প্রগতিশীল শক্তির আশু কর্তব্য

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
দেশে এখন একটা অন্তর্বর্তী সরকার আছে। অন্তর্বর্তী সরকার- নামকরণই তাদের কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দেয়। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া এই সরকার পূর্বের অনির্বাচিত শক্তিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কাজ করবে। তবে এই হস্তান্তরের প্রক্রিয়া কেবলই নির্বাচন আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর ভেতরে জনগণের জীবনে ন্যায় এবং সাম্যের পুনঃপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার কাজও অন্তর্ভুক্ত। গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এটাই এই ধরনের সরকারের মূল লক্ষ্য। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যে পথে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তা বৈষম্যবিরোধী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। যে কারণে এই সরকারের কাজের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে সমতার সূচনাও পড়বে। এ ধরনের অন্তর্বর্তী সরকার নতুন নয়। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাত্র তিন মাসে নির্বাচনের কাজ শেষ করে উদাহরণ স্থাপন করেছিল। নির্বাচন ছাড়াও সেই সময় সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নেতৃত্বে গঠিত টাস্কফোর্স ভবিষ্যৎ নীতি নির্ধারণের সুপারিশ দিয়েছিল, যা প্রমাণ করে যে সংক্ষিপ্ত সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই সময়ের সীমা অতিক্রম করেছে। ছয় বা নয় মাস যথেষ্ট হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এখন সংস্কার ও ঐকমত্যের আড়ালে সময়ক্ষেপণ চলছে। নির্বাচন নিয়ে একটা সময়সীমা ঘোষণা করা হলেও জনগণের সন্দেহ কেটে যায়নি। ইতিহাসই বলে, অনির্বাচিত সরকার থেকে যারা লাভবান হয়, তারা প্রায়ই ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল নেয়। সেই প্রবণতা এখনো দেখা যাচ্ছে। আগের সরকারগুলোর মতো এই অন্তর্বর্তী সরকারও মূলত ক্ষমতা নিয়েই ব্যস্ত। অথচ অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের কিছু পদক্ষেপ রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক নির্দেশনার মধ্যেই সম্ভব। যেমন ন্যূনতম মজুরি ৩০ হাজার টাকায় নির্ধারণ। মুক্তিযুদ্ধের পরও সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা বাস্তবায়িত হয়নি। বৈষম্য দূর না করে অভ্যুত্থানের চেতনার প্রতি সম্মান দেখানো যায় না। বরং দেখা যাচ্ছে, দারিদ্র্য উৎপাদনের কাঠামো আরও মজবুত হচ্ছে। দরিদ্র মানুষের অনুপাত সরকারি হিসাবেই বেড়েছে। স্বৈরতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা অর্থনীতি কখনো গণতন্ত্রের ফুল ফোটাতে পারে না। বর্তমান সরকারের দীর্ঘসূত্রতা উগ্রবাদী, ধর্মভিত্তিক ও ডানপন্থি শক্তিকে তাদের অবস্থান শক্ত করার সুযোগ দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মীয় মৌলবাদীদের চক্রান্তের উদাহরণ আগেও দেখা গেছে। তাদের ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য একটাই-গণতান্ত্রিক শক্তিকে বিভক্ত করা। এ অবস্থায় প্রগতিশীল ও সৎ রাজনৈতিক শক্তির দায়িত্ব দ্বিগুণ হয়ে যায়। গ্রামসির চিঠি যেমন নির্দেশ করেছিল, সংকটের মর্মবাণী সেই জায়গায় নিহিত, যেখানে পুরনো ব্যবস্থা ব্যর্থ। আজকের বাংলাদেশেও সেই সংকট বিদ্যমান। শূন্য নেতৃত্বের ফাঁক বাম প্রগতিশীল শক্তির হাতে থাকা উচিত। যদি তারা ব্যর্থ হয়, তবে দেশ উগ্র ডানপন্থি ও সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে চলে যাবে। এ দায়িত্ব কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি নৈতিক ও গণতান্ত্রিক কর্তব্য। বাম ও প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নয়া যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে, একই সঙ্গে মানুষের ভাত-কাপড়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও সমান্তরাল লড়াই চালানো জরুরি। দুটি লড়াই-ই সমান গুরুত্ব বহন করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- ছাত্র আন্দোলনের শক্তি যেমন অপরিসীম, তেমনই দুর্বলতাও কম নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের বিজয় ধরে রাখার কাজ দিন দিন দূর থেকে আরও দূরে চলে যাচ্ছে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রকট। এর মধ্যে প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপই পারে দেশকে শোষণ ও বৈষম্যের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত করতে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..