ছাত্র রাজনীতি, অঙ্গসংগঠন, গণসংগঠন নিয়ে কিছু কথা
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
১.
ছাত্র ইউনিয়ন তার ৭০ বছর অতিক্রম করেছে। আগামী ২৬ এপ্রিল সে ৭১ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। দু’দিন আগে তার ৪১তম ঐক্যবদ্ধ জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন হয়ে গেল। ছাত্র ইউনিয়ন যে একটি ‘গণসংগঠন’। সে কথা জানলেও অনেকের মাঝেই তা নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি আছে। এ বিষয়ে ধারণা স্বচ্ছ থাকা প্রয়োজন। সেকারণে ছাত্র রাজনীতি, অঙ্গসংগঠন, গণসংগঠন নিয়ে কিছু বিষয় আলোচনা করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না ভেবেই তা নিয়ে আজ দু’কথা লিখছি।
আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা নিজেদেরকে ‘ছাত্র আন্দোলনের’ কর্মী বলে পরিচয় দিতাম, কখনই নিজেদেরকে ‘ছাত্র রাজনীতির’ কর্মী বলতাম না। শ্রমিকের অধিকার আদায়ের কর্মকাণ্ডকে সবাই শ্রমিক আন্দোলন বলে, কখনই তাকে শ্রমিক রাজনীতি বলা হয় না। একইভাবে নারী, যুব, শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক প্রভৃতি সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের অধিকার আদায়ের কর্মকাণ্ডগুলোকে নারী আন্দোলন, যুব আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন, আইনজীবী আন্দোলন ইত্যাদি বলেই আখ্যায়িত করা হয় এবং কখনই সেগুলোকে নারী রাজনীতি, যুব রাজনীতি, আইনজীবী রাজনীতি, সাংবাদিক রাজনীতি ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করা হয় না। অথচ কেবলমাত্র ছাত্র সমাজের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে কেন এবং কিভাবে যে ‘ছাত্র আন্দোলনের’ বদলে ‘ছাত্র রাজনীতি’ নামে, তথা ‘রাজনীতির’ একটি বিশেষায়িত রূপ হিসেবে চিত্রায়িত হওয়া শুরু হলো, তা বেশ কৌতুহল উদ্দীপক একটি ব্যাপার বটে।
১৯৭৬ সালে জেনারেল জিয়া মিলিটারি বুদ্ধিপ্রসূত রাজনৈতিক দল বিধির ফরমান জারি করেন। তাতে সব রাজনৈতিক দলের জন্য ছাত্র, শ্রমিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিজ নিজ দলীয় অঙ্গসংগঠনের নাম ঘোষণা করাটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এ বিষয়ে ঘোষণা না দিলে রাজনৈতিক দলকে তৎপরতা চালানোর সুযোগ দেয়া হবে না এবং সংশ্লিষ্ট ছাত্র, শ্রমিক ইত্যাদি সংগঠনের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হবে বলে এই বিধিতে বলা হয়েছিল। এ নির্দেশের পক্ষে যুক্তি দেয়া হয়েছিল যে, ছাত্র, শ্রমিক ইত্যাদি সংগঠনের তদারকির কষ্টসাধ্য কাজ সরাসরি সরকারের আওতায় না রেখে, এসব অঙ্গসংগঠনগুলোর কাজের জবাবদিহিতার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের উপর রাখলে, শুধু মূল রাজনৈতিক দলটির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেই দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হবে। এ আদেশের ফলে স্বাধীন ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাতারাতি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত করা হয়েছিল।
রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন বনে যাওয়ায় মুরুব্বি দলের শক্তি-সবলতার পাশাপাশি তার সব রুগ্নতা ও অধঃপতনের ধারা ষোলআনা পরিমাণে সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলোকেও গ্রাস করে ফেলেছিল। ‘বাজার অর্থনীতির’ দর্শন অনুসরণকারী তথাকথিত বড় দল দু’টি ‘বাজার রাজনীতির’ দুরাচারে নিমজ্জিত হয়ে রাজনীতিতে যে বাণিজ্যিকীকরণ ও দুর্বৃত্তায়নের সর্বগ্রাসী প্রলয় সৃষ্টি করেছিল, তা সরাসরি প্রবিষ্ট হয়েছিল তাদের নিজ নিজ অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলে। তারা ছাত্র আন্দোলনের ধ্রুপদী ঐতিহ্য বিনষ্ট করেছিল এবং উভয়ই প্রধানত চর দখলের কায়দায় হল দখল, টেন্ডার বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, লুটপাট, ক্যাডারের নামে দুর্বৃত্তদল লালন, ধর্ষণে সেঞ্চুরি করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি নিকৃষ্টতম অপতৎপরতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। ক্রমেই