নানামুখী সংকটে দেশ ও জনগণ
Posted: 04 মে, 2025
দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে মেঘ কাটছে না। প্রতিদিন নানা ঘটনাবলি পুরো পরিস্থিতিকে আরো জটিলতর করে তুলছে। মানুষ চোখের সামনে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের স্পষ্ট আলোকরেখা দেখতে পাচ্ছে না।
এসময় বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গকে শুধুমাত্র আলোচনা সমালোচনার মধ্যে না থেকে, আরো দৃঢ়তার সাথে মানুষের মাঝে গিয়ে তাদের সচেতন ও সংগঠিত করার কাজকেই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে।
শ্রমিকদের প্রিয় দিবস মে দিবস পার হলো। নানা কর্মসূচি পালিত হলো। অতীতের মতো এবারের সরকারও শ্রমিকদের নিয়ে কথা বললেন। কিন্তু বাস্তবতা কী? করছেনটা কী?
শ্রমিক শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম চালিকাশক্তি। তাদের শ্রমই নানা সংকটের মধ্যেও দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। তাদের সস্তা শ্রম আমাদের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি বলে অনেকেই মনে করেন। এই কথাটি কেউ অস্বীকার করছেন না। কথাটা অন্যভাবে বলাটাই সঙ্গত। তা হলো, এসব শ্রমজীবীদের সস্তা সময় হলো আমাদের উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি। এটা কি গ্রহণযোগ্য?
মোটেই না। এমনকি ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম স্লোগান হিসেবে সামনে এসেছিল বৈষম্যহীনতার কথা। আর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আকাঙ্ক্ষাতো ছিল সাম্যের। এসব নিয়ে মুখ্যত এখন কোনো আলোচনা নেই। সংস্কার নিয়ে এত কথা হচ্ছে, অথচ শ্রেণিবৈষম্যের আলোচনা যেন উবে গেছে। এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ তো নেই। এমনকি শ্রমিকদের জাতীয় ন্যূনতম মজুরি, শ্রমিক হিসেবে তার মর্যাদা নিশ্চিত ও প্রকৃত কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম, ক্ষেতমজুরদের বারো মাসের কাজের নিশ্চয়তা এবং ভবিষ্যৎ জীবনের একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা নেই।
থাকবেই বা কী করে? এসব করতে গেলে তো চলতি ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। এজন্য চলতি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। অতীতের সরকারগুলোর মতো বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারওতো এ কাজ করবে না। তাদের কাছে এ কাজের প্রত্যাশা করে লাভও নেই। তাই এ কাজটি যারা করতে পারে অর্থাৎ জনমত সংগঠিত করে বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সরকার গঠনের সংগ্রাম জোরদার করতে হবে।
২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর অনেকের মনে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা শাসকগোষ্ঠীর পদক্ষেপ সেই আকাঙ্ক্ষাকে ফিকে করে চলেছে।
নয় মাস পেরিয়ে গেলেও জনজীবনে সর্বত্র ন্যূনতম শৃঙ্খলা ফেরেনি। বহু আকাক্সিক্ষত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট পথরেখার খবর নেই। নানাভাবে দেশে ভয়ের রাজত্ব ও মব সন্ত্রাস চলছে। সুযোগ নিয়ে উগ্র গোষ্ঠী এদেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করছে। নারীবিদ্বেষী ভূমিকা অব্যাহত আছে। সম্প্রতি নারীনীতি সংস্কার কমিটির রিপোর্ট নিয়ে এদের ভূমিকা এই উগ্রতাকে আরো সামনে নিয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও তার অর্জনকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা অব্যাহত আছে। কোনো না কোনোভাবে সরকারি মদত বা নানাভাবে প্রশ্রয় না থাকলে যে এসব ঘটনা ঘটতে পারে না, তা না বোঝর কিছু নেই।
আমাদের দেশকে ঘিরে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী শক্তির অপতৎপরতা দীর্ঘদিনের। এসব নিয়ে বামপন্থিরা দীর্ঘদিন ধরে কথা বলে আসছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা পুনর্বাসন, মিয়ানমার সংকট, এসব নিয়ে এই অপতৎপরতা আরো বেড়েছে।
অনেক কর্মকাণ্ডের মতো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার সীমা অতিক্রম করে, রাখাইনে ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত জানানোর মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের সাম্রাজ্যবাদী অবস্থানকে দৃঢ় করার সুযোগ করে দিতে চাইছে। যা বাস্তবায়িত হলে আমরা দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বো। যুদ্ধাবস্থা বজায় থাকবে। নতুন রাষ্ট্র গঠনে নানা তৎপরতাসহ এ অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী শক্তির নানামুখী কর্মকাণ্ড আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে।
একটা নির্বাচিত সরকারও ক্ষমতায় থাকলে এ ধরনের সংকটে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশবাসীর মতামত নিয়েই সিদ্ধান্তের পথে অগ্রসর হওয়া যুক্তিযুক্ত হতো। অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভোটে নির্বাচিত না হয়েও এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো মহলের মতামত নেওয়ার ন্যূনতম প্রয়োজনও অনুভব করলো না। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে নতুন করে এ প্রশ্ন সামনে এসেছে, এ সরকারের ক্ষমতার লাটাই কোথায়?
