বাংলাদেশের হাওর, নদী ও বিল : সমস্যা ও প্রতিকার

মো. খালেকুজ্জামান

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
[গত সংখ্যায় প্রকাশের পর] বাংলাদেশের সব নদ-নদীই গৃহস্থালি এবং নানা ধরনের শিল্প বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে শহর অঞ্চলের প্রতিটি নদীতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষেপ করা হয়ে থাকে। ব্যাপক দূষণের ফলে নদীগুলির রাসায়নিক এবং জৈবিক গুণাবলী দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত প্রায় সমস্ত সূচকের স্বাস্থ্যকর মাত্রার চেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির নির্ধারিত পরিবেশগত কর্মদক্ষতা সূচকে পৃথিবীর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হলো ১৭৭তম। পরিবেশগত কর্মদক্ষতা সূচকে পানির গুণাবলি, বায়ুদূষণ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পয়োঃনিষ্কাশন ও পানীয় জলের ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য পরিশোধন ও ব্যবস্থাপনা, পরিবেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিষাক্ত ধাতবের উপস্থিতি, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গৃহীত পরিকল্পনা, বনাঞ্চল রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করার মতো বিষয়গুলির ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ, বাংলাদেশের নদ-নদী, হাওর, বিল, পুকুর, জলাশয়ের ভৌত-রাসায়নিক-জৈবিক অবস্থার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্রই এই সূচকের মাধ্যমে পরিস্ফূট হয়। অন্যদিকে, জাতিসংঘের স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পৃথিবীর ১৯৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হলো ১০৭তম। এখানে উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘের ১৭টি লক্ষ্যমালার মধ্যে ১১টি পরিবেশের বিভিন্ন সুচকের সাথে সম্পর্কিত। উপযুক্ত বিশ্লেষণ থেকে এটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল, বিল, হাওরের পরিবেশগত অবস্থা খুবই নাজুক এবং অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের নদ-নদী, হাওর, বিল, পুকুর, জলাশয়, জলাবন, এবং জলারণ্য রক্ষা করার উপায় কী? প্রথমত, আমাদের জীবনে এবং বাংলাদেশের ব-দ্বীপ ও প্লাবনভূমির ভৌতিক গঠনে নদ-নদী, হাওর, বিলসহ অন্যান্য জলাভূমির ভূমিকা সম্পর্কে আরো সুস্পষ্ট ধারণা সাধারণ জনগণ এবং নীতি-নির্ধারকদের আরো বেশি হৃদয়ঙ্গম করার লক্ষ্যে সর্বস্তরের শিক্ষাক্রমে পরিবেশ বিজ্ঞান অধিকহারে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি এবং এইসব বিষয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বৃদ্ধি করা দরকার। দ্বিতীয়ত, নদী-হাওর, বিলে ঘটমান প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলো সম্বন্ধে সম্মক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনায় এসবের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট অক্ষুণ্ন রাখার নীতিমালা গ্রহণ করা এবং সেইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। তৃতীয়ত, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখার অভিপ্রায়ে প্লাবনভূমির সাথে নদ-নদীর সংযোগ নিশ্চিত করা। চতুর্থত, নদী এবং হাওর ব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যেই নির্মিত কঠিন অবকাঠামো এবং বেষ্টনী পদ্ধতির নানাবিধ উপাদানের (নদীর উপর নির্মিত বাঁধ, স্পার, বন্যানিরোধ বাঁধ, ফসল রক্ষা বাঁধ, ইত্যাদি) প্রয়াজনীয়তা এবং কার্যকারিতার ওপর পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষা করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী এইসব অবকাঠামোতে সংশোধনীমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে হাওর অঞ্চলে মাটি উঁচু করে যেসব রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে সেসব রাস্তায় হাইড্রোলজিক গবেষণালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে পর্যাপ্ত সেতু এবং কালভার্ট সংযোজন করা এবং প্রয়োজনে হাওরভেদী নতুন যে কোন রাস্তা পিলারের ওপর নির্মাণ করা। ফসল রক্ষা বাঁধগুলির কার্যকারিতা যাচাই করা এবং প্রয়োজনে এইগুলি অপসারণ করে নদীর সাথে প্লাবনভূমির যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করা যেতে পারে। লোকজ জ্ঞানের আলোকে অষ্টমাসী বাঁধ নির্মাণ করার সম্ভাব্যতা যাচাই করাও জরুরি। পঞ্চমত, প্লাবনভূমিতে নতুন বাড়িঘর কিংবা অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি প্রদানের