তাদের প্রধান ভূমিকা হয়ে উঠেছিল দলের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত, উপদলীয় তৎপরতা ও যাবতীয় অপকর্মের পেশিশক্তি হিসেবে কাজ করা। সাধারণ ছাত্রসমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অভাব-অভিযোগ কিংবা শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা-সঙ্কটের বিষয়গুলো থেকে এই দুটি ছাত্র সংগঠন প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে মাস্তানতন্ত্রের দুই পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে পরিণত হতে শুরু করেছিল। এদিকে, এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মৌলবাদী শিবিরচক্র হাত কাটা, রগ কাটা, ছাত্র-শিক্ষক হত্যা করা, বোমাবাজি ইত্যাদি দুষ্কর্মগুলো ক্রমাগত জোরদার করার সুযোগ করে নিচ্ছিলো। এহেন প্রবল প্রতিকূলতা ও উল্টো স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছাত্র ইউনিয়ন এবং আরো কয়েকটি বামপন্থি ছাত্র সংগঠনকে ছাত্র আন্দোলনের সুস্থ ধারা ও ধ্রুপদী ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছিল।
ছাত্র ইউনিয়ন কখনই কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন ছিল না, এখনো কারো অঙ্গসংগঠন নয়। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দলবিধি জারি হওয়ায় বাধ্য হয়ে তাকে একটি রাজনৈতিক দলের সাথে নাম লেখাতে হয়েছিল। সেজন্য প্রথমে সে ন্যাপকে ছাত্র ইউনিয়নের নামটি তার অঙ্গসংগঠন হিসাবে উল্লেখ করার জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু ন্যাপ তাতে রাজি না হওয়ায় তাকে সিপিবির শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। সিপিবি তাতে রাজি হয়েছিল এই শর্তে যে, এটা শুধু আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং প্রকৃতপক্ষে ছাত্র ইউনিয়নকে স্বাধীন গণসংগঠন হিসাবে কাজ করে যেতে হবে।
২.
‘ছাত্র রাজনীতির’ নামে এখন যা চলছে তা থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হতে পারে, তা নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন যে, ছাত্র-ছাত্রীদেরকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখলেই সমস্যাটির সমাধান হয়ে যাবে। একথা মোটেই সঠিক নয়। ব্রিটিশ শাসকরা, আইয়ুব-মোনায়েমসহ পাকিস্তানি শাসকরা এবং বিভিন্ন সময় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী, সাম্রাজ্যবাদের অনুচররা বহুবার এই ফর্মুলা দিয়েছে এবং তা প্রয়োগেরও চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। ছাত্র রাজনীতির নামে যে দুরাচার এখন চলছে তার জন্য দায়ী সাধারণ ছাত্ররা নয়, বা দোষ ছাত্র আন্দোলনেরও নয়। সঙ্কটটি বড় আকারে শুরু হয়েছে তখন থেকে যখন আইন করে অঙ্গসংগঠন করার এবং একই সময়ে লুটেরা ধনতন্ত্রের ধারাকে রাষ্ট্রীয় নীতি ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শিক ধারায় পরিণত করা হয়। এই রুগ্ন দুরাচারের উৎস হলো লুটপাটতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ নির্ভরশীলতা, বাণিজ্যিকীকরণ, ভোগবাদ, প্রদর্শনবাদ, দুর্বৃত্তায়ন ইত্যাদির জন্মদাতা তথাকথিত বাজার অর্থনীতি ও পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন নির্ভর আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। অপারেশন যদি কোথাও করতে হয় তবে তা এই লুটেরা অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে করতে হবে। ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র সংগঠনকে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত করে তাকে তার স্বাভাবিক, স্বকীয় ও ঐতিহ্যমণ্ডিত ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে যে ‘দলীয়করণ করা’ এবং ‘রাজনীতি করা’ এক জিনিস নয়। ছাত্র সংগঠনগুলোকে দলীয় লেজুড়বৃত্তিতা থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন। এটা একটি গণতান্ত্রিক প্রস্তাব। কিন্তু ছাত্রদের লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলন-রাজনীতি করার অধিকার হরণ করাটা হবে গুরুতর অন্যায়। সেটা হবে অবশ্যই একটি স্বৈরতান্ত্রিক প্রস্তাব।
৩.
