রফিক আজাদের কবিতা বিষয়ক কথকতা
ড. সৌমিত্র শেখর: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা কবি রফিক আজাদকে দেখতে গেলাম গত ২৬ জানুয়ারি, ২০১৬। সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, বাংলাভিশনের সিনিয়র প্রডিউসার মামুন খান। এর আগে এই মুক্তিযোদ্ধা-কবিকে উন্নত চিকিৎসা করানোর দাবিতে গুণীজনদের সঙ্গে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে দাবি তুলেছিলাম। “কবি রফিক আজাদকে বিদেশে পাঠাতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ” শিরোনামে বিভিন্ন পত্রিকায় বিবৃতিটি ২২ জানুয়ারি প্রকাশ পায়। বিবৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডা. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, শামসুজ্জামান খান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, সমরেশ দেবনাথ, নাট্যকার মামুনুর রশীদ, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনসহ আমরা বারোজন যুক্ত ছিলাম।
বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, তিনি শুধু কবিই নন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। সম্মুখ সমরে তিনি জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে তুলেছিলেন একাত্তরে। তাঁকে বাঁচাতে বিদেশে পাঠানো প্রয়োজন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। বিদেশে পাঠানোর জন্য আমাদের প্রচুর সময় আর সুযোগ দিয়ে নীরবে এই মুক্তিযোদ্ধা-কবি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে; আর দেশে রেখে গেলেন তাঁর অমর পঙক্তিমালা। গত ২৬ জানুয়ারি এই মুক্তিযোদ্ধা-কবিকে যখন দেখতে যাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে, চোখ ভিজে আসছিল অশ্রুতে। কতো আগে থেকে পরিচয় এই ছোটখাটো অতিবড় মানুষটির সঙ্গে! গিয়েছি তাঁর বিরিশিরিতে। তাঁর বিরিশিরি মানে, তিনি যখন উপজাতীয় কালচারাল সেন্টারের পরিচালক তখন।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে বইমেলার কর্ণধার যখন তিনি এবং যে বার সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মাঠে হলো- প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেইতো আড্ডা হতো। আহ্, এই কবির সান্নিধ্য কি ভোলা যায়? কখনো আমার কাঁধে হাত রেখে তিনি যখন কথা বলতেন, অগ্রজের আদর লাগতো গায়ে। সে কারণেই চোখটা ভিজে উঠেছিল প্রায় নির্বাক কবিকে দেখে। তাই হয়তো আইসিইউতেই খানিকটা চিৎকার করে আমি বলে উঠি: “রফিক ভাই, চিনতে পারছেন আমাকে? আমি সৌমিত্র শেখর!” কণ্ঠ শুনেই তিনি এগিয়ে দিলেন হাত। শক্ত করে ধরলেন। ঝাঁকাতে থাকলেন অনবরত। বুঝলাম, চিনতে পেরেছেন। কথা বলতে পারলেন না বটে, কিন্তু আমাকে চিনতে একটুও ভুল হয়নি এই চিরচেনা কবির। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ‘কর্তব্যরত’ ডাক্তার বললেন, কবি কথা বলতে পারেন না। আমরাতো জানি, আগেই কথা সামান্য জড়িয়ে যেত তাঁর। সান্তনা, তবুতো মাথাটি কাজ করছে কবির, চিনতে পারলেন! আমি আবার বললাম: “চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া..।” তিনি ছাড়লেন না হাত, কিন্তু অভিমানে চোখের পাতা নামালেন। আমার দুদিকের দুজন সাক্ষী আর সাক্ষী তরুণ ডাক্তারকুল। এ দুজন হলেন: বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, আর বাংলাভিশনের সিনিয়র প্রডিউসার মামুন খান। আমি তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তখন।
এরপর বড় অভিমানে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলেন কবি। আমি ধরেই রইলাম হাত। এ হাত আমাদের পরিচিত, ডিম-ফোটানো উষ্ণতা আমাদের অচেনা নয়, অজানা নয় বৃহত্তর মৈমনসিংহা-পুলার জেদ। তিনি নাকি স্ত্রী অধ্যাপক দিলারা হাফিজকে (ভাবিকে) আগেই বলেছিলেন...আমার জন্য দভিক্ষাদ করো না। এমন আত্মসম্মানী ছিলেন আমাদের কবি। সত্যিতো কবির জন্য সামান্য ভিক্ষা কেন? আমি সেদিন ফেসবুকে লিখেছিলাম: কবিকে নিতে হবে রাজবৈদ্যের কাছে, নিয়ে যাবেন রাজা, উড়িয়ে নেবেন পঙ্খীরাজে করে আর তিনি থাকবেন অমরাবতীর সব সুবিধার আওতায়। আমরা তাঁর জন্য রাজদরবারে এই প্রার্থনা করি। মনে রাখতে হবে, কবি শুষ্ক কণ্ঠে থাকলে সে দেশে খরা হয়; কবিকে দুঃখ দিলে সে দেশে অগ্নিজ্বালা বইতে থাকে; আর কবির অসুখ হলে সে দেশে কেউ সুখে থাকে না। আমরা সুখে থাকতে চাই বলেই মনে করি কবির অসুখ দূর হোক। হে মহামান্য রাজাধিরাজ, আমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। আমাদের মনোবাসনা পূর্ণ হয়নি।
সময়ই প্রমাণ করবে রফিক আজাদ (১৯৪৩-২০১৬) বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন; ষাটের দশকের তো বটেই। তাঁর কবিমানসের বিবর্তন স্পষ্ট, সুগঠিত ও প্রগতিমুখি। ১৯৬৩ সালে যে উত্তালতা নিয়ে ‘স্বাক্ষর’ সম্পাদনা করেছিলেন, সেই কাব্যিক প্রণোদনা নিয়ে জীবনের উত্তাপ শিকড় বিস্তারী হয় কবির উত্তরজীবনে। ‘এক জীবনে’ কাব্যগ্রন্থে তিনি বলেছেন : ‘আমি জীবনবাদী মানুষ। রফিক আজাদ প্রমাণ করেছেন, প্রকৃত কবি হবার জন্য বিশুদ্ধ কাব্যচর্চাই একমাত্র পথ। এই ধারা অব্যাহত রাখলে নানা ধরনের কবিতা এমনিতেই এসে যায় লেখনীর নিবে।’ আলোচনা শুরু করার আগে রফিক আজাদের কাব্যগ্রন্থাবলির নাম উল্লেখ করা যাক : অসম্ভবের পায়ে (১৯৭৩), সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে (১৯৭৪), চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া (১৯৭৭), প্রেমের কবিতা (১৯৮১), সশস্ত্র সুন্দর (১৯৮২), এক জীবনে (১৯৮৩), ভালোবাসার কবিতা (১৯৮৩), অঙ্গীকারের কবিতা (১৯৮৩), প্রিয় শাড়িগুলি (১৯৮৩), হাতুড়ির নিচে জীবন (১৯৮৪), পরীকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ (১৯৮৫), খুব বেশি দূরে নয় (১৯৮৬), গদ্যের গহন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া আমি এক দিকভ্রান্ত পথিক (১৯৮৭), অপর অরণ্যে (১৯৮৯), ক্ষমা