাবিতে জনগণ তাদের আওয়াজ শুনতে পায় না। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাত দেশ শাসন করেছে। তাদের অপশাসনে আজকে দেশের মানুষের এ হাল। দেশের আজকের যে উন্নতি তার কৃতিত্বের দাবিদার কৃষক-ক্ষেতমজুর, গার্মেন্ট শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিকরা। ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের রিজার্ভ সৃষ্টি তাদের কৃতিত্ব। কিন্তু তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবনের কোনো পরিবর্তন নেই। আজকে দেশের রাজনীতির মুখ্য এ ইস্যু ধনীদের দলগুলোর পক্ষে তোলা সম্ভব নয় এ কথা সকলের জানা। দেশ ও দেশের মানুষের এ সংকটকালে যত ক্ষুদ্র হোক না কেন বামপন্থিরা বাম গণতান্ত্রিক জোট ও অন্যান্য জোট নিয়ে রাজপথে আছে। সরকারি দলের গুণ্ডা ও পুলিশের নিপীড়ন উপেক্ষা করে রাজপথে লড়াই করছে। ২০১৯ সালের ১১ জানুয়ারির গণশুনানি থেকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের ভোট ডাকাতির নির্বাচন বাতিলের ডাক দিয়েছে বাম জোট। তদারকি সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশিশক্তিমুক্ত নির্বাচন করার প্রয়োজনে ভোট ডাকাতির অবৈধ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে লড়ছে বাম জোট। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখীন মিছিলে পুলিশ-দাঙ্গা পুলিশের আক্রমণে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অসংখ্য কর্মী আহত হয়েছিল। করোনাকালে সর্বজনের জন্য করোনা চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বামপন্থিরা করোনা ভাইরাসকে উপেক্ষা করে রাজপথে ছিল। প্রতিটি উপজেলায় নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র ও প্রতিটি জেলা করোনা পরীক্ষা কেন্দ্র চালু, বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষা নিশ্চিত করার দাবি নিয়ে বামপন্থিরা সোচ্চার ছিল। করোনাকালে আড়াই কোটি অতি দরিদ্র মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তার দাবি জানিয়েছিল বামপন্থিরা। সরকার পঞ্চাশ লাখ মানুষকে আড়াই হাজার করে টাকা দেয়ার ঘোষণা দিলেও কতজনের কাছে তা পৌঁছেছে তার নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। এসময়কালে ধানসহ কৃষি পণ্যের লাভজনক দামের জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষক সংগঠনসমূহসহ বামপন্থিরা পথসভা, হাটসভা করেছে। ইউএনও অফিসের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর দাবি জানিয়েছে। বামপন্থিরা ক্ষেতমজুরদের রেশন ব্যবস্থার আওতায় আনার জন্য সারাদেশে সভা-সমাবেশ করেছে। বন্ধ পাটকল খুলে দেয়া ও পাটকলসমূহ আধুনিকীকরণের দাবিতে বামপন্থিরা শ্রমিক ও জনগণকে সাথে নিয়ে হামলা-মামলা মোকাবেলা করে মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও, অবরোধ নানা জাতীয় কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে ছিল। খুলনায় অবেরোধ করতে গিয়ে মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি ছিলেন কমরেড এস এ রশীদ, মিজানুর রহমান বাবু, জনার্দন দত্ত নান্টু, মোজাম্মেল হকসহ ১৪ জন বামপন্থি নেতা-কর্মি। নারীর ওপর ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ, সহিংসতার বিরুদ্ধে লংমার্চ করতে গিয়ে ফেনীতে পুলিশ ও আওয়ামী গুন্ডাদের সশস্ত্র আক্রমণের শিকার হয়েছে বামপন্থি ছাত্র-যুব-সাংস্কৃতিক কর্মীরা। দেশের যেখানে অন্যায়-অবিচার সেখানেই নির্যাতন-নিপীড়ন, হামলা-মামলা উপেক্ষা করে বামপন্থিরা বুকচিতিয়ে প্রতিবাদ করছে। রাজপথে লড়ছে। রাজপথের লড়াই চলবে। ভোট ডাকাত ফ্যাসিস্ট সরকারকে পরাজিত করতে হলে রাজপথের এ লড়াইকে আরো বর্ধিত ও আরো সম্প্রসারিত করে রাজপথের দখল নিতে হবে। এটাই হচ্ছে বামপন্থি এখনকার কর্তব্য।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..