মেয়েটির ফরিয়াদ শুনুন
Posted: 04 মে, 2025
‘আমার আব্বা এনজিও এবং সারের দোকান থেকে ঋণ নিয়া পেঁয়াজ চাষ করছিল। দুই বিঘা জমিতে চাষ করতে খরচ হইছে দেড় লাখ টাকা। কিন্তু বিক্রি করে পাইছে মাত্র ৫৮ হাজার টাকা। ঋণ শোধের চিন্তায় আব্বা পেঁয়াজ ক্ষেতেই বিষপানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলো। আব্বা পেঁয়াজ বিক্রি করছিল ৬০০ টাকা মণ। অথচ এহন বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি অয় দুই হাজার টাকায়। কারণ, এহন কৃষকের ঘরে পেঁয়াজ নাই। আমার আব্বার মতো কৃষকরা যদি এভাবে ঠইকা আত্মহত্যা করে, তাইলে দেশের মানুষের মুখে খাবার তুইলা দিব কারা?’
মেহেরপুরের মুজিবনগরে পেঁয়াজ চাষি সাইফুল শেখ অত্মহত্যা করেছেন। তার করুণ পরিণতির কথা এভাবেই কাঁদতে কাঁদতে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন তার মেয়ে রোজেফা খাতুন। দেশের যে মানুষই এই মেয়েটির কথা শুনেছেন তার চোখে জল এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মেয়েটির যে প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা সেটি তো রাষ্ট্রের কাছে। রাষ্ট্র বা সরকার কি তার কথা শুনতে পেরেছে?
মুক্তবাজারের নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্রের এই অসহায় দরিদ্র কৃষকের কন্যার কথা শুনতে পারার কথা না। কারণ, এটা বাজারের খেলা। রাষ্ট্র বা সরকার এই খেলায় কখনো দরিদ্র কৃষক বা উদ্যোক্তার পক্ষে থাকে না; রাষ্ট্র থাকে যে ব্যবস্থার কারণে কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় সেই ব্যবস্থার পক্ষে। সহজভাবে বললে, যারা বাজার সিন্ডিকেট করে তাদের পক্ষে।
বাজারই বলছে, যেদিন থেকে কৃষকের হাত থেকে পণ্য আড়তদারের হাতে গেছে সেদিন থেকেই পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করে। কৃষক যে পেঁয়াজ ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছে সেটি এক সপ্তাহ আগেও বাজারে প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন সেটি ৬০ টাকায় গিয়ে পৌঁছেছে। সরকার সিন্ডিকেট বজায় রাখতে গিয়ে কৃষককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিল।
একই অবস্থা আলুর বাজারেও। কৃষক তার খরচও উঠাতে পারছে না। আলু যে সংরক্ষণ করবে তারও ব্যবস্থা নেই। এখন কৃষকের বাড়িঘরে আলুর স্তূপ। লাখ লাখ টন আলু এভাবে আজ নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কৃষক নানা জায়গায় বিক্ষোভ করছে। অথচ সেই বিক্ষোভের আওয়াজ সরকারের কানে পৌঁছাচ্ছে না।
সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো কর্মসূচি দিয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। তারা সংস্কার আর নির্বাচন নিয়ে সময় পার করে দিচ্ছে। যেন সংস্কার আর নির্বাচন হলেই কৃষকের এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কৃষকের কণ্ঠ ছাড়া বাকি সব কণ্ঠই এখন এ ব্যাপারে চুপ। তাহলে কৃষক যাবে কোথায়?
৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে এই আশা জেগেছিল যে, তারা হয়তো এই বাজার সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা পাবে। কারণ, এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকার একটা কড়া পদক্ষেপ নিতে পারতো। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার মানুষকে হতাশ করেছে। এই সরকার এবং এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা কার্যত কৃষকের পক্ষে না দাঁড়িয়ে সিন্ডিকেটকে বাড়তে দিয়েছেন। শ্রেণিস্বার্থেই মধ্যস্বত্বভোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
ফলে আজ এটা আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে, ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যত পরিবর্তনই হোক, শ্রেণিগত অবস্থান থেকে কৃষক, ক্ষুদ্র চাষির শোষণ-বঞ্চনার কোনো হেরফের হয়নি।