একতার কথা

এম. এ. আজিজ মিয়া

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
একতা– সাপ্তাহিক একতা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র সাপ্তাহিক একতা। শত বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে একতা প্রকাশের যেমন ধারাবাহিক প্রয়াস রয়েছে, তেমনি রয়েছে এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। পাকিস্তান আমলের শেষদিকে ঊনসত্তরের মহান গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে কিছুটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হলে ১৯৭০ সালের ৩১ জুলাই সাপ্তাহিক একতার প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। সেই হিসাবে একতা ৫৩ বছর পেরিয়ে ৫৪ বছরে পা রাখতে চলেছে। তাই একতাকে স্বাগত –শুভেচ্ছা। আর এ দীর্ঘ পথ চলতে গিয়ে পার্টির নেতাকর্মী ও একতার একনিষ্ঠ কর্মীরা যে পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। শুভেচ্ছা জানাই একতার সম্মানীয় পাঠকদেরকেও। ১৯৪৮ সালের ৬মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। তারপর থেকেই পার্টির একটি মুখপত্র প্রকাশের চিন্তাভাবনা শুরু হয়। কিন্তু ততদিনে সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান সরকারের জেল-জুলুম, নিপীড়ন-নির্যাতনের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক পার্টির নেতাকর্মীরা দেশ ছেড়েও চলে গেছেন। তারপরও ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পার্টির মুখপাত্র হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ছায়াপথ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। তা ছাপা হতো কলকাতা থেকে। মাস দুই চলার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। সেটি প্রকাশের দায়িত্বে ছিলেন যশোরের কমরেড কৃষ্ণবিনোদ রায় এবং দিনাজপুরের কমরেড বিভূতি গুহ। সেটি ঢাকায় এনে বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হতো। তবে দু’একটি জেলায় সরাসরি কলকাতা থেকে পাঠানো হত। কিন্তু মাস দুই চলার পর ‘ছায়াপথ’ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫১ সাল। তখন পার্টির অনেক নেতাকর্মীরাই জেলে অন্তরীণ। কেউ কেউ আত্মগোপনে আছেন। তখন পার্টির মুখপাত্র হিসেবে ‘সাপ্তাহিক জনতা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। পার্টির সদস্য দেওয়ান মাহবুব আলী তখন গণতন্ত্রী পার্টিতে কাজ করতেন। সে বছর ‘সাপ্তাহিক জনতা’র প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। তাতে শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভোগের কথা দেখাতেই প্রতিক্রিয়াশীল সরকার তা বন্ধ করে দেয়। সব কপি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং পত্রিকার প্রকাশানুমতি বাতিল করে দেয়া হয়। তাই বুঝতে বাকি থাকে না যে কুচক্রী মুসলিম লীগ সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে কোনো নামেই প্রকাশ্যে পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি দিবে না। তাই ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনের সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে পার্টি ‘মার্কসপন্থী’ নামে একটি গোপন পত্রিকা প্রকাশ করে। সাইক্লোস্টাইল করা এ-পত্রিকাটি গোপনে শুধু পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রচারিত হয়েছে। ফলে পার্টির মধ্যে তত্ত্বগত দিকটির প্রচার হলেও ব্যাপক জনগণের মাঝে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ঐতিহাসিক জয় লাভ করে। দেশে অনেকটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সে