দেশের সচেতন মহল বারবার বলছে, দেশে গণতন্ত্রের ধারাকে অগ্রসর করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন জরুরি। ইতোমধ্যে যে সময় পেরিয়ে গেছে তার মধ্যেই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যা সংস্কার করা প্রয়োজন তা করা যেতো। সরকার এই পথে না হেঁটে সংস্কারের ধোয়া তুলে এই কাজটিকে বিলম্বিত করছে।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অপশক্তি নানা অজুহাত তুলে নির্বাচনকে বিলম্বিত করে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে চায়। তাতে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সুবিধা হবে। নির্বাচন হলেই সব সমস্যার সমাধান হবে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে জনগণের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকলে একটা গণতান্ত্রিক ধারা তৈরির পথে হাঁটা যাবে। এই ধারা তৈরি হলে অনেক বিষয় রুখে দাঁড়ানো যাবে। নির্বাচিত সরকার জনস্বার্থবিরোধী কাজ করলে তাকে জবাবদিহি করতে এবং তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সংগ্রাম গড়ে তোলা যাবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিষয়ে এখনো অনেকে ভাবছে না। কিন্তু জনস্বার্থবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হয় এমন কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে এই সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক বাম প্রগতিশীল শক্তির বিকল্প কোনো পথ থাকবে না।
দেশের বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি দীর্ঘদিন ধরে যে লড়াই করছে তার স্লোগান ছিল- “দুঃশাসন হটাও, ব্যবস্থা বদলাও, বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোল”। দুঃশাসক হটানো গেছে, কিন্তু দুঃশাসনের উপাদান রয়ে গেছে। সামগ্রিক ব্যবস্থা বদল ছাড়া যা দূর করা যাবে না। আর এটি করতে পারে নীতিনিষ্ঠ দেশ প্রেমিক বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি।
২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তাতে পাল্টা দখলদারত্ব চাঁদাবাজি উগ্রপন্থার দাপট চলছে অনেক জায়গায়। মানুষ প্রচলিত রাজনীতির প্রতি বিরক্ত হচ্ছে। আবার প্রচলিত রাজনীতির প্রতি বিরক্তি উৎপাদন করে বিরাজনীতিকরণের প্রচেষ্টাও থেমে নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঘটনাবলি সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা আমাদের এসব শিক্ষা দিচ্ছে। তাই এসময় সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে দৃঢ়তার সাথে জনস্বার্থে বিকল্প গড়ে তুলে মানুষকে সচেতন করে নীতিনিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তির পতাকাতলে সাধারণ মানুষকে সমবেত করতে প্রতিদিন পরিকল্পিত ভূমিকা নেওয়া এবং প্রগতিশীল দল সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের ঐক্য গড়ে তোলাই সময়ের দাবি।
এক্ষেত্রে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকেই অগ্রসর হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও ১৯৯০ এবং ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ হতে দেওয়া যাবে না।