নির্বাচনমুখী দেশ, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ হবে তো?
অনেক প্রশ্ন ও অনিশ্চয়তা থাকলেও দেশে নির্বাচনমুখী একটি আবহ তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং তার পারিষদরা বারবার বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনও সেই প্রস্তুতি শুরু করেছে। ডিসেম্বরের প্রথম দিকেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে আভাস দেওয়া হচ্ছে। এবার জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে ‘অপ্রাসঙ্গিকভাবে’ একটি গণভোট জুড়ে দেওয়া হয়েছে- যার লক্ষ্য হলো অনেক রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাখ্যাত ‘জুলাই সনদ’ অনুমোদন ও বাস্তবায়নের পথ তৈরি করা। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চাপিয়ে দেওয়া এই ‘হ্যা’ ‘না’ ভোট নিয়ে মানুষের আগ্রহ নেই। তারা চায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে তিনটি জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেনি। এমনকি কারা নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন আর কারা পারবেন না তা-ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাদের অমতে কেউ নির্বাচনে দাঁড়ালে তাকে নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রে উত্তরণের নতুন আশাবাদ তৈরি হয়েছে। দেশকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পথে নিয়ে যেতে প্রথম পদক্ষেপ হলো একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে যোগ্য প্রত্যেক নাগরিকের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার অধিকার থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন সংস্কারের নামে নির্বাচনী বিধিবিধানে এমন সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যার ফলে তফসিল ঘোষণার আগেই দেশের বেশিরভাগ যোগ্য নাগরিক নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার দৌড় থেকে ছিটকে পড়েছেন।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে আগামী নির্বাচনে প্রার্থীর জামানতের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে- যা দেশের বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে না। ফলে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও নির্ধারিত আয়ের কোটি কোটি মানুষ শুধুমাত্র টাকা না থাকায় নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না। এর অর্থ হলো–বৈধ আয়ের ওপর নির্ভরশীল সৎ মানুষের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে গেল। অর্থাৎ ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ দূরের কথা, খেলা শুরুর আগেই তাদের ছিটকে ফেলা হলো।
এমনিতেই দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতি এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, টাকাওয়ালা ছাড়া সেখানে বিজয়ী হওয়া প্রায় অসম্ভব। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় সেই সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটবে। নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্য হবে সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক মানুষ যেন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারেন সেই পথ তৈরি করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারের নামে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে ধনীদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ বাড়িয়ে সংসদকে কোটিপতিদের ক্লাবে রূপান্তর করবে।
এ অবস্থায় বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের প্রার্থী হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে জামানতের হার কমিয়ে ৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে। সেইসঙ্গে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধিসহ আরপিওর অগণতান্ত্রিক ধারা বাতিল করারও দাবি জানানো হয়েছে।
কালো টাকা, পেশীশক্তি, সাম্প্রদায়িক ও প্রশাসনিক কারসাজিমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করতে না পারলে দেশে অর্থবহ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।
Login to comment..








প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন