
একবার একজন শিক্ষক আমাকে স্কুল নিয়ে জারি লেখতে বললেন, এবং সেই জারিতে যেন তার সুনাম হিসেবে তাকে বটগাছের সঙ্গে তুলনা করি। আমি তাকে এই ‘বটগাছ’ উল্লেখ করতে পারিনি। এটা তাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছিল।
সবাই বটবৃক্ষ হতে হতে চায়। সমাজের সর্বোচ্চ স্থানটি চায়। যদিও অনেকে সেই স্থানটি ধরে রাখতে পারেনা।
ঝড়বৃষ্টির যত ঝাপটা তার ওপর দিয়েই যায়। তার শরীরে অনেক পরগাছা জন্ম। নিজের বাঁচার প্রয়োজনে বটগাছের ওপর নির্ভর। মানুষ স্বভাবগতভাবে তার পরিবারে, সমাজে বয়স্ক এবং প্রবীণদের সম্মান করে। তার কাছে আশীর্বাদ, দোয়া, অনুকম্পা চায়। যিনি গুণীজন, তার হাত ধরে শ্রদ্ধাভরে চুমু খায়, প্রীত হতে চায়। তার সান্নিধ্য কামনা করে।
সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সে প্রকৃতির নিদর্শন উপভোগ করছে, তার নিয়ামকগুলো নিয়ামত হিসেবে গ্রহণ করছে। প্রকৃতির কাছে তার কৃতজ্ঞতার ভাষায় ঘাটতি নেই। নানাভাবে বিভক্ত সমাজ, ধর্ম, সম্প্রদায় সেই কৃতজ্ঞতা নিজ নিজ রীতিনীতি, সংস্কৃতির মাধ্যমে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রকাশ করেছে, এবং করছে। বটগাছের ছায়ার সাথে মায়ের স্নেহের তুলনা করে অনেক গান হয়েছে।
চিত্রশিল্পের তুলিতে ত্রিভূজ কিংবা পিড়ামিডীয় শাখা বিন্যাস বিশিষ্ট বটগাছ কখনো ঝাকড়া চুলের বাবরি দুলানো, জবুথবু দাড়ি সম্বলিত প্রবীণ পুরুষদের প্রতিকৃতির মনে হয়। কখনো দূর থেকে এটি একটি মসজিদের গম্বুজ বলে মনে হয়। কখনো ঘরের ত্রিকোণীয় চালের আকৃতি বলে মনে হয়।
সহস্র’বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা’কে তাই স্বাধীনতার মতো আলোকিত বলে কল্পনা করেছেন কবি শামসুর রাহমান।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বটগাছের শিকড়কে লক্ষ করেছেন, সে দেয়ালের গভীরে ঢুকে দেয়াল তৈরির শ্রমিকদের কষ্টের ভাগ অনুসন্ধান করে চলে। আবার এই শিকড় একদিন পুরো স্থবির দেয়ালটা তথা ঘুণে ধরা সমাজটাকে ফাটিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে।
বটগাছের সমস্যা হলো সে অকাতরে শতাধিক বছর ধরে সবাইকে ছায়া দেয়। অনেক নাম না জানা পাখির আবাস। অনেক সাইজের বন্যপ্রাণী এখানে কোটর বাঁধে, এর ফল খেয়ে জীবন বাঁচায়। বাউলেরা এই ছায়া পায় বলেই এখানে বসে গান করে। মানুষের মেলা বসে। বটগাছ যাদের নির্বাচনী প্রতীক তাদের কী হবে?
বৃক্ষরোপণ এবং তাকে বাঁচিয়ে রাখাটা ধর্মীয় নির্দেশনায় পড়ে। এটা প্রকৃতিতে সৃষ্টির এক নিপুণ নিদর্শন। এই নিদর্শন ধ্বংস করে তারা যে অপরাধ করেছে, এটা তাদের কাছে অপরাধ বলে গণ্য নাও হতে পারে, কিন্তু এজন্য একদিন জনতার কাঠগড়ায় উঠবে এবং জবাবদিহি করতে হবে।
এটার নীচে কোনো অপকর্ম হলে সেগুলো প্রতিরোধ করা যেতো। কিন্তু নিরীহ প্রকৃতির ওপর বোকামো’র দরকার ছিলোনা। একজনের ধর্মীয় বা লৌকিক বিশ্বাস থেকে এখানে তার প্রকাশ ঘটাতেই পারে। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়েই এই অপকর্মে লিপ্ত এই গোষ্ঠীর চেহারা সবারই চেনা। আবহমান বাংলাদেশের লৌকিক সংস্কৃতির বিরোধিতা করাই এদের কাজ। এর পেছনে উদ্দেশ্য ধর্ম বাণিজ্য আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া।
বিগত দিনে এরা সবসময়ই এবিষয়ে সচেতনভাবেই নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে চলেছে।
আমাদের বর্তমান সময়টা যাচ্ছে হুজুগের। ভালোমন্দ বিচার না করে, যাচাই না করে হুজুগে সেরে ফেলা। এতে করে উগ্র, ধর্মান্ধতা প্রশ্রয় পেয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছে। বিঘ্নিত হচ্ছে সামাজিক স্থিরতা।
একটা বিশেষ মহল বাউল সংস্কৃতির বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে এবং এবিষয়ে দেশে বিদ্যমান সরকারের প্রচ্ছন্ন, প্রত্যক্ষ সমর্থন লক্ষ করা যাচ্ছে। বটগাছের নীচে বাউল ধারার লোকজন ছাড়াও বিভিন্ন অসাম্প্রদায়িক জাতিগোষ্ঠী, মতাদর্শ এবং অতি সাধারণ মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে এসব মেলা জমে। এই আক্রোশপ্রসূত সিদ্ধান্তই ওরা বাস্তবায়ন করেছে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকাতে একদিকে আমরা বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নানান কর্মসূচি দিচ্ছি। আরেকদিকে শ্রেফ একটা মহল সেই বৃক্ষ উস্কানিমূলক ধারণা থেকেই কেটে ফেলেছে, যেহেতু এটা রাষ্ট্রীয় মালিকানার। এটাকে রক্ষা করা যেতো।