নববর্ষ উৎসবটি প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ একটি অনুষ্ঠান

Posted: 13 এপ্রিল, 2025

বাংলা নববর্ষ শুধু বছরের শুরুর দিনমাত্র নয়। এটি হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গও বটে। বৈশাখের প্রথম দিনে বাঙালি জাতির নিজস্ব স্বকীয়তা তুলে ধরার প্রাণের উৎসবে মেতে উঠে গোটা দেশ। ‘তপোবহির শিখা জ্বালো জ্বালো/নির্বাণহীন নির্মল আলো/অন্তরে থাক জাগি।’ এ দিনকে কেন্দ্র করেই জেগে উঠে বাঙালির প্রাণ। কিন্তু বাঙালির এই প্রাণপ্রবাহ স্তব্দ করে দিতে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। পাকিস্তান আমলে বাঙালি সংস্কৃতির ওপর যে ক্রমাগত হামলা হয়েছে পাকিস্তানি শাসক ও সামরিক-বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে, তার প্রত্যুত্তর হিসেবে বাঙালি তার একটি সার্বিক পরিচিতি নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছে। ওই পরিচিতিটি শুধু ধর্মের একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল ছাড়া সব ক্ষেত্রেই ছিল পৃথক এবং ধর্মের ক্ষেত্রেও বাঙালির উদারপন্থি চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ পাকিস্তানিদের কট্টরপন্থি ও গোঁড়া ধর্মচিন্তা ও চর্চার বিপরীতে ছিল। বাঙালির নিজস্ব পরিচিতি প্রতিষ্ঠায় আরও অনেক উপাদানের সঙ্গে তার লোকজ আচার-অনুষ্ঠান এবং জীবনচর্চার বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। নববর্ষ উৎসবটি প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ একটি অনুষ্ঠান- এটি হিন্দুর নয়, মুসলমানের নয় অথবা বৌদ্ধের নয়। এ উৎসব সব বাঙালির। যে ধর্মনিরপেক্ষ ও অগ্রসরবাদী চিন্তা বাঙালি সংস্কৃতির একান্ত একটি বৈশিষ্ট্য, সেটি নববর্ষের উৎসবে সহজেই শনাক্ত করা যায়। এজন্য ষাটের দশকজুড়ে ঢাকায় নববর্ষের উদযাপনকে একটি বিশাল রাজনৈতিক গুরুত্বে উপস্থাপন করা হতো। খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা নববর্ষ প্রবর্তন করেছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। তবে তা এখন আর খাজনা আদায়ের হিসাব-নিকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ঋতু পরিক্রমায় বৈশাখকে বিবেচনা করা হয় শস্য রোপণের মাস হিসেবে। বৈশাখে খরতপ্ত মাঠ নবধারাজলে সিঞ্চিত হলে কৃষক হালকর্ষণ শুরু করেন, বীজ বুনেন, আশায় বুক বাঁধেন সোনালি ফসলের। বৈশাখে দোকানি সারাবছরের হিসাব-নিকাশ করতে হালখাতা খোলেন। বৈশাখ আসে বাঙালি জীবনে নতুন শস্যের আবাহন নিয়ে, আসে বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মীর বেশ ধরে। সমস্ত অপশক্তিকে ধুয়ে মুছে বাঙালির সার্বজনীন উৎসবের আনন্দময় দিন এই পহেলা বৈশাখ। দিবসটি এদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরাও পালন করেছে নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী। তারা তাদের নিজেদের আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে বছরের এই প্রথম দিনটিকে বরণ করবে। আনন্দঘন উৎসবের উত্তাপে ভেসে যাবে পুরানো দিনের যত গ্লানি। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই নানা মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়েই বৈশাখি উৎসবের সূচনা হয়। এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকে বাঙালির জীবন-সম্পৃক্ত নানা উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়েই উচ্চারিত হবে- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। রসের আবেশরাশি/শুষ্ক করে দাও আসি, আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ। মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।... এসো, এসো, এসো, হে বৈশাখ।’ দুনিয়ার অনেক দেশের মত আমাদের দেশের সরকারি-বেসরকারি সকল কাজকর্মের হিসাব চলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। তারপরেও বাঙালি জীবনে পহেলা বৈশাখের স্থান অনেক ঊর্ধ্বে। যুগ যুগ ধরে কৃষক-শ্রমিকসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে এ দিনটিকে উদযাপন করে আসছে। বাঙালির এই প্রাণের উৎসবকে ব্যাহত করতে আমরা বিভিন্ন সময়েই এদেশে মৌলবাদীদের অপতৎপরতা দেখেছি। ২০০১ সালে রমনার বটমূলে স্থাপিত পশুশক্তির তা-বে ঝরে গিয়েছিল ১০টি প্রাণ। আহত হয়েছিলেন অনেকেই। এখনো সেই মামলার কোনো কিনারা হয়নি। সেদিন মুহূর্তেই যেন থমকে গিয়েছিল বাঙালির প্রাণের উৎসব। কিন্তু বাঙালি এখন এক জাতি, তাঁকে বাধা দেয়া যায় বটে, কিন্তু আটকিয়ে রাখা যায় না। বাঙালি যেন পণ করেই নিয়েছে ‘আমরা সহস্র ২০ অজস্র মৃত্যুতে। হত্যা করে বাঙালিকে যে তাঁর শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া যায় না, পহেলা বৈশাখ আমাদের সেই চেতনারই প্রধান অনুষঙ্গ।