সময় পার্টির একজন দরদি বন্ধু খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস তাঁর ‘সাপ্তাহিক যুগের দাবি’ নামক পত্রিকাটি প্রেসসহ পার্টিকে দান করেন। পার্টি তা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে। গোপনে কমরেড বারীণ দত্ত ও খোকা রায় এবং প্রকাশ্যে আলী আকসাদ, খোন্দকার গোলাম মোস্তফা এবং জহির রায়হান পত্রিকাটি পরিচালনা ও সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অর্থের সংকট থাকলেও পার্টির পরিচালনায় পত্রিকাটির প্রচার ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে সেটি প্রচারিত হতো বামপন্থী প্রগতিশীল পত্রিকা হিসেবে। কিন্তু তাও বেশিদিন চালানো সম্ভব হয়নি। যুক্তফ্রন্ট সরকার বরখাস্ত, পার্টি বে-আইনি ঘোষিত হলে তাও আবার বন্ধ হয়ে যায়। গোপনে ‘মার্কসপন্থী’ পত্রিকাই চলতে থাকে। ১৯৫৬ সালে ‘একতা’ প্রকাশের একটি উদ্যোগের কথা বলেছেন বরেণ্য সাংবাদিক কে. জি. মোস্তফা। ‘প্রথম জন্মের কথা’ বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘... ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে আমি জামিন পেয়ে জেল থেকে বের হয়ে আসি। তখন সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত ও আমাকে নিয়ে একটি গ্রুপ করে মুখপত্র বের করার দায়িত্ব দেয়া হয়। নামও ঠিক হল ‘একতা’। সাপ্তাহিক হিসেবে বের হবে। এর জন্য নিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের কাছে অনুমতি চাওয়া হল। কিন্তু জেলা প্রশাসক অনুমতি দিলেন না। তারপর ও আমরা সাপ্তাহিক ‘একতা’র প্রথম সংখ্যাটি বের করে ফেললাম। বের হওয়ার সাথে সাথেই বাজেয়াপ্ত। সেই এক সংখ্যাই। এরপর আর বের করা যায়নি।... ’ ১৯৫৮ সালে স্বৈরাচার আয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে কঠিন কঠোর শাসন পাকাপোক্ত করে। সে সময় পার্টির মুখপত্র ‘মার্কসপন্থী’ নাম বদল করে ‘শিখা’ রাখা হয়। এবং তা জেলায় জেলায় পাঠানো হয়। সেখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি নিয়ে বিভিন্ন মূল্যবান প্রবন্ধাদি প্রকাশিত হয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে এদেশের মানুষ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ফুসে ওঠে। এ ব্যাপারে ছাত্ররাই ছিল অগ্রবর্তী বাহিনী। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টিতে আওয়ামী লীগের ৬-দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ১১-দফা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতেই লৌহমানব আয়ুব খান ধরাশায়ী হন। সারাদেশে সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন আরেক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান। সামরিক শাসন জারি থাকলেও সারাদেশে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করে। ইতোমধ্যে কারাগার থেকে সকল রাজবন্দিরা মুক্তি লাভ করেছেন। জনমনে অনেকটা স্বস্তির ভাব ফিরে এসেছে। সে সময় পার্টির নেতৃত্ব ‘সাপ্তাহিক একতা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। বরেণ্য সাংবাদিক বজলুর রহমানের নামে ‘ডিক্লারেশন’ নেয়া হয়। একতার সম্পাদনা ও পরিচালনার জন্য পার্টির নেতৃত্ব কমরেড খোকা রায়, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, বজলুর রহমান ও মতিউর রহমানকে নিয়ে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি সম্পাদকীয় বোর্ড গঠন করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া আরো কয়েকজন কর্মীকে নিয়ে গঠিত হয়েছিলো ‘একতা’ পরিচালনা টিম। ‘একতা’ ছাপানোর জন্য পার্টির একজন ঘনিষ্ঠ সমর্থক একটি