গণতন্ত্র রক্ষায় বাম-প্রগতিশীলদের ঐক্যের বিকল্প নাই
ডা. সাজেদুল হক রুবেল
‘বাংলাদেশ যেন পথ হারিয়ে অদ্ভুত এক মোড়ে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে’। আগস্ট অভ্যুত্থানে রক্তাক্ত পরিক্রমা পেরিয়ে এইটুকু প্রত্যাশা ছিল- ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র এর খপ্পর থেকে গণতন্ত্রায়নের পথে বাংলাদেশের পথচলা আবারো শুরু হলো, বাংলাদেশ মানুষের বাসযোগ্য হয়ে উঠবে, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির যাঁতাকল থেকে মানুষের জীবনে স্বস্তি আসবে, খুন-আহাজারি, ছিনতাই-ডাকাতি, ধর্ষণ-নিপীড়নের যুগের সমাপ্ত ঘটবে। কিন্তু- ৮ মাস পেরিয়ে, আজও দেখা যায় গণতান্ত্রিক রুপান্তর এখনও “দিল্লি দূরস্ত হ্যায়”। ‘আইনের শাসন ‘এর বদলে মবের শাসনে বাংলাদেশ।
৬৯,৭১ কিংবা ৯০-এ জনগণ বিজয় অর্জন করেও ব্যর্থ হয়েছে একটি গণতান্ত্রিক, আইনের শাসনে চলা বাংলাদেশ বিনির্মাণে। ২০২৫-এর মার্চে এসে বাংলাদেশ ক্রান্তিপর্ব পেরোতে পারবে কিনা তা নিয়েই জনমনে প্রশ্ন।
স্বৈরাচারী হাসিনাকে পরাস্ত করা গেছে, কিন্তু গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ক্রমশ জটিলতর, কঠিনতর হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র বদল হবে না, তা জানাই ছিল। কারণ শ্রেণি সংগ্রামের প্রশ্নে সংগঠিত, সচেতন কোন সমাজ বিপ্লব বাংলাদেশে সংগঠিত হয় নাই। ২০২৪-এ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। এখানে শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনুপস্থিত ছিল তাই নয়, রাষ্ট্র বা সমাজ বিপ্লবের এজেন্ডা কিংবা রাজনৈতিক বীক্ষাও ছিল না। তাই চরিত্রের বদলে, বদলেছে শুধু রাষ্ট্রের পোষাক। কিন্তু ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ পাবার সম্ভাবনা তো সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু দেশ কেন সেই লক্ষ্যে বিগত ৮ মাসে অগ্রসর হতে পারলো না?
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণে এই মুহূর্তে সব চেয়ে বড় বাধা হয়ে দাড়িয়েছে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজের ধারায় বিক্ষিপ্ততা। নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূসের দক্ষতার সুনাম দেশে-বিদেশে রয়েছে, তিনি হয়ত নিজেই তার সুনামের প্রতি অবিচার করছেন। পেশাদারিত্বের সাথে মোহমুক্ত হয়ে, নিরপেক্ষতা রক্ষা করেই তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রুপান্তর ঘটবে এমনটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করেন। তবে গত ৮ মাসের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- জনরঞ্জনবাদিতাই যেন তার কাজকর্মের দিকমার্গ।
জাতীয় নির্বাচন, সংষ্কার ও বিচার এই তিনটি অতি জরুরি করণীয়কে একটির সাথে আরেকটির বৈরি সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টায় অন্তর্বর্তী সরকার এবং তাদের সমর্থক আন্দোলনকারীদের একটি অংশ বেশ তৎপর। একটি অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের সংষ্কার ও সংবিধানেরও কয়েকটি ধারার সংশোধনই যথেষ্ট। বিশেষত: দুইটি ধারা ৭(ক), ৭(খ)। অবশ্য ২০২৪-এর ১৭ ডিসেম্বর, এই ধারাগুলো হাইকোর্ট বাতিল করেছে। এখন প্রয়োজন ন্যূনতম জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সরকারের অধ্যাদেশ গ্রহণ। যা পরবর্তীতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হবে। পুরো রাষ্ট্রের সংষ্কার শুধু ডিক্রি জারি করে সম্ভব নয়। জনগনের অব্যাহত গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব হয়ে উঠবে না।
বিগত স্বৈরাচারী সরকারের হত্যাকান্ড, দুর্নীতি-লুটপাটের বিচারও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অধীনে অগ্রসর হবে। ‘আগে বিচার পরে নির্বাচন’; ‘আগে সংষ্কার পরে নির্বাচন’ এই ধরনের বক্তব্য সরকারের সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। স্থানীয় নির্বাচন আগে নাকি জাতীয় নির্বাচন আগে এমন প্রশ্নে বিতর্ক উস্কে দেওয়াও সন্দেহজনক। গণপরিষদ নির্বাচন নাকি জাতীয় সংসদ নির্বাচন এসব বিতর্কে জাতিকে বিভক্ত করা সুদূরপ্রসারী কোন অশুভ উদ্দেশ্যেকেই ইঙ্গিত করে।
ইতিমধ্যে ড. ইউনূসের মেটিকুলাস প্ল্যানের তত্ত্ব, মাস্টার মাইন্ড আবিষ্কার, রিসেট বাটন পুশ, আন্দোলন-অভ্যুত্থানের চেতনাকে ছুরিকাহত করেছে। আরো একটি বিতর্কিত ইস্যু হচ্ছে- নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা। অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিক উৎসাহ, উদ্দীপনা পৃষ্ঠপোষকতায় ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’ নামের নতুন এক রাজনৈতিক দল কিছুদিন পূর্বে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই নতুন দলের শুধু নতুন নেতাই আছে। নেই নতুন রাজনৈতিক ইশতেহার, নেই কোন ঘোষণাপত্র কিংবা গঠনতন্ত্র। কোটি টাকা ব্যয় করছে, অথচ অর্থের উৎস অপ্রকাশিত। নিজেদের ডান কিংবা বাম নয় বলছেন- মধ্যপন্থী। মধ্যপন্থা আসলে কি সেটাও তাঁরা বোঝাতে বা বুঝতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত জনগণ এটাকে কিংস পার্টিই ধরে নিচ্ছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির বক্তব্য ও কর্মকান্ড ২৪-এর ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানকে ছিনতাইয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে দলীয়করণ করেছে, তেমনি ২৪-এর অভ্যুত্থানকে জাতীয় নাগরিক পার্টির নিজস্বকরণের চেষ্টা চলছে। বিএনপি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ ডান বাম যে দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের দাবি করছেন তারাই তাদের খারিজ করে গত সরকারের দোসর, ভারতের দোসর বলে কটুক্তি করছেন।
সরকার ও জাতীয় নাগরিক পার্টি উভয়ই জামায়াত-শিবিরের প্রতি অতিমিত্রতা পোষণ করছে। জামায়াত-শিবিরও তাদের সমর্থন দিয়ে চলেছে।
এ সময়কালে দেশে দুইটা নেতিবাচক বিষয় জনগণের দুর্ভাবনা কে বাড়িয়ে দিচ্ছে। একটি হলো- ধর্মীয় উগ্রবাদীদের উত্থান, আরেকটি হলো- দেশজুড়ে চলা নারী নিপীড়ন, নারী ধর্ষণের ঘটনা। এক্ষেত্রেও সরকারের ভূমিকা জনমনে অসন্তোষ তৈরি করতে বাধ্য করছে। দেশব্যাপী নারী নিপীড়ন-ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন তৈরি হয়েছে। সরকার একদিকে পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের নির্যাতন করছে, মামলা দিচ্ছে। অপরদিকে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা লাকী আক্তারকে মব সন্ত্রাসের টার্গেট বানাতে উদাসীনভাবে সহযোগিতা করছে।
মবের শাসন নয়! জনগণ চায় গণতান্ত্রিক দেশ, আইনের সঠিক শাসন। হাত-পা ছেড়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপর অন্ধ ভরসার কোন সুযোগ নেই। গণতন্ত্রের লড়াই অব্যাহত আছে, প্রয়োজন আরো ঐক্যবদ্ধ জোর লড়াই। গ্রাম-শহরের মেহনতি জনতাকেই অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় পর্বে সামনের কাতারে আসতে হবে। বামপন্থীদের শক্তির উত্থান আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। নচেৎ, মিশর থেকে ইউক্রেনের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান যেভাবে বেহাত হয়েছে, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম হবে না। অতএব কমরেড আসুন- দৃঢ় কমিউনিস্ট ঐক্য গড়ে তুলি।
প্রথম পাতা
তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার ব্যবসায়ীদের তোষণ করছে
আশা-নিরাশার বর্ষবরণ
‘রঙ্গ’
চাল-আটাসহ বাড়তি দাম সবজির
রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের একযুগ, শ্রমিকের জীবন...
শ্রমিকনেতা আবু তাহেরের মুক্তি দাবি সিপিবির
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করে বিনিয়োগকারীদের লাগাম টানার চেষ্টা করছে সরকার
নির্বাচন নিয়ে বিলম্ব দেশকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে
লেনিনের একটি দিন
সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই এখনও শেষ হয়নি
সরকারের বোরো ধান সংগ্রহ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করবে
Login to comment..