সমাজের অন্যান্য অংশের মতো ছাত্রসমাজেরও আলাদা একটা সত্ত্বা আছে। ছাত্র সত্ত্বার ভিত্তিতে তাদেরও নিজস্ব আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়া আছে। ধর্ম-বর্ণ-রাজনৈতিক মতাদর্শ এমনকি দলীয় আনুগত্য নির্বিশেষে তাদের এই ছাত্র পরিচয়ের ভিত্তিতেই গড়ে তুলতে হবে তাদের আন্দোলন-সংগঠন। ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য তাদের থাকা উচিত নিজস্ব একটি প্লাটফর্ম। সেই প্লাটফর্ম থেকেই পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন গোটা ছাত্রসমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ও সমস্যা-সঙ্কট সমাধানের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। সেই প্রয়াসে সফলতার প্রধান গ্যারান্টি হলো ছাত্রসমাজের একতা। সুতরাং বাস্তব স্বার্থের বিচারে যেমন- তেমনই তাদের সংগ্রামী প্রয়াসের সফলতার নিশ্চয়তার জন্যও ছাত্র সংগঠনের হওয়া উচিত জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্য-রাজনৈতিক দর্শন-ভাবাদর্শ নির্বিশেষে ব্যাপক ছাত্রসমাজের সাধারণ স্বার্থ রক্ষায় সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। তার একটি প্রধান লক্ষ্যই হলো ছাত্রসমাজকে তার সাধারণ স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ করা। দলমত-আদর্শ ও ধর্ম-বর্ণ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে গঠিত সংগঠনকেই গণসংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
ক্লাসরুমের ভাঙা বেঞ্চ-ব্লাকবোর্ড মেরামত করা, পর্যাপ্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা, বই-কাগজ-কলমের দাম ক্রয়সীমার মধ্যে রাখা, হল-হোস্টেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনা ও মান উপযুক্তভাবে উন্নত করা, খেলার মাঠের সংস্কার করা– দৈনন্দিন শিক্ষা জীবনের এসব ইস্যুগুলো প্রত্যক্ষভাবে ছাত্রসমাজের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়। তাছাড়া, গণমুখী ও প্রগতিশীল শিক্ষানীতি, শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্যের অবসান, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার প্রয়াস রোধ, সাম্প্রদায়িকতা-কুপমণ্ডূকতা থেকে সিলেবাসকে মুক্ত করা, শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ– এসব ছাত্রসমাজের সরাসরি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়।
কিন্তু একথাও সত্য যে শিক্ষানীতিসহ উল্লেখিত অনেক বিষয়ের সাথে রাষ্ট্রনীতির বিষয়গুলো সরাসরি সম্পর্কিত। যেমন নিজস্ব শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তা, গরিব বন্ধুকে সহপাঠী হিসাবে অব্যাহতভাবে সঙ্গে পাওয়ার সুযোগ, পড়াশুনায় পূর্ণ মনোনিবেশের স্বার্থে বাবা-মা-ভাই-বোনের অসহায় দরিদ্রের আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি– এসবের সাথে দেশের আর্থিক অবস্থা ও অর্থনৈতিক নীতি ও ব্যবস্থা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। ছাত্র হিসেবে জ্ঞান অন্বেষণের জন্য মুক্তচিন্তার অধিকার অপরিহার্য এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার নিশ্চয়তা মুক্ত চিন্তার জন্য অত্যাবশ্যক শর্ত। তাছাড়া শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শুধু বইয়ের পোকা বানানো নয়। প্রকৃত দেশপ্রেম, মানবিক মূল্যবোধ, মননশীলতা, সৃজনশীল প্রতিভার জাগরণ ঘটিয়ে প্রত্যেককে দেশ গড়ার ও মানব সভ্যতা নির্মাণের কারিগর হিসাবে গড়ে উঠতে সহায়তা করা এগুলো হলো শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এসব বিবেচনায় সমগ্র ছাত্র সমাজের সরাসরি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, শোষণমুক্তি, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য থেকে নিষ্কৃতি, দেশপ্রেম, উদার মানবিকতা, প্রগতিমুখীনতা, বিজ্ঞানমনস্কতা– এসব বিষয় ও উপাদানগুলোও ছাত্রসমাজের সাধারণ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়। এসব বিষয়কে ভিত্তি করেই রচিত হতে পারে ছাত্রসমাজের জন্য একটি ন্যূনতম কর্মসূচি যা কিনা দল-মত ও ধর্ম-বর্ণ পরিচয় নির্বিশেষে সব ছাত্র-ছাত্রীকে একতাবদ্ধ করতে পারে। এবং সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই প্রতিষ্ঠা পেতে পারে ছাত্রসমাজের জন্য একটি মাত্র সংগঠন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হয়ে থাকলে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার এই লক্ষ্য কখনই অর্জিত হতে পারে না।
