সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ছাড়া নারীমুক্তি সম্ভব নয়

Posted: 30 নভেম্বর, 2025

(গত ২৮ নভেম্বর ঢাকার মতিঝিলের বিসিআইসি মিলনায়তনে দিনব্যাপী নারীর রাজনৈতিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। কনভেনশনে পঠিত নারী অধিকার সনদ (খসড়া) দেওয়া হলো)। ভূমিকা: নারীমুক্তি শুধু কোনো সামাজিক সংস্কারের বিষয় নয়। বাংলাদেশে নারীর অধিকারহীনতা, তার বঞ্চনা এবং নারীর ওপর নিপীড়নের অর্থনৈতিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি রয়েছে, এটা কেবল ব্যক্তি নারী-পুরুষ সম্পর্কের বিষয় নয়। এটা মূলত রাষ্ট্রীয় কাঠামো, পুঁজিবাদী সম্পর্ক, সামন্ত-ধর্মীয় কর্তৃত্ব, পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এবং সাম্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের সমষ্টি। তাই নারীমুক্তির প্রশ্নকে শুধু পৃথক ও সংকীর্ণ নারী সংস্কারের মধ্যে নয়, বরং রাষ্ট্র-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-পরিবারসহ সব স্তরের মৌলিক পরিবর্তনের সংগ্রাম হিসেবে দেখতে হবে। নারী নিপীড়নের বস্তুগত শেকড় উৎপাদন সম্পর্ক ও শ্রেণি কাঠামোর গভীরে বিরাজমান। নারীর ওপর শোষণ-বৈষম্য-নিপীড়ন একটি স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক সম্পর্ক হলেও পুঁজিবাদের কাঠামোগত প্রয়োজনের কারণে এটি শ্রেণি শোষণ ও বৈষম্যের সঙ্গে গাঁথা। এজন্য নারী প্রশ্ন শ্রেণি প্রশ্নের সম্পূর্ণ অধীন নয়, আবার সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্রও নয়। এটা শ্রেণি-পিতৃতন্ত্র-বর্ণ ও পুঁজিবাদের সাথে আন্তঃসংযুক্ত এক ব্যবস্থা। নারীমুক্তির জন্য আমাদের এ অঞ্চলে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। আর ২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় নারীরা অসাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কেবল প্রতীকী অংশগ্রহণকারী হিসেবে নয়, বরং সক্রিয় প্রতিনিধি ও নেতা হিসেবেও। গণঅভ্যুত্থানের প্রাথমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল কৌশলগত; হত্যাকাণ্ডের পরে নারীরা প্রকৃত নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তারা সংগঠিত হয়েছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, রাজপথে দৃশ্যমান ছিলেন এবং অসাধারণ সাহস দেখিয়েছিলেন। আন্দোলনকারীদের রক্ষা করার জন্য সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং মাঠে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এ কারণে দৃঢ় প্রত্যাশা ছিল যে, জুলাই পরবর্তী রাজনৈতিক সংস্কারে নারী প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থান নারীর অবস্থা পরিবর্তনের যে অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার সেটি অগ্রসর করে নিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। নারী অধিকার বিষয়ক সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা দেখিয়েছে যে, শুধুমাত্র আইনগত বা প্রশাসনিক পদক্ষেপ নারীর মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে না। নারীর অধিকারহীনতা ও নারীর ওপর নিপীড়নের মূল উৎস রাষ্ট্র, পিতৃতন্ত্র ও পুঁজিবাদের যৌথ কাঠামোর মধ্যে রয়েছে। শ্রম, সম্পত্তি, পরিবার, ধর্ম, সংস্কৃতিসহ সবক্ষেত্রেই নারীর ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উপাদান রয়েছে। তাই আমাদের নারী সনদ শুধু নীতিগত ঘোষণা বা কিছু দাবির সমষ্টি হবে না; বরং এটি হবে একটি গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রূপান্তরমূলক রাজনৈতিক কর্মসূচি। ১. নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা: নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া নারীমুক্তি অন্দোলনকে সামনে অগ্রসর করা সম্ভব নয়। এজন্য নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। (ক) জাতীয় সংসদের সাধারণ আসনের মধ্য থেকে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে ৮০ টি আসন নারীদের জন্য এবং ১০টি আসন জনসংখ্যার অনুপাতভিত্তিক বিবেচনায় লিঙ্গ বৈচিত্রের জনগোষ্ঠী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, আদিবাসী ও অন্তজ জনগোষ্ঠীর অগ্রসরমান নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা। উল্লেখ থাকে যে, বাকি ২১০টি সাধারণ আসনেই নারী-পুরুষ-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকারী হবেন। ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের ক্ষেত্রে বর্তমানের সংরক্ষিত ব্যবস্থার পরিবর্তে সাধারণ আসনে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে ৩০ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা। (খ) গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত মোতাবেক ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলে ৩৩% নারী অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত বিধিমালা ছিল, যা কোন রাজনৈতিক দলই পূরণ করতে পারেনি। এ অবস্থায় বর্তমান সময় থেকে আরও ৫ বছর সময় বৃদ্ধি করে তা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে রাজনৈতিক দলসমূহকে বাধ্য করা। এক্ষেত্রে প্রতিবছর অগ্রগতির প্রতিবেদন প্রদানে রাজনৈতিক দলসমূহকে বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনা। (গ) রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারণী পদসমূহে কমপক্ষে দশভাগ নারী প্রতিনিধি যুক্ত করার বিধান করা যা দলসমূহের গঠনতন্ত্রে উল্লেখ থাকতে হবে। ২. নারীর আইনগত সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা: নারীর আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া সমঅধিকারের আন্দোলনকে তার লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। কারণ, বাংলাদেশের আইন-আদালত পরিচালিত হয় সংবিধান অনুযায়ী। আমাদের সংবিধান মৌলিক নাগরিক অধিকার নারী-পুরুষ সকলের ক্ষেত্রে সমান হওয়ার নির্দেশনা দেয়। কিন্তু নারীর সম্পত্তিতে অধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব, বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ পরিচালিত হয় ধর্মীয় পারিবারিক আইন অনুযায়ী, যা সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের স্পষ্ট লংঘন। এজন্য নারীর আইনগত অধিকার নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে হবে– (ক) ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে সমান অধিকার ও ধর্মীয় পারিবারিক আইনের পরিবর্তে ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করা। (খ) নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও সনদে এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত দুটি ধারা, ধারা-২ ও ১৬.১ (গ) থেকে বাংলাদেশের আপত্তি প্রত্যাহার করা। সিডও সনদের ধারা-২ এ যা আছে: বৈষম্য বিলোপ করে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা স্থাপনের নীতিমালা গ্রহণ। প্রতিটি দেশের জাতীয় সংবিধান, আইন-কানুন ও নীতিমালায় নারী ও পুরুষের সমতার নীতিমালা সংযুক্তকরণ ও তার প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন-কানুন, রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। সবক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ। আদালত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নারীর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন রোধ করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া। সিডও সনদের ধারা-১৬.১ (গ)-তে যা আছে: বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদকালে নারী ও পুরুষের একই অধিকার ও দায়-দায়িত্ব নিশ্চিত করা। (গ) বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের বিশেষ ধারা ১৯ (বাল্যবিবাহকে আদালতের নির্দেশে বৈধতা দেয়া) বাতিল করা। ৩. নারী অধিকার সনদের অর্থনৈতিক দিক: অর্থনৈতিকভাবে ন্যায্য অধিকার ও সাবলম্বিতা অর্জন করলে নারীর পক্ষে তার মুক্তির আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া সহজ হয়। ৩.১ শ্রমবাজারে রপান্তর: সমকাজের জন্য সমমজুরি: সমকাজের জন্য সমমজুরি প্রদান শ্রমবাজারে রূপান্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৪.২ শতাংশ নারী। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাকশিল্প থেকে। সেখানে কাজ করেন প্রায় ৪০ লাখ নারী। কিন্তু একই কাজে পুরুষের তুলনায় নারীরা গড়ে ২১ শতাংশ কম মজুরি পান (তথ্য সূত্র: আইএলও,২০২৩)। চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে ৭০ শতাংশ নারী। তারা দিনে মাত্র ১৭০ থেকে ১৮৫ টাকা মজুরি পান (জাতীয় মজুরি বোর্ড, ২০২৩)। মজুরি বৃদ্ধি করে তাদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনমান নিশ্চিত করা আমাদের আগামীদিনের সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নারী কৃষি শ্রমিকেরা সাধারণত দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন, যেখানে তাদের মজুরি পুরুষের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম। গৃহকর্ম পেশা: বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ নারী গৃহকর্মীর কাজ করেন (তথ্যসূত্র: ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স রাইটস নেটওয়ার্ক, ২০২৩)। তাদের অধিকাংশেরই কোনো লিখিত চুক্তি নেই, নেই কোনো নির্ধারিত কাজের সময়, কোনো ন্যায্য ছুটি বা মজুরি। গৃহকর্মী পেশার প্রতি সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে তাদের নেই কোনো নিরাপত্তা। নির্মাণ পেশা: নির্মাণ পেশায় নারীশ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা কমছে (আইএলও-বিজিএমই রিপোর্ট, ২০২৪ অনুযায়ী)। তারা সবচেয়ে বেশি মজুরি বৈষম্যের শিকার। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হওয়ায় শ্রম আইন এদের কোনো কাজে আসে না। বাংলাদেশের শ্রম আইন-২০০৬ (সংশোধিত-২০১৮) নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও বৈষম্যহীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। কিন্তু এগুলি বাস্তবায়নের ঘাটতি প্রকট। আইএলও কনভেনশন ১০০ (সমান মজুরি), ১১১ (বৈষম্য নিষিদ্ধকরণ) এবং ১৯০ (সহিংসতা প্রতিরোধ) এখনও অনুস্বাক্ষর করা হয়নি। যদি বৈষম্য প্রতিরোধ করে নারী শ্রমিকদের সমান সুযোগ ও সমান মজুরি দেয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশের জিডিপি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। অন্যদিকে বৈষম্য ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশের কারণে বছরে লাখ লাখ নারী শ্রমিক কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করেন, যা উৎপাদন ও দক্ষতা দুই ক্ষেত্রেই ক্ষতি করে। নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশ দূর করা শুধু ন্যায্যতার প্রশ্নই নয়, এটি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে যুক্ত। এজন্য কর্মপরিবেশ উন্নত করা এবং নারী-পুরুষের সম কাজের সমমজুরি নিশ্চিত করার সংগ্রাম আমাদের এক অপরিহার্য কর্তব্য। প্রবাসী শ্রমিক: প্রবাসী নারী শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসগুলোর কার্যকর ভূমিকা পালন। ৩.২ শ্রম আইন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সকল শ্রমিকের জন্য বাধ্যতামূলক করা। শ্রম আদালতে নারীর জন্য বিশেষ সেল ও দ্রুত বিচার ব্যবস্থা। ৩.৩ গার্মেন্টস, কৃষি, চা শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, ডমেস্টিক ওয়ার্কারসহ অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে নারী শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার স্বাধীনতা প্রদান। ৩.৪ মাতৃত্বকালীন ছুটি এক বছর ও পিতৃত্বকালীন ছুটি একমাস করা। ৩.৫ সম্পত্তির অধিকার ও সম্পদ বণ্টন: হাজার হাজার বছর ধরে নারীদের অবমাননাকর অবস্থানের অবসান কেবলমাত্র পুরুষদের তৈরি কিছু আইনের মাধ্যমে ঘটবে না। বিপরীতে সম্পত্তির ওপর নির্ভরশীল অর্থনৈতিক পরিবর্তনই হবে নারীর সামাজিক বৈষম্য অবসানের ভিত্তি। ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সাংস্কৃতিক ভিত্তি দূর করতে না পারলে অর্থনৈতিক সমতা আনার পরেও নারী-পুরুষ বৈষম্যের অবসান ঘটে না। আইনে সম্পত্তির সমান অধিকার নিশ্চিত করা গেলে নারীমুক্তি আন্দোলন লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর করা সম্ভব হবে। তাই নিম্নোক্ত বিষয়ে আন্দোলন জোরদার করা আমাদের একটি প্রধান কর্তব্য হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। উত্তরাধিকার আইনে ধর্ম নির্বিশেষে সমান অধিকারের একক আইন। জমি ও বাসস্থান বরাদ্দে নারীর অংশ নিশ্চিতকরণ। নারী কৃষকের কাছে সেচ, ঋণ, যান্ত্রিক সরঞ্জাম প্রাপ্তির বিশেষ কর্মসূচি। ৩.৩ রাষ্ট্রীয় বাজেট ও নারী রাষ্ট্রীয় বাজেটে এবহফবৎ জবংঢ়ড়হংরাব ইঁফমবঃরহম বাধ্যতামূলক করা। এনজিও পরিচালিত দাতাভিত্তিক নারী উন্নয়ন নয়–রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের মাধ্যমে শ্রমিক সমবায় মডেলচালু করা। ৪. সহিংসতা বিরোধী নীতি: ৪.১ নারীর নিরাপত্তা রক্ষায় রাষ্ট্রীয় ও আইনি ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য– ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল কার্যকর করা। প্রতিটি থানায় ডড়সবহং উবংশ ও পূর্ণাঙ্গ এবহফবৎ ঔঁংঃরপব টহরঃ তৈরি ও কার্যকর করা। ডিজিটাল হয়রানি, সাইবার বুলিং, ব্ল্যাকমেইলিং প্রতিরোধে কঠোর আইন ও সাইবার নিরাপত্তা স্কোয়াড গঠন করা। ৪.২ প্রতিরোধমূলক সামাজিক কর্মসূচি: পাড়াভিত্তিক নারী সুরক্ষা কমিটি। রাজনৈতিক দলসহ সব ধরনের সংগঠনের ভেতর যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি কার্যকর করা। সকল গণপরিবহনে আসন সংরক্ষণ এবং গণপরিবহন শ্রমিকদের নারী-নির্যাতন প্রতিরোধমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান। ৫. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরে নীতি: পুরুষ আধিপত্যবাদ যে বিশ্বাস পরিবার ও সমাজের গভীরে পৌঁছে দিতে সফল হয়েছে, তা হলো নারী যোগ্যতায় পুরুষের চেয়ে কম। এই আধিপত্য সাংস্কৃতিকসহ সর্বত্র জেঁকে বসেছে। সময়ের বিবর্তনে নারী প্রমাণ করেছে এ কথা সত্য নয়। শারীরিক ক্ষেত্রে যে সক্ষমতার বড়াই করা হয় তা-ও ধোপে টেকে না। পরিবারে বা সমাজের মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষের সম্পর্ক পরিপূরকের, সহযাত্রীর। শারীরিক শক্তি নয় বরং বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধ দিয়েই মানুষ হিংস্র প্রাণী ও প্রকৃতির সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়ী হয়েছে। নারীমুক্তি আন্দোলনকে অগ্রসর করতে হলে পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যবাদী গৎবাঁধা দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন– পাঠ্যপুস্তকে মহীয়সী নারীদের সংগ্রাম অন্তর্ভুক্ত করা এবং নারী বিদ্বেষী লেখা