কমরেড আহসানউল্লাহ চৌধুরী একজন উদার মানবিক নিরহংকারী কমিউনিস্ট নেতা

অশোক সাহা

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
স্বাধীনতার পরপরই একদিন চট্টগ্রামের দারুল ফজল মার্কেটে ন্যাপ আয়োজিত এক বড় সমাবেশে নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শুনছিলাম। নতুন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী আমি। সদ্য ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হই। মনে বেশ উৎসাহ। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন সবার মিটিং মিছিলে যাই। ভালো লাগতো। ন্যাপ অফিসের পাশেই লাগোয়া আমাদের ছাত্র ইউনিয়ন অফিস। নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনতাম বেশ আগ্রহভরে। সেদিনের সমাবেশের বিশেষ আকর্ষণ ছিলেন ন্যাপের নতুন সাধারণ সম্পাদক এবং ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন কার্যকরী সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য দাদা। সমাবেশ চলাকালীন মাঝপথে চট্টগ্রাম জেলা ন্যাপের সভাপতি চৌধুরী হারুন অর রশীদ ভাই জানালেন, চট্টগ্রাম বন্দরে সিবিএ নির্বাচনে আমাদের সমর্থিত চট্টগ্রাম বন্দর শ্রমিক ইউনিয়নের বন্ধুরা জয়লাভ করেছেন। সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন বন্দরের শ্রমিক কর্মচারীদের জনপ্রিয় নেতা আহসানউল্লাহ চৌধুরী। পুরো সমাবেশ বেশ আনন্দে উৎফুল্ল। সেদিন প্রথম আহসানউল্লাহ চৌধুরী নামটা শুনতে পাই। এরপর ১৯৭৪ দেশে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতিতে আর্তপীড়িত মানুষের জন্য রিলিফ সংগ্রহের নিমিত্তে একটা কর্মী সমাবেশে গেলাম ২২ জে সি গুহ রোডের চট্টগ্রাম জেলা কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে। সেই সমাবেশে দেখি কমরেড আহসানউল্লাহ চৌধুরীকে। তিনি পার্টির জেলা কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক। সবার আলোচনা শেষে আহসানউল্লাহ চৌধুরী ভাই বক্তব্য রাখলেন। সেই প্রথম ওনার বক্তব্য শুনি। ওনার সাথে প্রথম কিভাবে পরিচয় ঘটে মনে পড়ে না। তবে স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামের মুসলিম হলে ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের চট্টগ্রাম জেলা সম্মেলন দেখতে গিয়ে দেখলাম সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে সম্মেলনের সভাপতি এম এস হক সাহেব (প্রাক্তন সভাপতি, রেল শ্রমিক ইউনিয়ন) নতুন জেলা কমিটি ঘোষণা করলেন। সভাপতি আহসানউল্লাহ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের মাসুদ। টিইউসি সম্মেলনের কিছুদিন আগেই সম্ভবত রাইফেল ক্লাবের সামনে ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম নগর কমিটি আয়োজিত এক বড় সমাবেশে মাসুদ ভাইয়ের দীর্ঘ এক মনমাতানো বক্তৃতা শুনি। খুব ভালো লেগেছিল আমার। ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের সাথেই আমাদের দৈনন্দিন দেখা হতো দারুল ফজল মার্কেট অফিসে। পার্টির প্রথম সারির নেতা মাহবুব ভাইয়ের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা হতে হতে পরিচয় ঘটেছে। সংগঠনের কাজ করতে করতে ক্রমে সবার সাথে পরিচয় হয়। জেলা কমিটির সম্পাদক কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো দাদা, সাত্তার ভাই, অনঙ্গ দা, শাহ আলম ভাই, বালাগাত, খোরশেদ ভাই, মুছা ভাই, তপনদা, মৃনালদা, গিয়াস ভাই, আউয়াল ভাই, উৎপল ধর দাদা সবার সাথে। আহসান ভাইয়ের সাথে ধীরে ধীরে পরিচয় ঘটে কাজকর্মের ধারায়। ছাত্রাবস্থায় আমাদের সাথে বেশি যোগাযোগ ছিল খোরশেদ ভাই, মাহবুব ভাইদের সাথে। ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম জেলা কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে তিনটা জেলা হয়ে যায়। নগরের সম্পাদক কমরেড আহসানউল্লাহ চৌধুরী, উত্তর জেলার সম্পাদক কমরেড খোরশেদুল ইসলাম, দক্ষিণ জেলার সম্পাদক কমরেড মোহাম্মদ মুছা। চট্টগ্রাম নগরের সম্পাদক হবার আগে থেকেই আহসানউল্লাহ চৌধুরী ভাইয়ের সাথে আমার সাথে বা আমাদের সমসাময়িক বন্ধুদের ভালোভাবে সম্পর্ক চেনাজানা ঘনিষ্ঠতা ইত্যাদি গড়ে উঠতে থাকে। আমাদের সবাইকে আদর করতেন, স্নেহ করতেন। চট্টগ্রাম জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সামনের সারির নেতৃস্থানীয় সকলে সে সময়টায় মনপ্রাণ উজাড় করে সারা জেলায় পার্টি গড়ে তোলার কাজে ভীষণ সচেষ্ট ছিলেন। সকলের মধ্যে ছিল জীবন নিবেদিত বৈশিষ্ট্য, যোগ্যতা, গুণাগুণ। পরবর্তী প্রজন্মকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ওনারা অসামান্য অবদান রেখেছেন–যে যতদিন করেছেন বা পেরেছেন। আহসানউল্লাহ ভাই ছিলেন চট্টগ্রামের প্রথম সারির ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। অন্যান্য দলেও ছিলেন পরিচিত অনেক শ্রমিক নেতা। কিন্তু গুণেমানে সংগ্রামে সংগঠন কর্মপ্রক্রিয়ায় আহসান ভাইয়ের ঔজ্জ্বল্য চোখে পড়ার মতো। বিভিন্নধর্মী সভা সমাবেশ আলোচনা সভা সমাবেশ বৈঠক সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গন এবং শ্রমিক আন্দোলনে আহসান ভাইয়ের বিশেষ গুণ বা যোগ্যতা নিজের সহযোদ্ধা সহকর্মী বা অপরাপর সংগঠনের বন্ধুরাও বিবেচনায় নিতেন। মান্য করতেন। চট্টগ্রাম বন্দরে তিনি ছিলেন সর্বগ্রহণযোগ্য বিশ্বস্ত লড়াকু আপসহীন নীতিনিষ্ঠ নেতা। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি এই সম্মানে ভূষিত ছিলেন। এটা এক বিরল প্রাপ্তি। এটা আমাদেরও ভালো লাগে। আহসান ভাই বলতেন আলোচনা উঠলে, ‘আমরা যে সমাজটা পরিবর্তনের কঠিন সংগ্রাম করছি সেই সমাজে রয়েছে বহুবিধ পঙ্কিলতা সংকট সমস্যা। এই পঙ্কিলতার অবসানকল্পেই আমাদের সংগ্রাম। সমাজের সাথে নিঃসংকোচে মিশে যেতে হবে আমাদের। কিন্তু সমাজ অভ্যন্তরে বিরাজমান কোনো রকম পঙ্কিলতা আমাদের যেন গ্রাস করতে না পারে। আমরা যেন নষ্ট না হয়ে যাই।’ কী অসাধারণ কথা। স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন। রাজনৈতিক কোনো বিষয়াদি আহসান ভাই দ্রুত ধরতে পারতেন। করণীয় যা করার তা সাহসের সাথে সাথীদের সাথে বোঝাপড়া করে জোর কদমে এগিয়ে চলতেন। যা করতে চাইতেন তার শেষ দেখে ছাড়তেন। সুবিধাবাদ আপসকামিতা অনৈতিকতা অসততা আহসান ভাই প্রশ্রয় দিতেন না। অতি কাছে থেকে আমরা সেটা দেখার সুযোগ পেয়েছি। গর্বাচভের সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংস আয়োজন তিনি সবার আগে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। এ ব্যাপারে ওনার বিন্দুমাত্র মোহাবিষ্ট মনোভাব ছিল না। বলতেন, এরা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন শেষ করে দেবে। এরা পাষ-। দেশের রাজনীতি নিয়েও। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে যা ঘটে গেলো তা শোনার পর আহসান ভাই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো রকম আশাবাদ ব্যক্ত করেননি। ভগ্ন শরীর মন নিয়েও প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রশ্ন করেছেন- আবার মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে? মনে হয়েছিল আরো কিছু বলতে চান। প্রকাশ করতে পারছিলেন না। শরীরের পরিস্থিতি বড় বৈরী। তিনি তো চুপচাপ থাকার মানুষ নন। অহঙ্কার আত্মম্ভরিতা প্রদর্শনবাদ আত্মস্বার্থ কমরেড আহসানউল্লাহ চৌধুরীর কোনো কথায় আচরণে কোনোদিন আমি দেখিনি। সবার সাথে আলাপ আলোচনাকে তিনি সবসময় গুরুত্ব দিতেন। চাপিয়ে দেয়ার মনোবৃত্তি ওনার মধ্যে ছিল না। কোনো বন্ধু সাথী কমরেডের সাথে মনে কষ্ট পায় ব্যথা পায় অসম্মান হয় এমন আচরণ আহসান ভাইকে কারো সাথে করতে দেখিনি। সবাইকে ভালোবাসতেন বুকভরে। যে কারো সমস্যা সংকটের মুহূর্তে ঝাপিয়ে পড়তেন। কোনো কার্পণ্য করতেন না। বলতেন, কমরেডদের সমস্যার সময় পাশে দাঁড়ানো নৈতিক কর্তব্য। সাংগঠনিক কর্তব্য। নচেৎ অর্পিত দায়িত্ব কমরেড মনযোগসহ পালন করতে পারবেন না। ভীষণ মানবিক গুণের মানুষ ছিলেন। এমন উন্নত সংস্কৃতি মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ একটা সমাজ সংসার পরিবার স্বজনেরা কালেভদ্রে পায়। আহসান ভাই ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য। কত রকম কত অসংখ্য আলাপ করেছেন। কিন্তু পার্টির কারো দুর্নাম করা বা শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো কথা কোনোদিন বলেননি। নিজের পারিবারিক ঘরোয়া কত কথা সরল বিশ্বাসে বলতেন। আমি হা করে তাকিয়ে থাকতাম। কী পরম বিশ্বাস একজন সাথী কমরেডের প্রতি। হ্যাঁ, বুজেছি শিখেছি এটাই পার্টি লাইফ। এটার সম্মান দিতে জানতে হয়। এখনো অঝোরে কাঁদছেন পরিবারের প্রতিটি মানুষ। একটা দুর্ঘটনার কারণে দশ বছর ঘরে বসা ছিলেন। বাস্তবে ছিলেন বিছানায়। বিন্দুমাত্র অবহেলা হয়নি। প্রতিটি ক্ষণ ছিলেন সসম্মানে, আদরে যত্নে। আমরাও চেষ্টা করেছি প্রয়োজনীয় সঙ্গ দেয়ার। প্রাপ্য সম্মান শ্রদ্ধা জানানোর। শেষতক লাল ঝান্ডায় আচ্ছাদন করে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গেয়ে পার্টি অফিসে ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়ে বিদায় জানিয়েছি। চট্টগ্রামের দক্ষিণ নালাপাড়ায় আমরা প্রতিবেশী ছিলাম দীর্ঘদিন। প্রায়দিন সকালে আমাদের বাসায় যেতেন। চা খেতেন। গল্প করতেন। আমিও যেতাম। আহসান ভাইয়ের প্রাণভরা আদর স্নেহ ভালোবাসা কোনোদিনও ভুলার মত নয়। বিগত বছরগুলোতে বিছানায় অসুস্থ থেকেও প্রতিদিন সকালে একবার ফোন করতেন। সর্বশেষ খবরাখবর জানতে চাইতেন। সর্বগুণে গুণান্বিত উচ্চ মানসম্পন্ন কমিউনিস্ট ছিলেন আমাদের কমরেড আহসানউল্লাহ চৌধুরী। লেখক : সভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা, সিপিবি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..