সুতরাং দেখা গেল যে, ছাত্রসমাজের নিজস্ব আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার অনেক কিছুই সরাসরি রাজনীতি সম্পৃক্ত বিষয়। কিন্তু রাজনৈতিক হলেও সেগুলো কোনোক্রমেই নিছক দলীয় কোনো বিষয় শুধু নয় এবং সেগুলো কোনো দলীয় অথবা মতাদর্শগত উৎস থেকে আরোপিত নয়। সুতরাং ছাত্রসমাজের সাধারণ স্বার্থেই (নিছক দলীয় আনুগত্য থেকে নয়) ছাত্র সমাজকে রাজনৈতিক ইস্যুতে তৎপর হতে হবে। তবে রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আন্দোলন ও তৎপরতার বিষয়টি যেখানে কিনা প্রত্যক্ষ, ছাত্র সংগঠনের ক্ষেত্রে তা তার ছাত্রত্ব ও শিক্ষা জীবনের সমস্যাকে ভিত্তি করে পরোক্ষভাবে যুক্ত। পরোক্ষ হলেও, ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকার সেকারণেই ছাত্র সমাজে প্রত্যক্ষ স্বার্থ আদায়ের প্রশ্নের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছাত্র সংগঠনকে রাজনীতি মুক্ত করার প্রচেষ্টা সে কারণেই ছাত্রসমাজের স্বার্থের উপর আঘাত হানার প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র ব্যতিত আর কিছুই নয়। একইসাথে, ছাত্র সংগঠনকে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত করার প্রয়াসটি ছাত্র সমাজের প্রকৃত স্বার্থে একটি প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক পদক্ষেপও বটে। দলীয় লেজুড়বৃত্তি করাকে- ‘না’ বলতে হবে! রাজনীতি করার অধিকারকে- ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে! এটাই হচ্ছে যুক্তির কথা, কল্যাণের কথা, গণতন্ত্রের কথা।
এক্ষেত্রে অন্য একটি সম্ভাব্য ভ্রান্তি সম্পর্কেও সতর্ক থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে যে, দেশের একজন নাগরিক হিসাবে অন্য সকলের মতো প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীরও রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল করার অধিকার আছে। সেটা বন্ধ করা যেতে পারে না। তবে রাজনীতি করার এই নাগরিক অধিকার এবং ছাত্র সংগঠনকে রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত করা- এই দু’টি বিষয় এক নয়। ছাত্ররা রাজনৈতিক দল করতে পারবে এবং তা করাটা উৎসাহিত করা উচিত। তার দ্বারা রাজনৈতিক চেতনার মান ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি মজবুত হবে। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে দলের কাজকে ছাত্র সংগঠনের কাজের সাথে গুলিয়ে ফেলা সঠিক হবে না। যা সঠিক হবে তা হলো- যে কোনো ছাত্র রাজনৈতিক দল করতে পারবে এবং তা উৎসাহিত করা উচিত। কিন্তু ছাত্র সংগঠনকে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত করার চেষ্টা সঠিক নয়।
৪.
ছাত্র ইউনিয়ন তার জন্মলগ্ন থেকেই ছাত্রসমাজের একটি একক ঐক্যবদ্ধ গণসংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরলসভাবে চেষ্টা করেছে। শুধু ‘ছাত্র ঐক্য’ প্রতিষ্ঠার পক্ষে চেতনা জাগরিত করার জন্যই সে তার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে ক্ষান্ত হয়নি। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কয়েকবারই ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ এই দুটি সংগঠনকে একীভূত করে একক সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এ ধরনের দুটি ঐতিহাসিক ঐক্য প্রয়াসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
একসময় ‘মুসলিম ছাত্র লীগে’ শুধু মুসলমান ছাত্রদের যোগদানের সুযোগ থাকায় তা সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট ছিল। কিন্তু ১৯৫৪ সালে সে যখন অসাম্প্রদায়িক চরিত্র গ্রহণের করার কথা চিন্তা করে ফেলেছে তখন ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ ছাত্র সংগঠন দুটিকে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। আলোচনা করে একথা স্থির করা হয়েছিল যে, ১৯৫৪ সালের ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন পৃথক পৃথক সম্মেলনে মিলিত হবে এবং উভয় সংগঠনই একীভূত হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করবে। পরের দিন অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি দুই সংগঠনের উদ্যোগে ঐক্যবদ্ধ সম্মেলনে একীভূত সংগঠনের ঘোষণা দেয়া হবে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও শেষ মুহূর্তে সোহরাওয়ার্দি সাহেবের দ্বিমতের কারণে একীভূত সংগঠনের ঘোষণা দেয়া হয়নি। তার পরিবর্তে ঐক্য প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার জন্য ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল সেদিনের একীভূত হবার উদ্যোগ।
