সরদার ফজলুল করিম : একটি অনুভূতি
Posted: 04 মে, 2025
বিশিষ্ট তাত্ত্বিক, লেখক ও গবেষক মনীষী সরদার ফজলুল করিমের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে একতার পাঠকদের উদ্দেশ্যে লেখাটি প্রকাশ করা হলো-
সরদার ফজলুল করিম বাস্তবে দূরের মানুষ ছিলেন না, কিন্তু তাকে কাছ থেকে দেখা বা জানা-বুঝার সুযোগ থাকলেও তা নিজের কাছে সহজ হয়নি। চিরকাল এমন মানুষের সান্নিধ্য বা কাছে যাওয়ার তাড়না দ্বারা তাড়িত হলেও তা দূরেই থেকেছে। তবে বাম ঘরনার ক্ষুদ্রজন হওয়ার সুযোগ থাকায় ঢাকার সভামঞ্চে তার অবস্থান দূর থেকে একটু লক্ষ্য করার সুযোগ মাত্র ঘটে। আর বাকিটুকু তার জীবনদর্শন কিছু কিছু পাঠ থেকে জানা বুঝার সুযোগ হয়েছে, তাতে বিরাট কিছু যে জানা হয়ে গেছে তা বলা যাবে না।
আমাদের গতানুগতিক প্রচলিত যে ধারণা আছে, দর্শন বুঝি, যারা দর্শন জগতের পণ্ডিত তারা জীব জগতে, মনুষ্য জগতে আলাদা। লৌকিক মানুষ হলেও তারা যেন অলৌকিকত্বের অধিকারী, যা দশজন মানুষ থেকে আলাদা বুঝায়। তারা যেন কোনো আপৌরষ মানুষ হিসেবে ‘বুজুর্গ’ এর মতো হয়ে আছেন। তাদের ধরাছোঁয়া সাধারণের সাধ্যের বাইরে। যারা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বাণী ছড়ান কিংবা যারা সমাজে সাধারণ লোকজনের ‘গুরু’ হয়ে ভক্তের ভান্ডার বা ‘তরিকার’ মতো বলয়ে নিজেদের অবস্থান চিহ্নিত করে লোকজনদের জীবন দর্শনের ‘নছিয়ত’ প্রতিনিয়ত দিয়ে থাকেন, তাদের আধিপত্য, প্রতিপত্তি দৌরাত্ম্যের মাত্রা থাকলেও লোকজন অনেক ক্ষেত্রে বুঝে নিয়েছে। তাদের অলৌকিক বা কেরামতি শক্তির মাত্রায় পারলৌকিকতার একটা মাহাত্ম্য আছে।
এছাড়া একাডেমির ক্ষেত্রে দর্শনের একটা বিরাট জায়গা আছে। এখানে দর্শন চর্চা বা তার বয়ানেও তত্ত্বের যে দিকদিগন্ত ছড়িয়ে আছে তা পাঠ বা সিলেবাসের ছাত্রের জন্য মধুর বা অল্ম মধুর হলেও এখানে অনেক ক্ষেত্রে সর্বজনের প্রবেশ সহজ নয়। দর্শন সহজ কথায় যদি হয় ‘দেখা’ আর কঠিন কথায় যদি হয় আরো গভীরভাবে দেখা বা দশজন থেকে আলাদা হয়ে আরো বেশি দেখা তাহলে সরদার ফজলুল করিমের কাছে দর্শন দশজনের দেখা ও তার দেখায় মিলেমিশে অভিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র ছিল। তার আগাগোড়া জ্ঞান বিদ্যাবুদ্ধি যা ছিল একজন লৌকিক মানুষ হিসাবে জীবনকে দেখা। এজন্য তিনি দ্বিধাহীনভাবে উচ্চারণ করেছেন ‘আমি কৃষকের পোলা’। তিনি তার জীবন দর্শনে সেই সে-কাল এই সে-কাল এর ভেতর থেকে বাস্তবে যা দেখেছেন, তার দার্শনিক বিবৃতি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন, তার জীবন দর্শন জগত ও জীবনকে আলাদা করে কিছু নয়, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, গাছতলার একজন দীনহীন, একজন কৃষক কিংবা সুউচ্চ প্রসাদের