বাংলাদেশ কি গণতন্ত্রের পথে?

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
উপনিবেশিক আমলে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে বাংলা জনপদের মানুষ। গণতন্ত্রের লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তবে কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক পরিবেশ কতটা এসেছে বাংলা জনপদে তা দেখার বিষয়। পৃথিবীতে গণতন্ত্রের সূচনা পথ পর্যবেক্ষণ করলে নানা ধারা দেখা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রে, বিশেষ করে এথেন্সে, ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি এসেছিল, যার অর্থ ‘জনগণের শাসন’, অভিজাততন্ত্রের বিপরীতে, যার মানে ‘অভিজাতদের শাসন’। প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসে গণতান্ত্রিক নাগরিকত্ব প্রথমে শুধু অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, পরে ১৯শ ও ২০শ শতকের ভোটাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্য প্রসারিত হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপায়ে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪২২ সালে ক্লিয়ান ডেমোক্রেসিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- That shall be the democratic which shall be the people, for the people. অনেক পরে আব্রাহাম লিঙ্কন তার এক ভাষণের মধ্যে ঠিক এমনই এক জনপ্রিয় সংজ্ঞা প্রদান করেন। আব্রাহাম লিংকন ১৯, নভেম্বর ১৮৬৩ তারিখে তার দেয়া গেটিসবার্গ বক্তৃতাতে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন এভাবে ‘Government of the people, by the people, for the people.’ যার অর্থ হলো- গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য। অধ্যাপক গেটেলের মতে, ‘যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগে অংশ নেওয়ার অধিকারী তাই গণতন্ত্র। বাংলা ‘গণতন্ত্র’ পরিভাষাটি ইংরেজি ডেমোক্রেসি থেকে এসেছে। এই ইংরেজি শব্দটি আবার এসেছে গ্রিক শব্দ দেমোক্রাতিয়া থেকে, যার অর্থ ‘জনগণের শাসন’ বা জনগণের ক্ষমতা এই দুটি শব্দ দিয়ে। শব্দটির দুইটি উৎপত্তি হচ্ছে দেমোস ‘জনগণ’ ও ক্রাতোস ‘ক্ষমতা’ থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে অ্যাথেন্স ও অন্যান্য গ্রিক নগররাষ্ট্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝাতে শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিসের নতুন ধরনের সরকার চালু হয়। তখন বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের ছোট একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। এই শহর-রাষ্ট্রটি ছিল এথেন্স শহর এবং তার আশপাশের গ্রামাঞ্চল নিয়ে গঠিত। রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন উপজাতির মধ্য থেকে নেতাদের বেছে নেয়ার যে সনাতনী রীতি চালু ছিলো, ক্লিসথেনিস তার অবসান ঘটান। তার বদলে তিনি মানুষের নতুন জোট তৈরি করেন এবং প্রতিটি জোটকে ডিময় অথবা প্যারিশ- এ বিভক্ত করেন। প্রতিটি মুক্ত নাগরিককে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ে শহর-রাষ্ট্রের সরকার পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণের অধিকার দেয়া হয়। সাধারণভাবে এই ঘটনাকেই গণতন্ত্রের প্রথম উন্মেষরূপে গণ্য করা হয় যার পরে নাম হয় ডেমক্রেশিয়া যার অর্থ হচ্ছে জনগণের শক্তি। তবে গণতন্ত্র নিয়ে কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইশতেহার (১৮৪৮) এবং পরবর্তী গ্রন্থে বলেছেন যে, ‘শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবের প্রথম পদক্ষেপ হল সর্বহারা শ্রেণিকে শাসক শ্রেণির পদে উন্নীত করা, গণতন্ত্রের যুদ্ধে জয়লাভ করা’, এবং সর্বজনীন ভোটাধিকার ‘জঙ্গি সর্বহারা শেণির প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির মধ্যে একটি’। তাছাড়া ‘কমিউনিজমের মূলনীতি’ (১৮৪৭) বইতে ফ্র্রেডরিখ এঙ্গেলস লিখেছেন: ‘সর্বোপরি, এটি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রতিষ্ঠা করবে এবং এর মাধ্যমে, সর্বহারা শেণির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে।’ যদিও মার্কসবাদীরা বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে একটি সর্বহারা আধা-রাষ্ট্র (সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্ব) দিয়ে প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করেন, যা অবশেষে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, নৈরাজ্যবাদীরা সতর্ক করে দেন যে পুঁজিবাদের সাথে রাষ্ট্রকেও বিলুপ্ত করতে হবে। তবুও, কাক্সিক্ষত পরিণতি (একটি রাষ্ট্রহীন সাম্প্রদায়িক সমাজ) একই। এর অর্থ হল সমাজিক মালিকানায় চলে আসবে রাষ্ট্রের সকল সম্পত্তি ও সম্পদ। আর এর বণ্টন ব্যবস্থাটা হবে গণতান্ত্রিকভাবে সুষম হারে। অর্থ্যাৎ ভোগটা সমহারে প্রতিটি নাগরিক করতে পারবেন, এখানে শ্রেণিভেদ প্রথাটা থাকবে না। সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হবে। অন্য একটি সংজ্ঞায় গণতন্ত্র সম্পর্কে বলা আছে যে, গণতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে, এবং নেতারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। এটি শুধুমাত্র একটি নির্বাচন ব্যবস্থা নয়, বরং নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করে। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো সাম্য, স্বাধীনতা, এবং ভ্রাতৃত্ব। যেমন, ১. গণতন্ত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে। ২. সরকারের প্রতিনিধিরা নির্দিষ্ট সময় পর পর জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। ৩. এটি নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। ৪. গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র হলো সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ব, যা মানুষের মৌলিক অধিকার ও সমান সুযোগের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ইতিহাসে গণতন্ত্র ছিল বিরল এবং ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু ১৯শ শতক থেকে গণতন্ত্রের বিভিন্ন তরঙ্গে এটি বেশি প্রচলিত হয়েছে। আজকাল গণতন্ত্র বেশ জনপ্রিয়, কারণ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এটিকে অন্য ব্যবস্থার চেয়ে বেশি পছন্দ করে। এমনকি স্বৈরাচারী দেশগুলোও নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে। তবে, ভি-ডেম এবং ইকোনমিস্টের গণতন্ত্র সূচক অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের অর্ধেকেরও কম মানুষ গণতন্ত্রে বাস করে। বাংলাদেশের জন্মটি হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরির লক্ষ্যে। গণতন্ত্রের অর্থনৈতিক সংস্করণ হচ্ছে সমাজতন্ত্র। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধের পর রচিত সংবিধানে রাষ্ট্রের চারটি মূল নীতি নির্ধারণ করা হয়, তাহলো ১. গণতন্ত্র ২. জাতীয়তাবাদ, ৩. ধর্মনিরপেক্ষতা ৪. সমাজতন্ত্র। কারণ এই চারটি নীতির বাইরে চলে গেলে কোনো রাষ্ট্রেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকে না। গণতন্ত্র শুধু ভোট দেয়ার স্বাধীনতা প্রদান করা না। গণতন্ত্র হলো প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠন করা। ১৯৭২ সালের পরবর্তী সময়গুলোতে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের শাসক শেণি রাষ্ট্রের মূল কাঠামো থেকে সরে এসেছে। তাই বার বার রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রটির স্টিয়ারিংটা চলে গেছে একনায়কদের হাতে। ফলে বাংলার মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধের সুফল পায়নি। তবে জনগণও থেমে থাকেনি, তারা বার বার আন্দোলন, লড়াই সংগ্রাম করেছে গনণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য। ২০২৪ সালে ৫ অগাস্ট এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতন হয়। মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে গনতন্ত্র পাওয়ার আশায়। গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের পদক্ষেপ নেন। দুঃখের বিষয় এই যে মহান মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের চার মূলনীতিকে সংস্কার কমিটি আমলে নেয়নি। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য থেকে জানা যায় যে, সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন পৃষ্ঠা নং ৭৫-৭৬ তে সংস্কার কমিটি সংবিধান সংস্কারে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে সমাজতন্ত্র বাদ দেয়ার সুপারিশ করেছেন। তারা বলেন, “সমাজতন্ত্র মূলত গণতান্ত্রিক শাসনবিরোধী। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ব্যক্তিগত অধিকার এবং স্বাধীনতার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে, যা সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে বিরোধী। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রধানত শিল্প ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে, যা ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। এই কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ স্বায়ত্তশাসন নীতির বিরোধীও বটে। এছাড়া সমাজতন্ত্র সাধারণভাবে সমষ্টিগত মালিকানা এবং সম্পদ বিতরণের ওপর গুরুত্ব দেয়, যা ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিকার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে। কিউবা এবং প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মতো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল, যা রাজনৈতিক বহুত্ববাদ এবং ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সীমিত করেছিল। তাছাড়া গত কয়েক দশকে রাজনৈতিক এবং সামাজিক মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রতি ক্রমশই সমর্থন কমেছে। অনেকেই এখন সমষ্টিগত মালিকানা এবং রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং বাজারভিত্তিক ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেন। বর্তমান যুগে সমাজতন্ত্র অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে।” এই প্রেক্ষিতে কমিশন সুপারিশ করছে যে, রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র বাদ দেয়া হোক। এটা যে যেভাবে ব্যাখ্যা করুক না কেন, অর্থনৈতিক সংস্কার না হলে গণতন্ত্র কখনোই টেকসই হবে না। রাষ্ট্র কাঠামোতে বর্তমানে যে অর্থনৈতিক বণ্টন ব্যবস্থা বিদ্যমান তা বিরাজ করলে দেশে গণতন্ত্র আসবে না। গণতন্ত্রের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সুষম বণ্টন ব্যবস্থা। শুধুমাত্র ভোট দিতে পারাটাই গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য হয় তাকে প্রকৃত গণতন্ত্র বলা যাবে না। কারণ এদেশে ভোট কেনা-বেচারও একটি সিস্টেম অতীতে দেখা গেছে। তাই গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হলে সকলের স্বাধীনতা ও অধিকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তাই সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রকে ভিত্তি করে সামনে এগিয়ে গেলে রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসবে। লেখক: প্রাবন্ধিক

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..