অতঃপর, ’৫৪ শেষের দিকে ছাত্র ইউনিয়ন আরেকবার একীভূত হবার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এবার আলোচনা করে ঠিক করা হয়েছিল যে, পৃথক পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উভয় সংগঠন নিজ নিজ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করবে। পরবর্তী সময়ে আরেকটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঐক্যবদ্ধ কমিটি ঘোষণা করা হবে। প্রয়াত জহির রায়হান এই উদ্যোগের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। সমঝোতা অনুসারে ছাত্র ইউনিয়ন সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিজেদের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করলেও ছাত্রলীগ তার কমিটির বিলুপ্তি সংক্রান্ত কোনো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি না পাঠিয়ে পরদিন বলতে থাকে, যেহেতু এখন ছাত্র ইউনিয়নের কমিটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে তাই সবাই এখন ছাত্রলীগে যোগদান করলেই ঐক্যবদ্ধ সংগঠন গড়ার লক্ষ্য পূরণ হয়ে যাবে। এভাবে সেবারও ছাত্রলীগের ছলচাতুরির কারণে ছাত্রসমাজের জন্য একটা মাত্র ছাত্র সংগঠন গঠনের উদ্যোগ আবারো বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
স্বাধীনতার পর ’৭২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র ইউনিয়নের দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই ছাত্র সম্মেলনের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুসহ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের মূল নেতারা প্রকাশ্যে বক্তৃতায় বলেছিলেন, দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে এবং স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতি ঘোষিত হয়েছে। এখন আর ছাত্রদের পৃথক দুটি সংগঠন রাখার প্রয়োজন নেই। চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন একীভূত হয়ে এক সংগঠনে পরিণত করা হোক। জবাবে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ এ আহ্বান নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, এক সংগঠনে পরিণত না হয়ে দুই সংগঠনের মধ্যে প্রতিযোগিতা বজায় রাখাই হবে দেশের জন্য মঙ্গলজনক। এর জবাবে ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ বলেছিলেন, প্রতিযোগিতা নিশ্চয়ই হবে, তবে সে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নিরক্ষরতা, দারিদ্র্য, সাম্রাজ্যবাদ, মৌলবাদসহ দেশ-জাতি-জনগণ ও ছাত্রসমাজের শত্রুদের বিরুদ্ধে। ছাত্রসমাজকে একতাবদ্ধ হয়ে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে দেশ গড়ার সেই নতুন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। ছাত্র ইউনিয়ন সেই আসল শত্রুর মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ সংগঠন গড়ার আহ্বান জানাচ্ছে। ছাত্রলীগ এই যুক্তির জবাব দিতে পারেনি। তারা ঐক্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরে পরেই গৃহীত সে দিনের এই ঐক্য প্রচেষ্টাও সফল হয়নি।
ছাত্র ইউনিয়ন ‘ছাত্র ঐক্যের’ সেই সংগ্রামী আহ্বান ও তার ঐতিহ্য, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে বিপুল প্রতিকূলতার মাঝে আজও কাজ করে যাচ্ছে। ছাত্র ইউনিয়নকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়েই ‘ছাত্র রাজনীতির’ নামে বর্তমানে যে ভয়ঙ্কর দুরাচারের জন্ম হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণের পথ বের করা সম্ভব। দলীয় নিয়ন্ত্রণ ও ভ্রষ্টাচার মুক্ত সুস্থ ধারার ছাত্র আন্দোলন বিকশিত করাতে হলে এটিই এখন প্রধান কর্তব্য।
৫.
ছাত্র-ছাত্রীদের আরও বেশি করে ‘রাজনৈতিকভাবে’ সচেতন ও নিজ-নিজ পছন্দের রাজনৈতিক দলে সক্রিয় হতে হবে। একইসাথে অঙ্গসংগঠন হিসেবে ভূমিকা পালন ও দলীয় লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো যে অধঃপতনে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে তা থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে ছাত্রদের রাজনীতি, আন্দোলন, সংগঠন ও রাজনীতি করার অধিকার ও কর্তব্য কোনোভাবেই ক্ষুন্ন করা চলবে না। ছাত্রদের সংগঠন, আন্দোলন ও রাজনীতি করার পূর্ণ অধিকার অবারিত করতে হবে এবং তার প্রয়োজনেই ছাত্র সংগঠনকে হতে হবে দলীয় প্রভাবমুক্ত এবং লেজুড়বৃত্তির কালিমামুক্ত।
বিশেষ রচনা
সংবিধান নিয়ে সিপিবির ভাবনা
Login to comment..