বাদ দেয়া। নারীদের নিয়ে কেবলমাত্র প্রদর্শনকারী বৈষম্যমূলক মিডিয়া বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ। নারীবান্ধব চলচ্চিত্র ও সাহিত্য প্রকল্পে রাষ্ট্রীয় ফান্ডিং। পিতৃতান্ত্রিক লোকজ প্রথার সমালোচনা ও রূপান্তরের কর্মসূচি। কর্মক্ষেত্র, বিদ্যালয়, মসজিদ-মন্দিরসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সবার জন্য লিঙ্গসমতা প্রশিক্ষণ। ধর্মীয় শাসনব্যবস্থার নামে নারী অধিকার খর্ব করার সব চেষ্টার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় অবস্থান। নারীদের খেলাধুলা ও শরীরচর্চার জন্য প্রতিটি উপজেলা ও জেলা সদরে সরকারি প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন করা। নারী খেলোয়াড়দের প্রতি বেতন বৈষম্য দূর করা। ৬. স্বাস্থ্য-নীতি: ৬.১ প্রজনন স্বাস্থ্য: বিনামূল্যে ও সর্বজনীন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ মাতৃত্ব, মাসিক স্বাস্থ্যপণ্য, যৌনস্বাস্থ্য, কিশোরী স্বাস্থ্য, নিরাপদ গর্ভপাতের আইনি স্বীকৃতি এবং জন্মনিয়ন্ত্রণে নারীর সিদ্ধান্তের অধিকার বাস্তবায়ন নারীমুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ৬.২ মানসিক স্বাস্থ্য: লিঙ্গভিত্তিক ট্রমার জন্য নারী পরামর্শ কেন্দ্র ও মনোসামাজিক সহায়তা এবং কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বাধ্যতামূলক করা। ৭. আদিবাসী ও প্রান্তিক নারীদের উন্নয়ন: পাহাড়-সমতলের আদিবাসী ও প্রান্তিক নারীদের জন্য শিক্ষা-চিকিৎসা, কর্মসংস্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ৮. মুক্তিযুদ্ধে সকল নির্যাতিত বীরাঙ্গনা নারীর দ্রুত তালিকা প্রণয়ন ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। ৯. আন্তর্জাতিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা: নারী শ্রমিকের বৈশ্বিক শোষণ (গার্মেন্টস, অভিবাসী শ্রম, কেয়ারওয়ার্ক) প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক শ্রম সংহতি প্রদান। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি দাতা সংস্থার পরামর্শে নারী ও শ্রমজীবীদের অসুবিধা হয় এমন ‘সংস্কার’-এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ। ১০. সংগঠন-লক্ষ্য ও কৌশল: নারী সংগঠনগুলোকে বিপ্লবী ধারায় পরিচালনা করা, অথবা বিপ্লবীধারার নারী সংগঠন গড়ে তোলা। সারাদেশে বিস্তৃত পরিসরে সংগঠন গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ। ঐক্যবদ্ধভাবে নারীমুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলা। উপসংহার : নারীমুক্তি কোনো নৈতিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রশ্ন নয়; এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মতাদর্শগত প্রশ্ন। সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ছাড়া নারীমুক্তি অগ্রসর হতে পারে না। আমাদের নারী সনদ হবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের রোডম্যাপ, উৎপাদন ব্যবস্থার পুনর্গঠন, শ্রমজীবী মানুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও মতাদর্শিক সংগ্রামের কার্যকর সমন্বয়। আমরা ঘোষণা করছি: নারীমুক্তি ছাড়া সমাজপ্রগতি হবে না। আর সমাজপ্রগতি ছাড়া নারীমুক্তিও অসম্ভব। এই সংগ্রাম ব্যক্তিগত নয়, এই সংগ্রাম নারীর, এই সংগ্রাম নারী-পুরুষের, এটি জাতীয়-আন্তর্জাতিক ও শ্রেণিভিত্তিক বিপ্লবী সংগ্রাম। নারীমুক্তির সংগ্রাম জারি আছে। এই সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে হবে। এখনই আওয়াজ তুলতে হবে শোষণ-বৈষম্যের পিতৃতন্ত্র ভাঙো, পুঁজিবাদ ভাঙো এবং রাষ্ট্রযন্ত্র বদলাও। নারীমুক্তির লক্ষ্যে শোষণ-বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত কর।