করো বহমান হে উদার অমেয় বাতাস (১৯৯২), করো অশ্রুপাত (১৯৯৩), পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি (১৯৯৫), কণ্ঠে তুলে আনতে চাই (১৯৯৬), বিরিশিরিপর্ব (১৯৯৯), বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে (২০০৬), মৌলবীর মন ভালো নেই (২০০৭) ইত্যাদি। এছাড়া কবিতাসমগ্র, প্রেমের কবিতাসমগ্র, স্বনির্বাচিত প্রেমের কবিতা নামেও তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
ষাটের দশকে বাঙালি জীবনে যখন রাজনৈতিক উত্তাপ, সেই উত্তাপ যেন তরুণ রফিক আজাদকে স্পর্শ করেনি। বরং নৈরাশ্যের পচা ডোবা বারবার উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। জীবনকে তিনি দেখেছেন স্পন্দনহীন, স্বপ্নহীন, আলোহীন। এসময়ে রচিত তাঁর কয়েকটি কবিতার শিরোনাম : ‘নগর ধ্বংসের আগে’, ‘স্বগত মৃত্যুর পটভূমি’, ‘সৈকতে স্বপ্নহীন’, ‘বাতাসের উল্টো দিকে যাত্রা’, ‘জ্যোৎস্না আর নেই’, ‘অবাস্তব রাজহাঁসের আকাক্সক্ষায়’, ‘ঊর্ধ্বশ্বাস অশ্বগুলি’, ‘কুয়াশার চাষ’ ইত্যাদি। হতাশার বুকে জীবনের চাষ করেছেন কবি, উঠে এসেছে নৈরাশ্য। বলেছেন : ‘আজীবন রুগ্নতায় হাসপাতালের বেডে পড়ে আছি অন্ধ ও বধির? / রোগীদের মতো ম্লান অল্পপ্রাণ বাল্ব জ্বলে ওঠে / এমন আলোর থেকে আলোহীনতাই ভালো।’ (‘রোগশয্যায়’)। অন্য একটি কবিতায় লিখেছেন :
‘দুঃস্বপ্নে উত্যক্ত আমি- এই দ্যাখো, তোমার সন্তান
মুখ গুঁজে পড়ে আছে, বালুকায়, দুরূহ সময়ে।’ (সৈকতে, স্বপ্নহীন)
কবিতাগুলো রচিত হয়েছে ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২-এর মধ্যে। এই নিরাশা, অন্ধত্ব, বধিরতায় নিমগ্ন হওয়া এ-ও ষাটের কবিদেরই একটি বৈশিষ্ট্য। অন্যদের থেকে রফিক আজাদের পার্থক্য এখানেই, তিনি নেতির মধ্যেও ইতির দিকে মুখ ফিরিয়েছেন। তাঁর এ সময়ের কবিতায় নিরাশা আছে, কিন্তু জীবনের আলোর আভামুক্ত তা নয়। যে কারণে ‘সৈকতে, স্বপ্নহীন’ কবিতাটির প্রথমেই ‘স্বপ্নহীন পড়ে আছি কনকনে শীতের সৈকতে’ বললেও পরের পঙক্তিতেই রফিক আজাদ বলেছেন: ‘একটি কোমল স্বপ্ন একটানা দেখে যেতে চাই’। আবদুল মান্নান সৈয়দের এ-সময়ের কবিতায় জীবন যেখানে শূন্যময় পরাবাস্তবতায় ঘেরা, রফিক আজাদের কবিতায় সেখানে নৈরাশ্যের মধ্যেও আশার আভালোকিত। ‘নগর ধ্বংসের আগে’ কবিতায় সব ধ্বংসের কথা আছে, এমন কি এ ধ্বংসের আগে কোনো সাইরেন বা সিঙাও বাজবে না বলে নিঃসন্দেহ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কবি যখন শেষ দুটো পঙক্তি লেখেন, এভাবে :
‘প্রোথিত বৃক্ষের মতো বদ্ধমূল আমার প্রতিভা
সাধ ছিলো বেঁচে থেকে দেখে যাবো জিরাফের গ্রীবা।’
(নগর ধ্বংসের আগে)
তখন কিন্তু সূক্ষ্ম একটি আশাবাদ বেঁচে থাকে। যদি তা না-ই থাকবে, তাহলে কবিতায় বেঁচে কথাটি উচ্চারিত হয় কীভাবে? রফিক আজাদের ‘নৈরাশ্যবাদীর উক্তি’ নামের কবিতা উল্লেখ করে এবং সেই কবিতার বিচ্ছিন্ন দু-একটি পঙক্তি উদ্ধার করে অনেকেই রফিক আজাদকে এ-পর্বে নৈরাশ্যবাদী বা হতাশায় নিমজ্জিত বলে মনে করেন (‘নৈরাশ্যই কখনো কখনো রফিক আজাদকে বাধ্য করে চিৎকৃত স্পর্ধার উচ্চারণ করতে। নৈরাশ্যের দানব তাকে বন্দি করে রেখেছে অন্ধকারে জন্মাবধি,...’। খোন্দকার আশরাফ হোসেন, বাংলাদেশের কবিতা : অন্তরঙ্গ অবলোকন। কিন্তু তাঁরা কেন লক্ষ করেন না, এই কবিতায়ই আছে সুদীর্ঘ এক স্তবক; এরকম-
‘তোমাদের মঙ্গলার্থ তাই আমাকে এড়িয়ে চলো।
উপকূলবাসীদের কাছে শিখে নাও, হাতে-নাতে,
যা-কিছু শেখার আছে ঝঞ্ঝা রাতে, বিক্ষুব্ধ গর্কিতে
তারা কভু কাবু নয়, মানবিক, আশাহত নয়।
আমার নিকট থেকে দূরে থাকো, দূরে-দূরে থাকো;
তোমাদেরও ব্যাপার-স্যাপার, মানবিক, দূরে রাখো।’
(নেরাশ্যবাদীর উক্তি)
বর্তমান স্তবকে কিন্তু জীবনের আশালোকের ইঙ্গিত আছে, তাকে রক্ষা ও লালনের আকুতি হয়েছে ব্যক্ত। এই আকুতি ও ইঙ্গিতই শেষ অবধি রফিক আজাদকে নিরাশা ও হতাশা থেকে রক্ষা করেছে এবং তা আজ পরিণতিপ্রাপ্ত। কবির প্রিয় চুনিয়াও নৈরাশ্যবাদী নয়। সে-ও আশায় প্রদীপ জ্বেলে রাখে। তবে এটা ঠিক, রফিক আজাদের কবিতায় সৌন্দর্যের জন্যে হাপিত্যেস আছে, ছিলও। ষাটের উত্তাল সময়ে কবি সৌন্দর্য-অধরার পেছনে ছুটেছিলেন, এ-ও মিথ্যে নয়। কিন্তু সময় ও রাজনীতি থেকে শেষ অবধি এবং সম্পূর্ণ অর্থে তিনি মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেননি। স্বাধীনতা-উত্তরকালের আশাভঙ্গ কবিকে কতটা ক্ষুব্ধ করেছিল, তার প্রমাণ : ‘ভাত দে হারামজাদা, তা-না-হলে মানচিত্র খাবো।’ ১৯৭৪ সাল বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষকাল। আর এ বছরেই বের হয় তাঁর ‘মানচিত্র খাবার’ কবিতা। অগ্নিতে যেন ঘৃতাহুতি! কিন্তু কবিরই-বা কী করার আছে, অতি সামান্য চাওয়া- নুনান্ন, তা-ও যদি না-পাওয়া যায়, বিক্ষুব্ধ তো তিনি হবেনই:
‘দুবেলা দুমুঠো পেলে মোটেই নেই অন্য কোনো দাবি,
অনেকে অনেক-কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়:
বাড়ি, গাড়ি টাকা কড়ি কারো বা খ্যাতির লোভ আছে;
আমার সামান্য দাবি: পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর
ভাত চাই এই চাওয়া সরাসরি ঠান্ডা বা গরম,
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চালে হলে
কোনো ক্ষতি নেই মাটির শানকি-ভর্তি ভাত চাই:
দুবেলা দুমুঠো হলে ছেড়ে দেবো অন্যসব দাবি।’
(ভাত দে হারামজাদা)
শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে লেখা এই কবিতা প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তি-মুজিবের বিরুদ্ধে ছিল না। ছিল কৃত্রিমভাবে যে অক্ষশক্তি বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল বা এদেশের মানবতার অপমান দেখতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে। আর তাই, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে আবার যখন দেশে রাজনৈতিক হত্যা আরম্ভ, সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশবিরোধীদের ক্ষমতা দখল পরিপূর্ণ হলো, তখন তা কবিকে করেছে তাপিত। তিনি লিখেছেন :
১. ‘পঁচাত্তার-পরবর্তী প্রথম জ্যোৎস্নায়
চারবন্ধু মিলে ফরেস্ট বাংলোর চাঁদ সাক্ষী রেখে
কালো বর্ডার-দেয়া ভিন্ন-ভিন্ন চারটি
শোকের সম্পাদকীয় হয়ে যাই’
(মধ্যরাতে শোকগাথা)
২. ‘তুমি যেখানেই যাও
এসবের কিছুই পাবে না;
সঙ্গে সঙ্গে যাবে এক বেতারগ্রাহকযন্ত্র
নোংরা ড্রেন, পচা জল, হলুদ পত্রালি, ক্বাথ, চিমনির ধোঁয়া,
দূষিত বাতাস আর গভীর রাত্রিতে ভারি বুটের আওয়াজ।’
(তুমি চাও)
সময়, রাজনীতি ও পরিপার্শ্ব সচেতন কবি ব্যতীত এ ধরনের শব্দশিল্প তৈরি করা অসম্ভব। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জারি করা জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন, তার বিপক্ষে যখন চারিদিকে প্রতিরোধের দেয়াল তুলেছে দেশবাসী, তখনও সরীসৃপ-শ্রেণির মানুষের মতো কতিপয় ঘরকুনো বসে থেকেছে, সুবিধার করেছে অন্বেষণ। এ ধরনের মানুষদের লক্ষ্য করে রফিক আজাদ শ্লেষ প্রকাশ করেছেন তাঁর ‘মানুষ’ কবিতায়। কবিতার শেষে অভিনব পাদটীকা জুড়ে দিয়ে তিনি এ শ্লেষকে করেছেন আরো তীক্ষ্ম এভাবে: ‘প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, আপনারা এই লোকটি যাতে শিরদাঁড়া খাড়া করে উঠে দাঁড়াতে পারে সে ব্যবস্থা করুন, একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে লোকটি, আরো একবার, মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতেও তো পারে। কারণ, সে কোনো অমেরুদণ্ড প্রাণী নয়।’
রফিক আজাদের কবিতায় দেহ-কেন্দ্রিকতাও আছে। দেহের, বিশেষত নারীদেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের ব্যবহার রফিক আজাদ আজাদি নিয়েই করেছেন। মিলনাকাক্ষায় বা মিলনে অথবা বিরহে পুরুষ হৃদয়ের বহুবিধ অনুভূতি প্রকাশে নারীদেহ এসেছে বারবার। কেননা তঁঅর প্রত্যাশার পৃথিবী এরকম:
‘সর্বদাই দেখে যেতে চাই
ঘরে ঘরে শুয়ে আছে সুখের শয্যায়
আলিঙ্গনাবদ্ধ দুই নির্বিরোধ পুরুষ-রমণী।’
(ভালোবেসে বোকা থাকতে চাই)
নারী ও পুরুষের এই নির্বিবোধতার আগে একটি দ্বৈরথ চাই। রফিক আজাদ এই দ্বৈরথের উপস্থাপনায় শরীরকে অত্যাবশ্যক মনে করেন। তিনি বলেছেন : ‘তুমি দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে যাবে/ আমার শরীর মন সবকিছু তা হতে পারে না’। কাছে এলে কী হয়, কীভাবে হয়, জানতে চাইলে যে কেউ পাঠ করতে পারেন একজীবন কাব্যগ্রন্থের ‘হ্যালো রিমোট কন্ট্রোল’ কবিতা। বহু কবিতায় নারীর শরীর, নর-নারীর মিলনকথা বর্ণিত আছে। এই একটি কবিতা পড়লে এ ধরনের অন্য কবিতা পড়ার প্রয়োজন হয়তো পড়বে না (না কি আগ্রহ যাবে বেড়ে?) উত্তরজীবনে কবির এই দেহপ্রীতি শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে এমন বলা যাবে না। তবে সংযমিত মাত্রায় এর উপস্থাপন অধিকতর শিল্পসম্মত বলে মনে হয় :
‘বেলাভূমি দীর্ঘ হলে শুধু ধূ ধূ বালি
বালি ছাড়া আর কিছু নাই, তাই বলে
কে কবে করেছে বন্ধ নোনাজলে স্নান?
ঘুরেফিরে সেই পুরোনো জোয়ারে তুমি
সমর্পিত হলে? যে জলে দুর্নাম প্রায়
প্রান্তবাসী নারীর সমান?’
(পয়ারেই করো ধারাস্নান)
রফিক আজাদ ধীরে ধীরে পরিণত কবিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁর কবিতা শিল্পের শীর্ষস্পর্শ করেছে। তিনি সৌন্দর্যকাতর ছিলেন প্রথম জীবনে; শুধুই। এই সৌন্দর্য-অনুধ্যানে ক্রমে পরিপার্শ্বের অন্যান্য অনুষঙ্গ একীভূত করলেন। নৈরাশ্য, রাজনীতি, প্রেম, দেহ, রিরংসা ইত্যাদি সব কিছু শিল্পের অমর বিন্দুতে এসে মিলেছে, যেখানে আছে জীবনের আশাবাদ। রফিক আজাদ আশাবাদী কবি, তিনি সম্পূর্ণ কবি। কবিতার অমরাবতীতে তিনি আসন নিশ্চিত করেছেন। তাঁর কবিতায় কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নেই অথবা বলা যায়, কোনো নির্দিষ্ট বিষয় তাঁর কবিতাকে ধারণ করার যোগ্যতা রাখে না। তবে প্রথম থেকে যেমন, এখনো রফিক আজাদ সুন্দরের অভিলাষী। এর সঙ্গে ক্রমে যুক্ত হয়েছে সত্যের ধারণা। সুন্দর ও সত্যের সন্ধানে মানবদরদী কবি রফিক আজাদও পথ চলছেন। তিনি জানেন :
‘সুন্দরের দিকে চোখ রেখে সত্যের সামান্য অংশ
খুঁজে পেতে অনেকেই লাঙলের ফলা আঁকড়ে ধরে-
সত্যের বদলে কিছু উঠে আসে সুন্দরের সীতা!
সত্যে ও সুন্দরে কোনো দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ বাঁধে না!’
(সত্য ও সুন্দর)
রফিক আজাদের এ পথ চলার শেষ নেই। সত্য ও সুন্দরের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠে তাঁর কবিতা-প্রতিমা। আর একটি কথা বলা প্রয়োজন, রফিক আজাদ জীবনের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়েও পরমভাবে ইহজাগতিক চিন্তা করেন, যা আমাদের সমাজে খুবই বিরল ঘটনা। যে বয়সে বাঙালিরা সাধারণত আধ্যাত্মিকতায় সমর্পণ করে নিজেকে, সে বয়সে অনেক আগে উপনীত হয়েছেন রফিক আজাদ। কিন্তু তিনি ধর্মীয় ব্যক্তিদের মধ্যেও খুঁজে নিয়েছেন ইহজাগতিক আগ্রহ। তাই ‘মৌলবি সাহেব’ যখন সকালে-বিকেলে হাঁটাহাঁটি করেন তখন রফিক আজাদ তার তাৎপর্য খোঁজেন, বেহেশতের সুখের চেয়ে নিশ্চয় এ জগতের সুখ বেশি প্রিয় তার:
‘মৌলবীর দৌড় ওয়াকওয়ে ব্যেপে পায়
আলাদা মর্যাদা লোকায়ত লেকপাড়ে!
মৌলবীর হাঁটাহাঁটি, মৌলবীর দৌড় ভালো লাগে,
মৌলবী দৌড়ায়, হাঁটে ভবিতব্যহীন
ইহজগতের পথে, বিহ্বল বিকেলে
অন্য সব সুখী-দুঃখী নগরবাসীর মতো, একা...’
(মৌলবীর দৌড় ভালো লাগে)
সবার মতোই তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন অবশেষে। কিন্তু তাঁকে যদি জিজ্ঞেস করা যেতো, হয়তো তিনি উত্তরে বলতেন আবার, সুখ অনন্ত তো এই ‘ইহজগতের পথে’ই।
Login to comment..