প্রকৃতি অন্বেষণ

মুহাম্মদ হাসান ইমাম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

ভূমিকা প্রকৃতিবিষয়ক আলোচনার শুরুতে জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তির কিছু কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘তোমার সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক কী (নদী, বৃক্ষ, পাখি, মাছ, ভূগর্ভস্থ খনিজসম্পদ, জলপ্রপাত ও পুকুর)? আমাদের অনেকেই এই সম্পর্ক সম্পর্কে সজাগ নয়। আমরা বৃক্ষের দিকে তাকাই না, যদিও তাকাই তবে তা বৃক্ষকে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সেকথা মনে করে। এর ছায়ায় বসার কথা ভাবি, কাঠ পাওয়ার জন্য একে কেটে ফেলার কথা ভাবি। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা বৃক্ষের দিকে তাকাই উপযোগবাদী উদ্দেশ্যে। আমরা নিজের স্বার্থ বাদ দিয়ে বৃক্ষের দিকে দৃষ্টিপাত করি না। পৃথিবী এবং পৃথিবীর যাবতীয় উৎপন্ন আমরা একইভাবে প্রত্যক্ষ করি। পৃথিবীর জন্য কোনো ভালোবাসা নয়, পৃথিবীকে কীভাবে ব্যবহার করা যাবে সেটাই আমাদের লক্ষ্য থাকে। যদি কেউ পৃথিবীকে ভালোবাসতো তাহলে তার উৎপন্ন ব্যবহারের পেছনে সাশ্রয়ী মনোভাব থাকতো। অর্থাৎ পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রকৃতার্থে বুঝতে পারলে আমরা তার উৎপন্ন ব্যবহারে আরো সচেতন হতাম। প্রকৃতির সঙ্গে একজনের সম্পর্ক বোঝা সত্যই কঠিন যেমন কঠিন প্রতিবেশী, স্ত্রী, সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক অনুধাবন করা। আমরা কদাচিৎ এ-ব্যাপারে চিন্তা করি অথবা শান্ত হয়ে বসে আকাশের তারা, চাঁদ বা বৃক্ষরাজি প্রত্যক্ষ করি। আমরা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বড় বেশি ব্যস্ত। আসলে এ-ধরনের ব্যস্ততা আমাদের নিজের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। যারা প্রকৃতি-পূজা করে তারাও আত্মপলায়নের ফাঁদে পড়ে। আমরা সবসময় প্রকৃতিকে ব্যবহার করছি নিজেকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য অথবা প্রকৃতির কাছে থেকে উপযোগ আদায়ের জন্য। আমরা কখনো পৃথিবীকে অথবা পৃথিবীর সম্পদকে ভালোবাসার জন্য সুস্থির নই। আমরা ফসলের মাঠকে অনুধাবন করি না, যা আমাদের খাবার জোগায় অথবা আচ্ছাদন দেয়। আমরা নিজের হাতে কর্ষণ করি না কারণ নিজের হাতে কাজ করতে লজ্জা পাই। নিজের হাত ব্যবহার করলে একটা অসাধারণ ব্যাপার ঘটতো; কিন্তু বাস্তবে নিম্নবর্গের লোকেরা কৃষিকাজ করে। আমরা উচ্চশ্রেণির লোকেরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এ-কাজে নিয়োজিত হই না। সুতরাং প্রকৃতির সঙ্গে আমরা সম্পর্ক হারিয়ে ফেলি।’ ‘ন্যাচার’ শব্দটি পুরনো ফরাসি শব্দ থেকে এলেও ল্যাটিন ভাষায় ‘ন্যাচার’ বলতে মূল গুণাগুণ বা অন্তর্নিহিত গুণ বোঝাতো। আবার গ্রিক ভাষা থেকে ফিসিস শব্দটি অনূদিত হয়ে ল্যাটিন ভাষায় আসে। গ্রিক ফিসিস বলতে অবশ্য উদ্ভিদ, প্রাণী ও সকল কিছু বোঝাতো যা নিজের থেকে জন্ম নেয়। শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে প্রকৃতি বর্তমান অর্থ লাভ করে। বৃহত্তর অর্থে প্রকৃতি হলো প্রাকৃতিক, ভৌত, বস্তুগত বিশ্ব। তবে আজকের দিনে প্রকৃতি বলতে বোঝায় ভূতাত্ত্বিক জগৎ ও বন্যজীবন (wilderness)। প্রকৃতির সংজ্ঞায়নে কেউ কেউ প্রাকৃতিক পৃথিবী এবং এর ওপর নির্ভরশীল মানুষ ও অন্যান্য বস্তুকে বুঝিয়েছেন। বৃক্ষ, বন, পাখি, পশু-প্রাণী প্রকৃতির অঙ্গীভূত। প্রকৃতি অর্থনীতি, সমাজ ও আমাদের সার্বিক অস্তিত্বকে ধারণ করে। আমরা প্রকৃতিকে মূল্য দিই, কারণ সে আমাদের জীবনধারণ ও জীবনের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি সম্ভব করেছে। মানবীয় বৈশিষ্ট্যের অনেক কিছুই অন্যান্য স্তন্যপায়ী জীবের মধ্যে দেখা যায়। আমরা সবাই জীবতাত্ত্বিকভাবে শরীরসমৃদ্ধ ও প্রতিবেশতাত্ত্বিকভাবে আবদ্ধ। আমরা প্রশ্বাস নিই, খাই ও অক্সিজেন গ্রহণ করি, যা আমাদের শারীরিক বৃদ্ধির কাজে লাগে। উদ্ভিদ, প্রাণী, বন, বন্যতা সবকিছুই এখন প্রকৃতির। আমরা ক্রমাগত প্রকৃতির সীমিত, ভঙ্গুর অথচ মূল্যবান গুণ প্রত্যক্ষ করি, কারণ অস্থায়িত্বশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকৃতির বিশৃঙ্খলাকে ত্বরান্বিত করছে। তবে বেশসংখ্যক মানুষ প্রকৃতিকে জীবনরক্ষাকারী ও মানবিক ঐতিহ্য মনে করেন। পরিবেশ ও পরিবেশবাদ আমাদের প্রকৃতিবিষয়ক রাজনীতির কথাও বলে। মানবসমাজসমূহ এবং বৈশ্বিকভাবে সম্পর্কিত অর্থনীতিসমূহ বায়োস্ফিয়ারের অংশবিশেষ। এই অবস্থা সামাজিক বিকাশের ধারাকে ধরে রাখা এবং প্রয়োজনীয় প্রতিবেশতাত্ত্বিক সমর্থন প্রদানের জন্য পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। ইতিহাসব্যাপী মানুষ প্রকৃতিকে যেমন রূপ দিয়েছে তেমন প্রকৃতিও মানবসমাজকে বিকশিত করেছে। মানবীয় কর্মকাণ্ডের মাত্রা বিবেচনা করলে দেখা যায় প্রযুক্তি, পুঁজিবাজার এবং শাসনব্যবস্থা মানবসমাজসমূহকে আন্তঃসম্পর্কিত করেছে। সমাজব্যবস্থা ও পরিবেশব্যবস্থা এতোটাই পরস্পরসম্পর্কিত ও নির্ভরশীল যে, এক জায়গায় যে-কোনো পরিবর্তন সাধন করলে তা অন্যত্র সমাজ ও পরিবেশব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। এক জায়গায় নবায়নযোগ্য সম্পদের সরবরাহের তারতম্য হলে অন্যত্র নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। পরিবেশব্যবস্থার স্থানিক ও বৈশ্বিক পরিবর্তনে মানুষ প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। তাই বলা যায়, সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা মানুষের আন্তঃসম্পর্ক অধ্যয়ন শুধু নয়, বিশেষ পরিসরে মানুষের আন্তঃসর্ম্পর্ক অধ্যয়ন বোঝায়। এই পরিসরই পরিবেশ, প্রকৃতি এবং ভূগোল। প্রকৃতিকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলা হয়েছে, এটি হলো প্রাকৃতিক পৃথিবী এবং পৃথিবীতে যা কিছু আছে – যেমন মানুষ ও তার সারবস্তুও – প্রকৃতির মধ্যে পড়ে। বৃক্ষ, বন, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী প্রকৃতির উদাহরণ বলা যায়। যদি কেউ অসভ্য হয়ে থাকে তবে তাকে অসভ্য প্রাকৃতিক মানুষ বলতে হবে। প্রকৃতি আমাদের অর্থনীতি, সমাজ, এমনকি সম্পূর্ণ অস্তিত্ব। বন, নদী, সাগর, মহাসাগর