প্রেসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ফলে ১৯৭০ সালের ৩১ জুলাই থেকে একতা বের হতে শুরু করে। যদিও কয়লা শ্রমিকের ন্যায় কালি-কুলি অবয়ব নিয়ে ‘একতা’ আত্মপ্রকাশ করে। তা অচিরেই গণমানুষের দৃষ্টিআকর্ষণ করে; তাকে দেখায় নয় লেখায়। ‘একতা’র লেখা থেকেই মানুষ তাদের প্রিয় একতাটিকে চিনে নিতে পারেন। সমাজের রোগ নির্ণয় করে সেদিনকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় স্তম্ভে লেখা হয়েছিলো– ‘সামজকে যাহারা খাদ্য জোগায়, কলকারখানা ও সমাজের যাবতীয় উৎপাদন যাহারা চালু রাখে, যাহাদের শ্রমের উপর গোটা সমাজটা দাঁড়াইয়া আছে, তাহারাই আজ শোষিত,নিপীড়িত। শিক্ষা-দীক্ষায় সমস্ত আলোক হইতে বঞ্চিত। এই শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য যাহারা কাজ করেন তাঁহাদের ওপরই নামিয়া আসে দমননীতির আঘাত। অপরদিকে মুষ্টিমেয় দেশি ও বিদেশি শোষক ঐ মেহনতি মানুষগুলোকে শোষণ করিয়া ভোগবিলাসে জীবন যাপন করে।’ আর এই সামাজিক রোগের ঔষধ বাতলে একই সম্পাদকীয় স্তম্ভে বলা হয়েছে – ‘এই অবিচারমূলক ও শ্রেণি-শোষণযুক্ত সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, দেশের জনগণের মুক্তি ও অর্থনীতির অবাধ উন্নয়নের জন্য মৌল প্রয়োজন হইল শোষক শ্রেণিগুলোকে ক্ষমতার আসন হইতে অপসারণ, শ্রমিক-কৃষকদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্তব্যগুলো সম্পাদন, সামাজিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা।’ তারপর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বভাবত একতা প্রকাশ বন্ধ থাকে। তবে এসময় পার্টির মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামক পত্রিকাটি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সাপ্তাহিক একতা আবার প্রকাশিত হতে শুরু করে। তারপরও একতা দু’বার প্রকাশনা বন্ধ ছিলো–একবার ১৯৭৫ সালে এবং আর একবার নব্বই এর দশকের প্রথম দিকে বিলোপবাদীদের চক্রান্তের সময়ে। তবে ১৯৯৬ সাল থেকে শত বাধা-বিঘ্নের মধ্যেও একতা প্রকাশ হতে শুরু করে যা আজও চলছে। আশা করা যায় একতাকে আর কোনোদিন থামতে হবে না। কারণ চিহ্নিত করে একতার এক পুরনো কর্মী এখন স্বনামধন্য সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন লিখেছেন– ‘... আমাদের অর্থবল, সম্পদবল কম, কিন্তু বিপ্লবী স্পৃহা, শোষিতের মু্িক্তসংগ্রামের ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধ ও শ্রম দিয়ে আমরা ঐ অভাব পূরণের চেষ্টা করি। ...’ একতার লেখক, কর্মী ও পাঠকরাই তো একতার প্রাণ। একতার একালের এক একনিষ্ঠ কর্মী লিখেছেন – ‘একতার সাথে আমার পথচলা ২২ পেরিয়ে ২৩ বছরে পড়ল। বাকি সময়টাও হয়তো এখানেই দিতে হবে। কারণ এ জীবনের সাথে একতা’র সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য হয়ে পড়েছে। একতা ছাড়া আর কোনো কিছু নিয়ে ভাববার সময় আর নেই। জীবনের প্রায় দুই যুগ তো এখানেই পার করে দিলাম; কিছু পাওয়ার বা চাওয়ার নেই। শুধু পত্রিকাটি যেন নিয়মিত পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারি সেই কামনাই করি।’ একতা’র জয় হোক। সংগ্রামী মেহনতি মানুষের বিজয় সুনিশ্চিত। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। তথ্য সংযোজন ১) একতা, পটভূমি ও ভূমিকা – খোকা রায়, সাপ্তাহিক একতা, ৮ আগস্ট’ ১৫। ২) প্রথম জন্মের কথা – কে. জি. মোস্তফা – সাপ্তাহিক একতা, ৩ আগস্ট’ ০৮। ৩) একতার এক দশক – মোজাম্মেল হোসেন, সাপ্তাহিক একতা, ৩০ জুন’ ১৭। ৪) একতার সাথে পথচলা – মোসলেম উদ্দিন, সাপ্তাহিক একতা, ১৯ আগস্ট’ ১৮। লেখক : লেখক ও প্রবন্ধকার।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..