রাখাইনে ‘মানবিক করিডর’ খোলার সিদ্ধান্ত মানবিকতার দাবি নাকি সাম্রাজ্যবাদের ফাঁদ?
Posted: 04 মে, 2025
রোহিঙ্গা সংকট ও রাখাইনে চলমান সংঘাত এখন আর কেবল মিয়ানমার কিংবা বাংলাদেশের নিজস্ব সমস্যা নয়। এটি পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর একটি ভূরাজনৈতিক সংঘাতের মাঠে। বাংলাদেশ সম্প্রতি মানবিক বিবেচনায় রাখাইনের নির্যাতিত জনগণের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, এই সিদ্ধান্তের পেছনে কি শুধুই মানবিকতা কাজ করছে, নাকি এটি বৃহৎ শক্তিগুলোর গোপন স্বার্থের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? আজ রাখাইন এবং রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে বিশ্বশক্তির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলেছে, যেখানে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
রোহিঙ্গা সমস্যাকে এতদিন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, এখন এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বড় এক ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। রাখাইন রাজ্য চীনের “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (ইজও)”-এর গুরুত্বপূর্ণ করিডর। এই অঞ্চল দিয়েই চীনের তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন চীন পর্যন্ত পৌঁছে, যা চীনের শক্তি নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে রাখাইনে শান্তি বজায় থাকা চীনের জন্য অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে জরুরি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টি করে রাখাইনে চীনের প্রভাব নষ্ট করতে চাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “ইটজগঅ অপঃ” এর উল্লেখ করা দরকার, যা মূলত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়ানোর জন্য গৃহীত হয়েছে। বাস্তবে এই আইন রাখাইনসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত উসকে দিয়ে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পগুলোর ওপর আঘাত হানার কৌশল হিসেবেই কাজ করছে। বার্মা অ্যাক্টের ফলে রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন বাড়ানো হচ্ছে, যা রাখাইনকে একটি জটিল যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করছে এবং একই সাথে বাংলাদেশের জন্যও বড় একটি নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে।
ভারতের অবস্থানও এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাখাইনে ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ এবং বিশেষ করে কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্পের কারণে ভারতও সেখানে তার প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী। ভারত রাখাইন রাজ্যের মধ্য দিয়ে মিজোরাম ও ত্রিপুরার মতো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সাথে সমুদ্রবন্দর সংযোগ স্থাপন করতে চায়। এ কারণে ভারতও রাখাইনে স্থিতিশীলতা চায়, তবে তা নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন রাখাইনে। একই সাথে ভারত চায় মিয়ানমারে চীনা আধিপত্য কমাতে। এজন্য রাখাইনের নির্দিষ্ট কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে নেপথ্যে ভারতের যোগাযোগ রাখারও অভিযোগ আছে। ফলে রাখাইনে রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থের সংঘর্ষ বাংলাদেশকেও সরাসরি প্রভাবিত করছে।
সম্প্রতি দেখা গেছে, আরাকান আর্মির (অঅ) সশস্ত্র সদস্যরা বাংলাদেশের ভেতর ঢুকে জলকেলি উৎসবে অংশ নিয়েছে এবং অস্ত্র হাতে স্থানীয় নেতাদের সাথে ছবি তুলেছে। এই অনুষ্ঠান ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের (টখঅ) অর্থায়নে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সীমান্তে এত কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও কিভাবে সশস্ত্র সদস্যরা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারল, তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি কি সীমান্ত নিরাপত্তার ব্যর্থতা, নাকি কোনো গোপন রাজনৈতিক সমঝোতার অংশ- তা খতিয়ে দেখা দরকার।
এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও কিছু গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জামায়াতে ইসলামীর মতো সংগঠন, যারা একসময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং এখনো নানাভাবে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে, তারা এখন ‘স্বাধীন আরাকান রাজ্য’ গঠনের দাবি তুলেছে। তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় একটি স্থায়ী অস্থিতিশীলতা তৈরি করা, যাতে দেশের সার্বভৌমত্ব দুর্বল হয় এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপের সুযোগ বাড়ে। জামায়াত এবং এ ধরনের দালাল গোষ্ঠীগুলো আজও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হয়ে কাজ করছে, যা দেশের জন্য বড় হুমকি।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় হলো, যেকোনো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদী প্রক্সি যুদ্ধের ফাঁদ থেকে দূরে থাকা। সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সশস্ত্র গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ রোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে জামায়াত ও অন্যান্য দালাল গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও সামরিক তৎপরতা কঠোরভাবে দমন করতে হবে। দেশের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষকে সাথে নিয়ে একটি দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য গড়ে তুলতে হবে, যারা দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যদিও দেশ পরিচালনা করছে, তবে জনগণের সঠিক প্রতিনিধিত্বের জন্য যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচন আয়োজন করা প্রয়োজন, যাতে জনগণের ভোটের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যত নির্ধারিত হতে পারে এবং একটি শক্তিশালী নির্বাচিত সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। একই সাথে আন্তর্জাতিক সংহতির ভিত্তিতে, প্রগতিশীল ও মানবিক শক্তিগুলোর সহায়তায় রোহিঙ্গা সংকটের একটি ন্যায্য এবং টেকসই সমাধান খুঁজতে হবে, যেখানে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ থাকবে না।
আজ যদি আমরা সচেতন না হই, যদি নির্লিপ্ত থাকি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্ব ঝুঁকির মুখে পড়বে। রাখাইন ও রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ যেন কোনো সাম্রাজ্যবাদী প্রক্সি যুদ্ধের ময়দানে পরিণত না হয়, সেদিকে আমাদের সবাইকে এখনই সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক : সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন