বিজ্ঞানে নারীর অবদান ও প্রতিবন্ধকতা
Posted: 28 জুলাই, 2024
একতা ফিচার :
মানব সভ্যতার শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অসংখ্য উত্থান-পতনের ইতিহাস আছে। যার প্রথমটা জুড়ে নারী পুরুষের অবদান ছিল সমান। অনুমান করা হয় আগুনের আবিষ্কার বা গার্হস্থ্যায়ন করেছে নারী। যদি তা নাও হয়, নারীরাই আগুন ও তাপ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খাদ্য সংরক্ষণ করতে শিখেছে। নারীদের হাতেই ১৫ থেকে ২০ হাজার বছর আগে কৃষিকাজের সূচনা হয়। সমাজকে মৃৎপাত্র তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়া, সুতা কাটার পদার্থবিদ্যা, তাঁতের প্রযুক্তি এবং শন ও তুলার উদ্ভিদবিদ্যার জ্ঞানদানের কৃতিত্ব শুধুমাত্র নারীদের। নারীরাই প্রথম চিকিৎসক, শিল্পী, প্রকৌশলী। নারীদের বাসস্থান শুধু রন্ধনশালা ও সেলাইকক্ষ দিয়ে সাজানো ছিল না। নিজ বাসগৃহে তারা তৈরি করেছে বিজ্ঞান গবেষণাগার।
ইতিহাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য করা গেছে বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র ও চিকিৎসাবিজ্ঞান সর্বত্রই নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইতিহাসবিদদের অনিয়ম এবং অবমূল্যায়নের কারণে সভ্যতার ইতিহাসে নারীদের সংখ্যা ক্রমশ কমে এসেছে। তারপরও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জাল ভেদ করে অনেকে আমাদের সামনে চলে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: হাইপেশিয়া, লরা বেসি, সোফিয়া কোভালেভস্ক্যায়া, লাইস মিটনার। যদিও বেশিরভাগ ইতিহাসবিদই যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের অবদানগুলোকে আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখতে। এই কয়েকজন নারী ছাড়াও ক্যারলিন, মেরী এ্যানি ল্যাভিয়েসিয়ের এবং ডি.এন.এ গবেষক হার্সেল রোজালিন ফ্রাঙ্কলিনের কথা উল্লেখ করা যায়; যারা তাঁদের পুরুষ সহযোগীদের সাথে একনিষ্ঠচিত্তে কাজ করেছেন। অথচ ঐ সহযোগীরাই এক সময় তাদের অবদানকে ক্রমশ অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে গেছে। তাছাড়া আরো কিছু নারীর কথা উল্লেখ করা যায়, যাদের অবদান স¤পর্কে নামমাত্র তালিকা করা হয়েছে এবং অন্যান্যদের সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি কেবলমাত্র নিজস্ব কৌতুহল ও আনুসঙ্গিক নির্দেশনার মাধ্যমে। আর নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে অবশিষ্টদের জীবনযাত্রা ও কাজের অস্তিত্ব স¤পর্কে আমরা হয়তো ভবিষ্যতেও কিছু জানতে পারবো কিনা সন্দেহ! সর্বোপরি এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নারীরা সভ্যতার উষালগ্ন হতে পুরুষশাসিত সমাজের সীমাবদ্ধতায় পথ হারিয়েছে বারবার। তারপরও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সীমাবদ্ধতাকে পেছনে ফেলে যে সকল নারী বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলোকশিখা জ্বালিয়েছেন। সেই ১৯০৩ সালে মেরি কুরি বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান, তারপর মেঘে মেঘে বহু বেলা গড়িয়েছে। মেরি কুরির পরে রসায়নে, পদার্থ চিকিৎসা শাস্ত্রে ছয়শ পুরুষ নোবেল বাগিয়ে নিতে পারলেও, নারীরা পেয়েছেন মাত্র ১৯টি।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বিশ্বব্যাপী জ্ঞানের জগতে নারীদের এই অসম উপস্থিতি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও মুক্ত নয়। বাকি বিশ্বের চাইতে এই অঞ্চলের নারীরা কিছুটা বেশি সুযোগ সুবিধা পায়। অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, এ অঞ্চলে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে মাত্র একজন নারী। জার্মানি ও ফিনল্যান্ডের চিত্র আরও খারাপ। সেখানে এই পেশায় প্রতি তিনজনে মাত্র একজন নারীর খোঁজ মেলে।
তবে এর উল্টো চিত্রও বিশ্বের একটি অঞ্চলে দেখা যায়। নেদারল্যান্ডসের লেইডন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর গবেষণাগারে পুরুষের তুলনায় নারীর উপস্থিতি সমান, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশিও। হিসেবে দেখা যাচ্ছে, লাটভিয়ার বিজ্ঞানী এ প্রকৌশলীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী। গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশে বনারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে পোল্যান্ড ও সার্বিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবচেয়ে এগিয়ে।
প্রশ্ন হলো, যেখানে বাকি বিশ্বে বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের মধ্যে নারীদের উপস্থিতি অনেক কম, সেখানে কীভাবে এই অঞ্চলে এগিয়ে? ইকোনমিস্ট বলছে, ওয়ি অঞ্চলের ভৌগলিক ইতিহাসে উত্তর লুকিয়ে আছে। এসব অঞ্চল এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই সময় পরীক্ষাগারে নারীদের সমান উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কঠোর নীতি নিয়েছিলেন। পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও বিজ্ঞানে আগ্রহী করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন ‘সাবেক’ হলেও পরীক্ষাগারে নারীদের উপস্থিতি এখনো রয়ে গেছে।
ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট ফর জেন্ডার ইকুয়ালিটি অনুযায়ী, যদি বিজ্ঞানভিত্তিক পেশায় নারী-পুরুষের সমান উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অঞ্চলের জিডিপি অন্তত ৩ শতাংশ বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলে ১২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। গত দশক জুড়ে অন্য যে কোনো পেশার তুলনায় ইউরোপের প্রযুক্তি খাতে চার গুন বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় কমিশনের ধারণা, ওই অঞ্চলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে পাঁচ লাখ দক্ষ লোকের অভাব থাকায় সেখানকার সামগ্রিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তবে বিজ্ঞানী হিসেবে নারীদের কম উপস্থিতির কারণ আরও আছে। নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, নারীরা যতই ওপরের শ্রেণিতে ওঠে, ততই বিজ্ঞানের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়। বিশেষ করে কলেজ শেষ হওয়ার পরে এসব বিষয়ের সঙ্গে অধিকাংশ নারী শিক্ষার্থীর সম্পর্ক একেবারে মুছে যায়। এর অন্যতম কারণ, পারিবারিক দায়িত্ব, এছাড়া এখনো বেশির ভাগ গবেষনাগারে দেখা যায় সহযোগিরা মুলত পুরুষ, এক্ষেত্রে গভীর রাত অবধি একজন নারীর একা কাজ করে যাওয়া আমাদের এই দেশে অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে পরে। আবার অনেক সময় দেখা যায় ফিল্ডে গিয়ে ভারীভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ কর্ম করতে যাওয়ার পথেই তাদের অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হয়।
গবেষকরা বলছেন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতে যা একত্রে সংক্ষেপে স্টেম নামে পরিচিত তাতে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের ফাঁক থাকাটাই এর জন্য দায়ী। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বিষয়ক আইনি প্রতিষ্ঠান পাওয়েল এন্ড গিলবার্টের অংশীদার পেনি গিলবার্টের মতে, এটা একটি পাইপলাইন ইস্যু মাত্র। সারা বিশ্বেই পুরুষের তুলনায় নারী গবেষকের হার সীমিত। বর্তমান বিশ্বের মোট গবেষকের মধ্যে মাত্র ২৮ শতাংশ নারী। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় নারী-পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণই অপরিহার্য। কেননা একজন নারী হয়ত একজন পুরুষের তুলনায় ভিন্নভাবে কোন বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান করতে পারেন। একই বৈজ্ঞানিক সমস্যার একাধিক সমাধান হলে সবচেয়ে কার্যকরী সমাধানটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান ও গবেষণায় নারীর এই সীমিত অংশগ্রহণের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় বিজ্ঞান গবেষণাকে পেশা হিসেবে নেয়ার আগ্রহের অভাব।
বিজ্ঞান শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। নারীদের মাঝে বিজ্ঞান গবেষণাকে পেশা হিসেবে নেয়ার আগ্রহ তৈরি করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে এ লক্ষ্যে বিভিন্ন রকম সংগঠন গড়ে তোলা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ৫০০ ওমেন সাইনটিস্ট সংঘের কথা। এ সংঘটি নারীদের মাঝে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তারা বিজ্ঞানে নারীর অবদান ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করে এ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে।
অনেক সময় প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্রীদের মাঝে বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে নানা রকম ভীতি কাজ করে। তাই তারা বিজ্ঞান শাখার পরিবর্তে মানবিক বা ব্যবসায় শাখায় বেশি ভর্তি হয়। এই ভীতি দূর করতে স্কুলগুলোতে বিভিন্ন রকম আকর্ষণীয় বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যেসব শিক্ষার্থী বিজ্ঞান শিক্ষায় অধ্যয়নরত আছে তাদেরকে বিজ্ঞান পেশার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে পরামর্শ দান করা যেতে পারে। বিজ্ঞানের কোন কোন শাখায় নারী বিজ্ঞানীর ঘাটতি রয়েছে সেটি আলোচনা করা যেতে পারে। যে সকল নারী বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বড় বড় আবিষ্কারে অবদান রেখেছেন তাদের কথা তুলে ধরা যেতে পারে।
এছাড়া পরিবারের সকলে মিলে মেয়েদের বিজ্ঞান শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের মাঝে বিজ্ঞান শিক্ষায় নারীর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অভিভাবক সভার মাধ্যমে তাদের মেয়ে সন্তানদের বিজ্ঞান শিক্ষায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও এ সম্পর্কে প্রচারণা চালানো যেতে পারে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের বিজ্ঞান চর্চায় আরও বেশি জড়িত করতে পারে। এতে করে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের জগতে নারী বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে এবং নারী বিজ্ঞানীদের অবদানকে কাজে লাগিয়ে দেশ উন্নত হতে পারে। সাথে সাথে তা জাতীয় মর্যাদাও বৃদ্ধি করবে।