সময় যেন পিলারের ওপর নির্মাণ করা হয় তা নিশ্চিত করা জরুরি। নদীর পাড়ে অথবা প্লাবনপ্রবণ এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণের সময় গত কয়েক দশকের বন্যার পানির সর্বোচ্চ উচ্চতার চেয়ে বেশি উচ্চতার ভিত্তির ওপর যেন নির্মাণ করা হয় সেই বিষয়ে আইন করাও জরুরি। হাওর অঞ্চল যেহেতু বৃহত্তর অর্থে মেঘনা নদীর ঊর্ধ্বাংশের অববাহিকায় অবস্থিত সেহেতু ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থিত অববাহিকার উজানের অংশে ভূমিরূপে পরিবর্তন আনার ফলে সৃষ্ট অতিরিক্ত পলি এবং পানি এসে ভাটিতে অবস্থিত হাওরের বন্যা পরিস্থিত আরো জটিল করে তুলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, সময়কাল এবং স্থায়িত্বকালেও বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, ১৯০১ থেকে ১৯৫৮ সালে মেঘালয়ের বিভিন্ন অংশে এপ্রিল-মে মাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হতো। বিপরীতে, ১৯৫৯ থেকে ২০১৭ সালে বৃষ্টির পরিমাণ এপ্রিলে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অল্প সময়ের মধ্যে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সতর্কীকরণের ক্ষেত্রে উজানের অববাহিকা অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের তথ্য-উপাত্ত অগ্রিম পাওয়া খুব জরুরি। সেইসাথে উজানের অববাহিকা অঞ্চলে বনাঞ্চল নিধন কিংবা খনিজ দ্রব্য আহরণের কারণে বেশি পলি বৃষ্টির পানির সাথে এসে হাওর অঞ্চলের নদী-নালা, খাল, বিল, ফসলি জমি ভরাট করে দিচ্ছে। কয়লা এবং ভারী ধাতুর খনি থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থও হাওর অঞ্চলের নদীতে আসছে, যার ফলে পানির গুণাবলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং বন্যার সময় মাছে মড়ক দেখা দিচ্ছে। বন্যার ক্ষতি নিরসন করার জন্য এবং বন্যা ব্যবস্থাপনা আরো কার্যকর করার জন্য পুরো মেঘনা অববাহিকার জন্য ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমন্বিত পানি-পলি ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা জরুরি। মেঘনা অববাহিকা শুধু নয়, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার সমস্ত অভিন্ন নদীর জন্যই সব অংশীজন এবং রাষ্ট্রকে নিয়ে এমন চুক্তি হওয়া জরুরি। জাতিসংঘের পানিপ্রবাহ আইন (১৯৯৭) এর আলোকে এরকম চুক্তি স্বাক্ষরিত এবং বাস্তবায়িত হলে প্রতিটি অববাহিকাতে অবস্থিত উজান এবং ভাটির দেশের স্বার্থ সমানভাবে রক্ষা পাবে। বাংলাদেশের উচিত এই আইনটি অনুস্বাক্ষর করে অববাহিকার অন্যান্য দেশকেও এই আইন অনুস্বাক্ষর করার জন্য অনুপ্রাণিত করা। বাংলাদেশের অস্তিত্ব এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে নদ-নদী, হাওর, বিলের স্বাভাবিক প্রবাহমানতা এবং গুণগত মান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তাই সমস্ত কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতেই নদী-হাওর-বিলের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে স্থান দেওয়া জরুরি। বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে হাওর অঞ্চল, উপকূলীয় অঞ্চল, নদীভাঙন রোধ, নদীর চরের জনগণের সুরক্ষা, চলন বিল রক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ২০১২ সালে গৃহীত হাওর মাস্টার প্ল্যানেও হাওর ও সেই অঞ্চলের নদীরক্ষা এবং বন্যা প্রশমনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের স্থায়িত্বশীল লক্ষ্যমাত্রার আলোকেও নদী, হাওর, বিল, এবং ঐসব অঞ্চলে বসবাসরত জনগণের দারিদ্র্যমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সাশ্রয়ী এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, পানীয় জল এবং পয়োনিষ্কাশনের উন্নতি সাধন, অসমতা দূরীকরণ, পরিবেশের বিভিন্ন দিকের উন্নতি করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বিগত কয়েক দশকে গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার যথেষ্ট কমেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, এইসব উন্নয়নের ফলে ক্রমাগতভাবেই পরিবেশ-প্রতিবেশ-জীববৈচিত্র্য এবং জনস্বাস্থ্যের অবক্ষয় হয়েছে। দেশের সমস্ত নদী-খাল-বিল দখল ও দূষণের শিকার হয়েছে। নদী-নালা-খাল-বিল-পুকুর-জলাধার ভরাট হয়ে যাচ্ছে এবং সেগুলো ময়লা ও বর্জ্য নিষ্কাশনের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বায়ুদূষণের মাত্রা ক্রমাগত সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। হাওর অঞ্চল শুধু নয়, সমস্ত বাংলাদেশের পরিবেশের অবক্ষয় পৃথিবীর মধ্যে নিকৃষ্টতম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মানুষের কর্মসময় এবং আয়ুষ্কালও আশংকাজনকহারে কমে যাচ্ছে। এই রকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এর মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের রূপকল্প যদিও তুলে ধরা হয়েছে কিন্তু সেখানে পরিবেশবান্ধব স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গী ফুটে ওঠেনি। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আবারো অকার্যকর এবং পুরানো অবৈজ্ঞানিক উন্নয়ন দর্শনের ওপর ভিত্তি করে পানি ব্যবস্থাপনা এবং হাওর ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, বেষ্টনী পদ্ধতির ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমির উচ্চতা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে এবং স্থায়ী জলাবদ্ধতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার সেই একই পদ্ধতি আরো বেশি করে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তাছাড়াও আন্তঃনদীসমূহের পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে গঙ্গা ব্যারেজ স্থাপনের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। ফারাক্কা ব্যারেজের কার্যকারিতা বিষয়ে খোদ ভারতেই যেখানে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সেখানে গঙ্গা ব্যারেজের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে দুটি ব্যারেজের ঋণাত্মক অভিঘাতের মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহমানতা নিশ্চিত করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বাড়তি বন্যার পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ না নিয়ে বড় বড় নদীগুলোকে সংকুচিত করে সরু চ্যানেলে পরিণত করার নানা ধরনের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। চীন সরকারের সহায়তায় তিস্তা নদী সরু করার প্রকল্প নেওয়ার কথা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের উপযোগী করে যমুনা-মেঘনা নদী সরু খালের আকারে খনন করার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। বন্যা প্রশমন, শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন এবং ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে হাওর অঞ্চলের সার্বিকভাবে পরিবেশ সুরক্ষা এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত সুপারিশমালা উপস্থাপন করা হলো- ১. রাস্তা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ যেন হাওরের মূল বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে এবং হাওরের জলজ পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং ভূ-উপরিস্থ জলপ্রবাহে কোনো বাধা সৃষ্টি না করে সেটি সমস্ত অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে নিশ্চিত করতে হবে। ২. বর্ষাকালে হাওরের জলাভূমিতে মাছের অবাধ যাতায়াত সংরক্ষণ করেই শুধু আবুরা সড়ক নির্মাণ করতে হবে। ৩. বন্যা-নিরোধ বাঁধের ছাড়পত্র পরিবেশ অভিঘাত মূল্যায়নপূর্বক, অংশীজনদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্মাণকাজ শুরুর আগেই প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়। ৪. ফসল রক্ষা বাঁধ যেন কোনোভাবেই ফসল ও জানমাল রক্ষার জন্য মিথ্যা আশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ৫. রাস্তা নির্মাণের স্থান নির্ধারণ যেন ১৯৯৯ সালের জাতীয় পানি রক্ষা বিধিমালার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ৬. হাওরের জলাবদ্ধতা ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য চিন্তায় রেখেই হাওর অঞ্চলে বিদ্যমান ১০০৫টি সেতু এবং ২৭০৪টি কালভার্ট স্থানের সঠিকতা পুনরায় বিবেচনা করা প্রয়োজন। ৭. ভূমি-ব্যবহার পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট অতরিক্ত ভূ-উপরিস্থ প্রবাহ ধারণের জন্য নদীর ধারণক্ষমতা বাড়াতে হলে পরিকল্পিতভাবে জরিপের মাধ্যমে উজান থেকে ভাটিতে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে গভীরতা/প্রসস্থতা বাড়াতে হবে। ৮. গত ১০০ বছরের গড় মাসিক বৃষ্টিপাতের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রতীয়মান হয়েছে যে, এপ্রিল মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে, যা কি না আইপিসিসি রিপোর্টের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এপ্রিলের প্রথম দিকে বন্যা আস্তে আস্তে নিয়মিত বাৎসরিক বন্যাতে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই ভবিষ্যতের ফসলের ধরনেও এ বিষয়টি আমলে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। ৯. সমস্ত হাওরের পানি প্রবাহ ভৈরব ব্রিজের নিচ দিয়ে মেঘনা নদীর মাধ্যমে সাগরে পতিত হয়; তাই এ স্থানটিতেই নদীর প্রস্থচ্ছেদ উজানের যে কোনো অংশের তুলনায় বেশি হওয়া কাম্য, কিন্তু বাস্তবতঃ এই স্থানে নদীর প্রস্থচ্ছেদ প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়ায় উজানের প্রবাহ সময়মতো সরতে না পারায় বন্যার স্থায়িত্বকাল বেড়ে গিয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এ বিষয়টি মাঠ পর্যায়ের সার্ভে এবং গবেষণার মাধ্যমে যাচাই করতে হবে। ১০. ভৈরবের উজান থেকে মেঘনা নদীর পানি প্রবাহ বিকল্প খাল বা চ্যানেল কেটে ভৈরব ব্রিজের ভাটিতে ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করা জরুরি। ১১. বর্তমানে হাওরের ১৮২৯ কি.মি. জলপথের ৫৫% অকার্যকর হয়েছে। নদীর তলদেশে পলিথিন স্তরের জমে থাকার নিরিখে নিয়মিত ড্রেজিং করে নৌ-চলাচল চালু রাখা জরুরি। ১২. নৌ-চলাচল হাওরের একটি অচ্ছেদ্য অংশ এবং এই মাধ্যমকেই উন্নতর করা জরুরি। ১৩. ড্রেজিংকৃত মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা সাপেক্ষে এর ব্যবহার নির্ধারণ করতে হবে। ১৪. ড্রেজিংকৃত পলিমাটি/সিমেন্ট, ইট ইত্যাদি রাস্তাঘাট নির্মাণ, গ্রামের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য শিল্পের কাঁচামাল হতে পারে কি না তা নির্ধারণ করা জরুরি। ১৫. এসডিজি (১-৩, ৮-১১) আলোকে হাওর অঞ্চলকে পিছিয়ে থাকা অঞ্চল ঘোষণা করে দারিদ্র্য ক্ষুধা দূরীকরণ এবং কর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। ১৬. হাওরের ২৮.৫% বেকার জনগোষ্ঠীর (৫৭ লক্ষ) জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলে প্রতি পরিবারে একজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ১৭. চাকরির নিশ্চয়তাসহ হাওরের প্রতিটি জেলায় স্বাস্থ্য, নার্সিং এবং পুষ্টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান করার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। ১৮. পল্লি-শহরের মাধ্যমে সমন্বিত পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন, বিনোদন, খেলার মাঠের সংকট দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়। ১৯. হাওরের ভূমি-প্রকৃতির কারণে জাতীয় গ্রিডের বাইরেও সৌর এবং বায়ুচালিত জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করার সম্ভাব্যতা যাচাই করা জরুরি। ২০. হাওরের অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং সংবেদনশীল পরিবেশ-প্রতিবেশ বিষয়ে আরো গবেষণা, শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। ২১. হাওর অঞ্চলের সমস্যা নিরূপন এবং সমাধান নির্ণয়ের লক্ষ্যে একটি বিশেষ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা জরুরি। ২২. হাওরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-পরিবেশ-প্রতিবেশ-শিল্প-সাহিত্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে একটি জাদুঘর স্থাপন করা দরকার। ২৩. হাওর মাস্টার প্ল্যান অনুযারী, যা কি না পরবর্তীতে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, প্রায় ৭০% বাজেটই পানি উন্নয়ন এবং যাতায়াতের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। অর্থাৎ রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ইত্যাদিতে জোর দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করবে অববাহিকা ভিত্তিক সমন্বিত পানি-পলি ব্যবস্থাপনার ওপর। যা এখনো অর্জিত হয়নি। সেই লক্ষ্যে সমস্ত মেঘনা অববাহিকা-কেন্দ্রিক সার্বিক নীতিমালা গ্রহণ করার লক্ষ্যে যৌথ নদী কমিশনের কাজ করা জরুরি। ২৪. সাম্প্রতিককালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত কুশিয়ারা পানি বণ্টন চুক্তি যেহেতু একটি নদীর খণ্ডিত অংশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত সেটি সমন্বিত পানি-পলি ব্যবস্থাপনার সাথে সাংঘর্ষিক, তাই ভবিষ্যতে এই চুক্তি বাতিল করা বাঞ্ছনীয়। ২৫. এসডিজির আলোকে, পরিবেশ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প-নগরায়ন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং মৎস সম্পদের ওপর জোর দেওয়া বেশি জরুরি। ২৬. পানি সম্পদের গুণগত মান মনিটরিং করার কোনো প্রকল্প কোথাও অন্তর্ভুক্ত নেই, যা করা খুব জরুরি। লেখক : বৈশ্বিক সমন্বয়ক, বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন); অধ্যাপক, লক হ্যাভেন ইউনিভার্সিটি, পেনসিল্ভনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..