কর্তৃত্বপরায়ণ গণতন্ত্রের গতিপ্রবণতা ও ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র থাকলে অধিকাংশ মানুষ ভোট দিয়ে এমন সরকার আনত, যে সরকার লুটেরাদের প্রশ্রয় না দিয়ে জনগণের সেবাকে অধিকতর গুরুত্ব দিত। কিন্তু আমাদের দেশে যে ভোটের গণতন্ত্র ১৯৯০ সালের পরে জন্ম নিয়েছে, তার অনেক নেতিবাচক দিক রয়েছে। এর আগে ১৯৭১-৭৫ কালপর্বেও ন্যূনতম উদারনৈতিক এক ধরনের গণতন্ত্র ছিল। ১৯৭৫ সালে সাংবিধানিক ভাবেই তার ভাষায় ‘শোষিতের গণতন্ত্রে’ পরিণত করার উদ্যোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে নিহত হন। আবার ১৯৭৫-৯০ কালপর্বে ছিল লেবাসি গণতন্ত্র। ৯০ এর পর কিছুদিন চালু ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বিদলীয় গণতন্ত্র। সব শেষে চালু হয়েছে বর্তমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় অনুদার বা কর্তৃত্বমূলক (ওষষরনবৎধষ ধহফ অঁঃযড়ৎরঃধৎরধহ) গণতন্ত্র। সব মিলিয়ে আমাদের ভোটের গণতন্ত্র ফলপ্রসূ বা সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এ ধরনের সংকুচিত ভোটের গণতন্ত্র এমনকি আদর্শ বুর্জোয়া গণতন্ত্রও নয়। কোনো কোনো উন্নত পুঁজিবাদী দেশে বিদ্যমান এ ধরনের সীমিত ভোটের গণতন্ত্রকে ওষষরনবৎধষ উবসড়পৎধপু বা অঁঃযড়ৎরঃধৎরধহ জঁষব বলে। অর্থাৎ এমন তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ আছে যাকে ‘অনুদার গণতন্ত্র’ বা ‘কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন’ বলা হয়। এখানে যে কর্তা গণতন্ত্রের চর্চা করছেন বা যে দল গণতন্ত্রের চর্চা করছে, সেই দল বা তিনি নিজে তার দলের ভেতর থেকেই কর্তৃত্বপরায়ণ একজন কর্তা হিসেবে নানা কারণে উঠে আসেন। তার কর্তৃত্বের অধীনে অনেকেই আছেন। বাংলাদেশে সম্প্রতি এধরনের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হয়ে গেছে এই কারণে যে, এখানে প্রধান বিরোধী দল বা সরকারি দল উভয়ই এ দেশে কর্তৃত্বপরায়ণ দুটি দল। উভয়েই দেশে অনুদার গণতন্ত্র চালাতে ইচ্ছুক। তাই মানুষের কাছে ‘চয়েস’ হচ্ছে এই কর্তৃত্ব বা ওই কর্তৃত্ব। তাই এখানে অনুদার গণতন্ত্র স্থায়ী হয়ে গেছে। একজনের কর্তৃত্বপরায়ণ রাজত্ব যদি মানুষ অস্বীকার করে তবে আরেকজনের কর্তৃত্বপরায়ণ রাজত্ব আসে। কে এমপি পদে মনোনীত হবে, কাকে উচ্চ পদ দেওয়া হবে সব নির্ধারিত হচ্ছে অগণতান্ত্রিকভাবে, কখনো কখনো টাকা-পয়সা, স্বজনপ্রীতি ও সচরাচর শীর্ষ কর্তৃত্ব দ্বারা। তবে এই দুই দলে কর্তৃত্বে যে দুজন আছেন তাদের মধ্যে কে বেশি উদার এসব বিচার করে কখনো কখনো মানুষ একটি দলে আসে, আবার অসহ্য হয়ে গেলে আরেকটি দলে যায়। এভাবেই এতদিন চলে আসছে। ফলে ১৯৯০ সালের পর থেকে কর্তৃত্বপরায়ণ অনুদার গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্র ও সমাজ কখনোই রক্ষা পায়নি। তবে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটির কৃতিত্ব হচ্ছে যে ইতোমধ্যে তারা তাদের ক্ষমতা যথেষ্ট সংহত করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন এবং বিরোধী দলের তথাকথিত কর্তৃত্বের দুই আইকন মাতা-পুত্রের ভাবমূর্তিও ধ্বংস করে দিয়েছেন। এর ফলে দ্রুত নতুন ইতিবাচক প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব না হলে বিদ্যমান কর্তৃত্ববাদের প্রবণতা একতরফা আরো শক্তিশালী হবে। কর্তৃত্বমূলক গণতন্ত্রের ট্র্যাজেডির মধ্যে থেকেই সম্প্রতি বাংলাদেশের যতটা উন্নতি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি উন্নয়ন কিন্তু সম্ভব ছিল। এমনকি এ অবস্থায় বৈষম্যহীন উন্নয়নও সম্ভব হতে পারে যদি কঠোর রাষ্ট্রের (ঐধৎফ ঝঃধঃব) কর্তৃত্ব কিছুটা আলোকিত উদ্দেশ্য অভিমুখী হয়। আমাদের সামনে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামের উদাহরণ আছে। এক দলীয় রাজনৈতিক কঠোর কর্তৃত্ব যদি সুষম বণ্টনের দিকটা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত পরিবর্তনে আগ্রহী হয়, যদি অন্ধ দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে তার কর্তৃত্ব কিছুটা বিকেন্দ্রীভূত গণতান্ত্রিক পথে খাটিয়ে সাধারণ মানুষকে অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধির মধ্যে নিয়ে আসতে ইচ্ছুক হয় এবং সর্বোচ্চ কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকটি নিজে যদি অসৎ ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সক্ষম হয় অথবা লুঠেরাদের সুশাসনের অধীনে আনতে সক্ষম হয় তা হলে কর্তৃত্বপরায়ণতা যে ক্রমশঃ অন্ততঃ কিছুদিনের জন্য জনপ্রিয় ও ফলপ্রসু হয়ে উঠতে পারে তা এসব দেশের উদাহরণ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। চীনের শি-পিং বা সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান বা মালয়েশিয়ার মাহাথিরের সাম্প্রতিক দৃষ্টান্তটি অনেকে দেখিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে যে বিশেষ কর্তৃত্বপরায়ণ গণতন্ত্রের ধারা বিরাজমান তা সুশাসন ও সমতাকে একেবারে বাদ দিয়ে নিছক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কিছু পরিমাণে চরম দারিদ্র্য কমানোর দ্বারা ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন, সেটা মুশকিল। সেটা হয়তো মন্দের ভাল হিসাবে কিছুদিন পারবেন যদি দেখাতে পারেন যে, নিজস্ব কর্তৃত্বের চেয়ে অপর বিকল্পটি মোটেও উন্নততর নয় বরং আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু সেটাও কিছুদিনের জন্য টিকবে, দীর্ঘদিন নয়। তাই ভিন্ন আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতে চীনে বা দক্ষিণ কোরিয়ায় যা তখন সম্ভব হয়েছিল বর্তমানে বাংলাদেশে তা সম্ভব হবে না বলেই মনে হয়।
সম্পাদকীয়
মহান মে দিবস

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..