ও মৃত্তিকা আমাদের খাদ্য, বাতাস, সেচের পানি দেয়। আমরা আমাদের স্বাস্থ্য, সুখ ও উন্নতির জন্য প্রকৃতির বিবিধ পণ্য ও সেবার ওপর নির্ভর করি। সে কারণে প্রকৃতিকে মূল্য না দিয়ে উপায় নেই। প্রকৃতি কী প্রকৃতি কী? – এমন প্রশ্ন দার্শনিক বটে। রেমন্ড উইলিয়ামস বলেন, ‘It is relatively easy to distinguish three areas of meaning : (i) the essential quality and character of something; (ii) the inherent force which directs either the world or human beings or both; (iii) the material world itself, taken as including or not human beings.’ তিনটি ধারণাই সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়। প্রথমটি ত্রয়োদশ শতকে ব্যবহৃত হতো। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারণা-দুটি অপেক্ষাকৃত বিমূর্ত। দ্বিতীয়টি চতুর্দশ শতকে এবং তৃতীয়টি সপ্তদশ শতক থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে এটি স্পষ্টত বোঝা যায় যে, ঐতিহাসিকভাবে প্রকৃতি শব্দটির প্রেক্ষাপট নির্ধারিত হয়ে আসছে, তবে বর্তমানে প্রকৃতি শব্দটি বহুবাচক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন শক্তি, স্থান, অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য। এছাড়া স্থানীয় ও বিচ্ছিন্ন বাস্তবতার নিরিখে প্রকৃতিকে জানার সুযোগ হলেও সংস্কৃতির বিবর্তনের মাধ্যমে এটি অনেক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আজকে প্রকৃতির ধারণাকে অস্বীকার না করেও আমরা যখন পরিবেশ বা প্রতিবেশকে আলাদাভাবে অধ্যয়ন করছি তখন এক অর্থে আমরা প্রকৃতির সুপ্ত ব্যবচ্ছেদ করে চলেছি। উন্নত বিশ্বে শহরগুলির বাস্তবতা এতো বেশি বিশেষত্ব লাভ করেছে যে, প্রকৃতির বিপরীত অভিধায় তা জানার চেষ্টা চলছে। অনুরূপভাবে নাগরিক সমাজকে গ্রামীণ সমাজ থেকে আলাদাভাবে ভাবার চেষ্টা করা হয়। বিনয় ঘোষ তাঁর একটি বইয়ের নাম রেখেছেন মেট্রোপলিটন মন : মধ্যবিত্ত-বিদ্রোহ অর্থাৎ শহর আমাদের মনস্তাত্ত্বিক গঠনও পাল্টে দিচ্ছে। এটি আর প্রাকৃতিক চক্রে প্রশাসিত বা নোঙরকৃত থাকছে না। সমাজবিজ্ঞানও আজকের দিনে পশ্চিমা বিশ্ব ও শহুরে সমাজ নিয়ে ব্যস্ত। বন্য প্রকৃতি যেন একটি অবহেলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, প্রকৃতির বৃহত্তর অর্থ ভৌত, বাস্তবিক ও প্রাকৃতিক তথা বিশ্বকে বোঝায়। যদিও মানুষ প্রকৃতির একটি অংশ, মানুষের কাজকে আলাদা প্রপঞ্চ হিসেবে দেখা হয়। অধুনা প্রকৃতিবিষয়ক ধারণা মানুষের সংস্কৃতি ও কর্মজগতের বাইরে একটি স্বাধীন ও বাহ্যিক সত্তা হিসেবে পরিগণিত হয় না। বরং বিশ্ব মানবসমাজের দ্বারা এটি প্রতিনিয়ত নির্ভরশীল ও পরিবর্তিত হচ্ছে এমন ধারণাই অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবেশ ও পরিবেশগত সংকটের দ্বারা নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করছে। পূর্বে মনে করা হতো, প্রকৃতি একটি সুশৃঙ্খল, অক্ষয় ও উপকারী জগৎ। অনেক ধরনের রচনা ও ঝুঁকিবিষয়ক বিশ্লেষণ প্রকৃতির এমন ধারণাকে ধূলিসাৎ করেছে। প্রকৃতি এখন বিশৃঙ্খল, ক্ষয়িষ্ণু ও ঝুঁকিপূর্ণ। এটি এখন সীমিত ও ভঙ্গুর। প্রয়াত কবি রফিক আজাদ সত্তরের দশকে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম ছিল সীমিত জলে সীমাবদ্ধ সবুজে। আজকের শহরজীবনের এক অনবদ্য প্রতিবিম্ব। প্রকৃতিকে সীমাহীন ভাবতে গেলে বিশ্বের প্রসারিত প্রকৃতির ভাবনা চলে আসে। পরিবেশ হিসেবে প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে আমরা আমাদের গ্রহের ওপর বেশি নজর দিয়েছি। মানুষ ও তার সংস্কৃতি বিজ্ঞান ও সমাজপাঠের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমান্বয়ে প্রকৃতি আর স্বাধীন বাহ্যিক চলক ও নির্ভরযোগ্য সম্পদের ভাণ্ডার হিসেবে থাকেনি। এখন প্রকৃতি গার্হস্থ্য, সামাজিকীকৃত ও রাজনৈতিকীকৃত বিবেচিত হচ্ছে। আমরা প্রকৃতির ব্যবস্থাপনা, স্থায়িত্বশীলতা ও শৃঙ্খলা নিয়ে ভাবিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক বস্তু হিসেবে বাতাসকেও অন্যান্য উপযোগ, যেমন রাস্তা, বিদ্যুৎ প্রভৃতির মতো ভাবতে শিখেছি। সুতরাং সামাজিকভাবে উপরিবীক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ, ও শৃঙ্খলায়ন দরকার হয়ে পড়েছে। পানি উনিশ শতকেই সামাজিকীকৃত হয় এবং পানি ব্যবস্থাপনাকে নৈতিক কর্তব্য জ্ঞান করা হয় যদিও ভূগর্ভস্থ জলের প্রবাহ তখন মানুষের জানা ছিল না। পরিবেশবাদ আজকে সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ স্পিসিসকে, প্রাকৃতিক অঞ্চলকে, বনাঞ্চলকে এবং বন্যজীবনকে সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকৃতির এসব জিনিসকে সীমিত ও ভঙ্গুর মনে করেছে। মানুষ মনে করে প্রকৃতি তাদের জীবনপ্রবাহের ভিত হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া ব্যক্তির কাছে এসবের ঐতিহ্যিক মূল্যও কম নয়। কিন্তু এসবের পেছনে ক্রিয়াশীল রাজনীতির দিকটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশ শতকের আশির দশক থেকে কেন এতো গ্রন্থ পরিবেশ ও পরিবেশবাদের ওপর লেখা হলো? প্রকৃতির সামাজিকীকরণের এই সাধারণ রূপ ও পরিবেশবাদের উত্থান চমকপ্রদ তো বটেই, সেই সঙ্গে এটি যথেষ্ট পরিষ্কার নয় যে, মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক এতোটা গুরুত্ব বহন করে কেন? এমন ধারণা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত যে, প্রাকৃতিক বিশৃঙ্খলাকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রকৃতির ওপর সাংস্কৃতিক অধিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা একমুখী পরিবেশবাদের রাজনীতি ছাড়া কিছু নয়। গত দশ বছরে প্রকৃতির ওপর লেখা গ্রন্থের সমাহার প্রমাণ করে যে, সেগুলি পরিবেশবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। সামাজিক বিজ্ঞানের বীরত্বপূর্ণ কাজে এগুলির ভূমিকা অনবদ্য মনে করা হয়। পরিবেশের আলোচনায় সামাজিক আন্দোলন ও পরিবেশবিষয়ক বিতর্কের একটা পরিসরও গড়ে ওঠে। তবে এসব লেখালেখি পরিবেশের বিশ্বজনীন রূপকে তুলে ধরতে পেরেছে মনে করা হলেও বাস্তবে প্রাকৃতিক বিষয়ের বা সামাজিক বিষয়ী একটা ক্ষুদ্র পরিসর ছুঁতে পেরেছে বলে মনে করা হয়। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে বন্যজীবন, বনাঞ্চল, উচ্চভূমি অথবা নিম্নাঞ্চল গুরুত্ব পেয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল বেছে নেওয়ার কারণ হলো, পরিবেশবাদ নিজেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মেট্রোপলিটান সিটি বা ছোট শহর পরিহার করা হয়েছে কারণ এসব অঞ্চল যেনবা বিপ্রাকৃতিক, অপরিচ্ছন্ন ও হারিয়ে গেছে। সেদিক থেকে পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে রোমান্টিক আন্দোলনের সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায়, কারণ তারাও একই ধরনের প্রকৃতি নিয়ে কাজ করে। প্রকৃতি ও সমাজ মানুষ জন্মগতভাবেই প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। মস্তিষ্কের উন্নততর বিবর্তন ও কৌশলগত উন্নতি মানুষকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করেছে। ইতোমধ্যে কৃষির আবির্ভাব মানুষকে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেয়। এ থেকেই ধীরে ধীরে সামাজিক বা সাম্প্রদায়গত যৌথবদ্ধতার সূচনা হয়। সব দেশে সব জায়গায় সমানভাবে না হলেও মানুষ তার জীবনযাপনের উপযোগ মেটাতে প্রকৃতিকে কাজে লাগায়। যাবতীয় রসদ সংগ্রহের জন্য তারা প্রকৃতির ভাণ্ডার ব্যবহার করে। এভাবেই প্রকৃতি ও সমাজ আলাদা অবয়ব গ্রহণ করতে থাকে। গত ৩০০ বছরে প্রকৃতি, খনিজসম্পদ, মাটি ও জলপ্রবাহ, এমনকি আকাশ মানবসমাজের আধিপত্যের শিকার হয়। সুতরাং প্রকৃতি ও সমাজ দুটি বিচ্ছিন্ন স্বাধীন সত্তা হিসেবে পরিগণিত হতে শুরু করে। প্রকৃতির ক্রমাগত অবনয়ন মানবসমাজের উন্নয়নকে নিশ্চিত করে। আগে মানুষের পরিবেশ-প্রতিবেশ বলে কিছু ছিল না, কারণ তারা পরিবেশেরই অংশ ছিল। কিন্তু গত ৩০০ বছরে তারা পরিবেশের ধারণা লাভ করল। প্রকৃতিকে তারা জীবন ধারণের নানাবিধ উপায় থেকে নান্দনিক শিল্পের মাধ্যম হিসেবে আত্মস্থ করল। পরবর্তীকালে বিজ্ঞান ও কলাকৌশলের অভূতপূর্ব উন্নতি সম্পূর্ণভাবে নিয়মতান্ত্রিক ও স্থায়িত্বপ্রাপ্ত বিষয় হয়ে দাঁড়াল। এছাড়াও অনেক ধরনের পণ্য ও সেবা আমরা প্রকৃতি থেকে পাই। প্রকৃতির অফুরন্ত সম্পদকে ‘ন্যাচারাল ক্যাপিটাল’ বা প্রাকৃতিক পুঁজি বলা হয়ে থাকে। কৃষি থেকে বনায়ন ও বিনোদন থেকে পর্যটন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে এসব সুবিধা কাজে লাগানো হয়। একটি হিসাবে বলা হয়েছে যে, বছরে ন্যূনপক্ষে ১২৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক সম্পদ সবার জন্য না হলেও মুক্ত। সে-কারণে আমরা একে আমাদের জন্য প্রদানকৃত এবং ইচ্ছামতো আত্মসাতের বিষয় মনে করি। বন বিনষ্ট, বেশি করে মাছ ধরা, নদীগুলোকে দূষিত করা ও পলিমাটি দিয়ে ইট তৈরি করার পূর্বে এর ফলাফলের কথা চিন্তা করি না। উপকার বা আর্থিক মূল্য লাভের সঙ্গে সঙ্গে যে বিপুল সামাজিক ও আর্থিক ক্ষতির জন্ম দিচ্ছি, তা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ওপর বর্তাবে। সুতরাং সরকারকে এ-ব্যাপারে বাস্তবিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..