অধিকারী, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিত যারাই আছেন তাদের সকলের জীবন দর্শন জগত ও জীবনের বাইরে নয়। মানুষ তার সীমাবদ্ধতা, বৈষম্য, উচু-নিচু ভেদাভেদ অসংখ্য জটিল অবস্থানের কারণে দর্শনের জগতে নানা কৌশলী মাহাত্ম্যে এটাকে সর্বজন থেকে আলাদা রেখে, বাস্তবতাকে দূরে রেখে তার আলাদা জায়গা দিতে চেয়েছে। যতদূর বুঝি, সরদার ফজলুল করিমের কাছে সমগ্র মানবজাতি, মানব সভ্যতা, সর্বোপরি এই গ্রহ একটা পরিবারের মতো। তার ভাষ্য প্রতিটি পরিবারেই সাম্য বিদ্যমান। এখানে কেউ কাউকে ঠকায় না- তাহলে সাম্য সমাজতন্ত্র নিয়ে ঝগড়াঝাটি থাকার কথা নয়। তা স্বভাবতই সকল পরিবারে বিদ্যমান থাকায় এটা কেবল রাষ্ট্রে বা সমাজে প্রয়োগ বা বাস্তবায়নের দাবি রাখে।
সমাজতন্ত্রের দুর্দিনে, বিপর্যয়ে বা পতনে এই সমাজ দর্শন যখন ঘরছাড়া অবস্থায় তখনো তিনি ইস্পাত কঠিন দৃঢ় থেকেছেন। আর তা সম্ভব হয়েছে সাম্য সমাজতন্ত্রের স্বভাব উজ্জ্বল গতি-প্রকৃতির জন্য। তিনি বুঝে নিয়েছেন এবং মানুষকে জানান দিয়েছেন, কালের যাত্রার ধ্বনি সাম্য-সমাজতন্ত্রের, তার কোনো বিপর্যয় নেই, মানুষকে মূলের দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে।
তার ভাবনার সূত্র ধরে আমরা যদি এভাবে বুঝে নেই যে, এই আলো বাতাস সাম্যের প্রতীক। এভাবে ভূমিকম্প ঝড় তুফান প্লাবন থেকে শুরু করে প্রকৃতিতে যা আছে তার সবকিছুতে সাম্য বিদ্যমান। তাতে কোনো পক্ষপাত নেই। মানুষের উচিত সাম্যের প্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষ তা বুঝে নিয়ে বিরুদ্ধ পক্ষ না হয়ে উঠা। কিন্তু এখানে মানুষ বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়ে, নিজেরা অশুভ বিনাশ হয়ে উঠে। কিন্তু শুভবুদ্ধির মানুষেরা বরাবর অশুভের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে, শুভ তথা সাম্যের পৃথিবী গড়তে চেয়েছে। এজন্য তার কাছে মানুষের জন্ম-মৃত্যু ও ভাঙা-গড়া যা আছে জগতের পরিবর্তনশীলতা বিদ্যমান নিহিত আছে। প্রতিনিয়ত যে একটা পরিবর্তন ঘটে চলেছে তার বৈশ্বিক ব্যাখ্যা আছে, জগতের একজন সাম্যের দার্শনিক পন্ডিত কালমার্কস যা তাঁর ভাষায় উঠে আসে। তিনি জানান দেন, এ পর্যন্ত পন্ডিতেরা বা দার্শনিকেরা কেবল জগতের ব্যাখ্যাই করে গেছেন আসলে কথা হচ্ছে বদলানো বা পরিবর্তন। এই পরিবর্তনই মানুষের জীবনের গতি-প্রকৃতির নির্ণায়ক। এটা জগতের অন্যসব পন্ডিতেরা এভাবে বুঝেননি। মার্কস এই পরিবর্তনের কথা বলেন, তা কোনো চাওয়া না চাওয়ার ওপর বর্তায় না। সচেতন মানুষ হিসেবে এই পরিবর্তনটা কিভাবে মানুষের জীবনে প্রয়োজনে, তা অধিকতর কল্যাণে লাগানো যায়, তার বাস্তব ব্যাখ্যাই মার্কস তুলে ধরেছেন। তা কোনো ঐশী বাণী নয়। তিনি তাকে কোনো মতবাদ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাননি। তিনি বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে তার প্রয়োগগামিতা মানুষের জীবনে তা নিয়ে আসতে, তাকে সূত্রায়িত করেছেন মাত্র।
