বন্যা আসে, বন্যা যায়
Posted: 27 অক্টোবর, 2024
১৯৮৮ থেকে ২০২৪। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার দেশে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, কাক্সিক্ষত, অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা, রটনার মধ্যেই এগিয়েছে দেশ। কিন্তু শোষণ কৌশলের পরিবর্তন আসেনি। বন্যা নামের প্রাকৃতিক দুর্যোগের পেছনে কারণ বলা হয় নিয়ন্ত্রণহীন মানুষ, শহর, নগর, গ্রাম। আবাসস্থল বেড়ে যাওয়াসহ নানান কিসিমের কৃত্রিম সংকট আমাদের চিরাচরিত। আমরা পেয়েছি অপরিকল্পিত, নিম্নমানের স্থাপনা, সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট। আছে প্রচুর বর্জ্যের স্তূপ। বেদখলিদের অপরিকল্পিত স্থাপনা যত্রতত্র। আছে অতিবৃষ্টি। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া। উজানের নেমে আসা ঢলের চাপ। দ্রুত পানি নেমে যাওয়ার পথগুলো সংকুচিত। কোথাও নদী বিলুপ্তির পথে। কোথাও নদী অধুনা বিলুপ্ত।
আগের অভিজ্ঞতা বলে- টানা পনের বা বিশ দিন বৃষ্টি হলেও সেই পাানি নেমে যেত নালা দিয়ে খালে, খাল থেকে বিলে কিংবা নদীতে। এখন কি সেই পথগুলো আছে? পানি উন্নয়ন বোর্ড নামে একটা বোর্ড আছে। তাদের মহা মহা পরিকল্পনা, প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকার লুটপাট, অপচয়, দুর্নীতির যে নমুনা আমরা দেখেছি, এখন তার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। বন্যার কারণ নিয়ে রাজনৈতিক উস্কানির যৌক্তিক, অযৌক্তিক আলোচনায় কোনো সমাধান আসেনি, আসবেও না। বরং প্রতিবেশী দেশের সাথে বিষয়টি সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে কূটনৈতিক সমাধানে অগ্রগতি হতে পারে।
বন্যার আগাম পূর্বাভাস থাকার পরেও আমাদের জন্য নেই টেকসই উদ্যোগ। বন্যা মোকাবিলার আগে, পরের পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে কোনো কর্মপরিকল্পনা আজ পর্যন্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা নেই। যারা ঐ পর্যায়ে কাজ করেন তারা সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারার জন্যই গদিতে আসীন হন। মানুষের দ্বারে দ্বারে সমর্থন, ভোট চেয়ে বেড়ান। নানান প্রতিশ্রুতি দেন। বন্যাদুর্গত এলাকায় বিগত দিনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা একাধিকবার (যে উপায়েই হোক) প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংসদে গেছেন। কিন্তু বন্যা নিয়ে ওই অঞ্চলের জন্য কতিপয় ফটোসেশন আর দলের লোকজন, আমলা কর্তৃক জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের বাজেট ভক্ষণ ছাড়া আর কিছুই ঘটেনি বলে প্রতীয়মান হয়।
এবারের ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ পরবর্তী পট পরিবর্তনে সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষের মধ্যে একটা আশাবাদ জেগেছিল, কালরাত্রির অবসান বুঝি হতে চলেছে। কিন্তু কতটা? প্রশ্নের পর অনেক প্রশ্ন। মানুষের মনের কষ্ট, দুর্ভোগকে তারা কতটা অনুভব করতে পারছেন, সেটাই এখন বিবেচ্য। ভুক্তভোগীরা কেবলমাত্র ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে।
বেসরকারি পর্যায়ের ক্লাব, সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বানভাসিদের ত্রাণের চেষ্টা করে, এটা আমাদের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ও জীবনযাত্রার উপকরণগুলোর তুলনায় এই ত্রাণ কেবলমাত্র সান্ত¡না। বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনে বিশাল আকৃতির কর্মপরিকল্পনা জরুরি ভিত্তিতে নেয়াটা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়। কাজেই মাঠ পর্যায়ে ভুক্তভোগীরা এসময় নিজ নিজ অবস্থান থেকে দাবি দাওয়া করতেই পারে। বিশেষ করে কৃষক, মজুরসহ নিম্নআয়ের মানুষ যারা দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাদের আবাসন, উৎপাদন বিষয়ে পুনর্বাসন দ্রুতই প্রদায়ক হিসেবে গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
বন্যার আসা-যাওয়ার পালা চলমান থাকবে আমাদের দেশের ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে। এক বন্যা যায়; বন্যার্তরা ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আরেক বন্যা চলে আসে। আর এটাকে ঘিরে যে পরিমাণ লুটপাটের সংস্কৃতি আমাদের দেশে চালু আছে তার কতটা সঠিক ও স্বচ্ছতার সাথে, সঠিক স্থানে ব্যয়িত হবে তার নিশ্চয়তা সময়ের দাবি।
লেখক : সভাপতি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, শ্যামগঞ্জ শাখা, ময়মনসিংহ