সরদার ফজলুল করিমের কাছে মার্কসের এ জীবন দর্শন সাম্যের পৃথিবী গড়ার দর্শন হিসেবে তার অস্থিমজ্জার অংশ হয়েছে। তিনি সমগ্র জীবন দর্শনের মধ্যে দিয়ে এই সত্যেই বহন করেছেন। তিনি জেলজুলুম নির্যাতন ভোগ করেও তা থেকে এক চুল সরে যান নি। তিনি উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণে পশ্চিমা বিশ্বের সর্বোচ্চ ডিগ্রি গ্রহণের সুযোগ পেয়েও সাম্যের দর্শনের নেতাদের নির্দেশ পেয়ে। তা ত্যাগ করে কৃষক শ্রমিকের দুর্দিনের দর্শনের অংশীজন হয়েছেন। তাদের গায়ে গায়ে থেকে একজন সরদার ফজলুল করিম হয়ে উঠেছেন। জীবন দর্শনে এমন দ্বিধাহীন থাকা সহজ নয়, তিনি এক্ষেত্রে আমৃত্যু দ্বিধাহীন থেকে যে সত্যের জানান দিয়েছেন তাতে তিনি ক্রমশই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন।
তিনি যে আত্মজীবনী লেখে গেছেন তা নিছক কোনো গালগল্প নয়, জীবনভর একজন সরদার কিভাবে অন্য দশজনের হয়ে উঠলেন, কিভাবে তিনি মানুষজনদের দুঃখে সকালে ও বিকালে সাথী হয়ে উঠলেন, কিংবা লোকজনের কাছে আপনজন হয়ে গেলেন; তার কথা যেমন আছে তেমনই স্বদেশ ও পৃথিবীর কথা এই আত্মজীবনী থেকে জানা বুঝার সুযোগ আছে। তার এই আত্মজীবনী কোনো অলৌকিক পাঠ নয়, একজন বাস্তব মানুষের লড়াই সংগ্রামের জীবনের ইতিকথা ও যা পড়তে গিয়ে যেমন নিশ্বাস না ফেলতে টানে তেমনই মুগ্ধ করে তোলে। তার আত্মজীবনী যেন জীবনের দালিলিক এক অপূর্ব সত্য। যা পাঠে একজন মানুষের অনেক শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে এবং তা থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া ও আশবাদের জায়গাও আছে।
তিনি বারবার অশুভ রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন এবং তাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে কিভাবে নিজের অবস্থান গোপন রাখতে হয়েছে। তার কাহিনী রূপকথার মতো কিন্তু তাই বাস্তবে ঘটেছে। তার এসব অবস্থানে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষেরাই হয়েছে তার ঠিকানা, আত্মীয়জনের মতো, এভাবে তার জীবনের যে ব্যাকরণ তৈরি হয়েছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পাঠক্রম বা সিলেবাস নয়। তার জীবনের সিলেবাস হয়েছে মানুষ বিশেষত সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ, তিনি ও তার পরস্পরের জীবনের খাতা কলম হয়ে উঠেছেন। সরদার ফজলুল করিম একক কোনো বিশেষ গ্রন্থ হয়ে উঠেননি- তিনি তার সংগ্রামের শরিকজনদের নিয়ে গ্রন্থ হয়ে উঠেছেন। এখানেই সর্দার ফজলুল করিম অনন্য পুরুষ হয়েও ভিন্ন নন।
লেখক : সদস্য, মৌলভীবাজার জেলা কমিটি, সিপিবি