ভারতের লোকসভা নির্বাচনের কতগুলি দিক
Posted: 09 জুন, 2024
ভারতের এবারের লোকসভা নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে, মোদীর সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগের রাজনীতি আর কতটা কার্যকর, এসব বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। এই নিবন্ধেও ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নিবন্ধটি লিখেছেন সীমা চিস্তি
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল অনেক বিষয়কেই সামনে এনে হাজির করেছে। সবকিছুকে সবিস্তারে আলোচনায় আনার হয়তো এখনো সময় আসেনি। তবু তারই কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।
১. মন্দির অভিযান
উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার রামমন্দির ছিল বিজেপি’র সমস্ত আত্মবিশ্বাসের কেন্দ্রস্থলে, যা ২০২৪-এর ফলাফল চুরমার করে দিয়েছে। বিজেপি রামমন্দিরকে ভোট কুড়োনোর যন্ত্র ভেবেছিল। নরেন্দ্র মোদী, যোগী আদিত্যনাথ এবং সামগ্রিকভাবে গোটা বিজেপি দলই রামমন্দিরের কথা বলেই ভোট চেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খোদ ফৈজাবাদ আসনটিই (অযোধ্যা যার অন্তর্গত) তারা হারিয়েছে। সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সমাজবাদী দলের প্রার্থী দলিত সন্তান অবধেশ প্রসাদ ৫৪,৫৬৭ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী এবং সেই অঞ্চলের অযোধ্যা অভিযান-পরবর্তী সমস্ত নির্বাচনী সাফল্যের প্রবীণ কাণ্ডারী লাল্লু সিংকে। মন্দির তাস কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল এটা তারই প্রতীক।
২. ব্যবধানের উপযোগিতা
বারাণসীতে নরেন্দ্র মোদীর জয়ের ব্যবধান (১,৫২,৫১৩) রাহুল গান্ধীর রায়বেরিলির জয়ের ব্যবধানের (৩,৯০,০৩০) অর্ধেক। এটা এমনকী স্মৃতি ইরানির হাত থেকে আমেথি পুনরুদ্ধারে কংগ্রেস প্রার্থী কিশোরী লাল শর্মার চেয়েও কম। শর্মা জিতেছেন ১,৬৭,১৯৬ ভোটের ব্যবধানে। মনোনয়নপত্র পেশ করার সময়ে গঙ্গাবক্ষে মোদী দাবি করেছিলেন তিনি ঈশ্বরপ্রেরিত। তার জয়ের ব্যবধানের এই শোচনীয় হ্রাস ঈশ্বরপ্রেরিতের ধারণারও অবসান ঘটাবে আশা করা যায়।
৩. ধুবড়ির দুর্নামের আয়ুও শেষ
আসামে ‘মুসলিম’ ভোট বললে ধুবড়ি আসনকেই বোঝায়। আর আসামে ধুবড়ি মানে বদরুদ্দিন আজমলের দল এআইইউডিএফ-এর হেসে খেলে জয়। এতদিন বলা হত মুসলিম ভোটদাতারা নিজেদের মূলধারার রাজনৈতিক দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘মুসলিম দল’গুলির দিকে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। কিন্তু কংগ্রেস প্রার্থী রকিবুল হোসেনের কাছে ১০,১২,৪৭৬ ভোটের রেকর্ড ব্যবধানে আজমলের পরাজয় অন্য আখ্যানের প্রতিনিধিত্ব করছে।
৪. কেরল ঈশ্বর নয়, ঈশ্বরের নিজের দেশ
ত্রিসুর আসন প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বিজেপি স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার কেরলে নির্বাচনী রাজনীতিতে খাতা খুলল। সুরেশ গোপীর জয়ের ব্যবধান ৭৪,৬৮৬। এর সাথে রাজ্যে বিজেপির প্রাপ্ত ১৬.৬৮ শতাংশ উত্তর ও দক্ষিণের বিভাজনের সরল ব্যাখ্যাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিল। এবং এটা অত সহজ ব্যাখ্যার বিষয় নয়। আরএসএস শাখার ব্যাপক প্রসার ও দল হিসেবে বিজেপি’র মরিয়া প্রচেষ্টা এতদিনে পেল সাফল্য। অ-বিজেপি শক্তিগুলি যেভাবে বিজেপি-র সম্প্রসারণের সম্ভাবনাকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে এসেছে এটা তার জন্যে একটি সতর্ক-সংকেত। প্রতিবেশী রাজ্য তামিলনাডুতে সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগের পাশাপাশি গোন্ডার নেতা কে, আন্নামালাই ও অন্যান্য অনগ্রসর জাতি-নির্ভর সক্রিয়তাকে কোনও অবস্থাতেই ছোট করে দেখা উচিত হবে না। তামিলনাড়ুতেও বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোট এখন ১১ শতাংশের একটু বেশি।
৫. হিন্দি এলাকায় ভোটের হিসাব
উত্তরপ্রদেশ ও বিহার, এই দুই রাজ্যেই বিজেপির প্রাপ্ত ভোটে প্রায় ৮ শতাংশ হ্রাস ঘটেছে। তবে এই হ্রাসের হার আসন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে চমকপ্রদভাবেই আলাদা। উত্তরপ্রদেশে এর ফলে মোট আসন ৮০-র মধ্যে বিজেপির প্রাপ্ত আসন ৩৩। অথচ, একই হারে হ্রাসের পরেও বিহারে মোট ৪০টি আসনের মধ্যে এনডিএ-এর প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ২৯। রাজস্থানে গতবারের তুলনায় বিজেপি-র ভোটপ্রাপ্তির হার কমেছে ১২ শতাংশ।
৬. নোটার অধিকার থেকে বঞ্চিত
প্রায় ১৬.৫৫ লক্ষ ভোটদাতা এবার ভোট দিতে পারেননি। এটা গুজরাটের সুরাটে মোট ভোটদাতার সংখ্যা যেখানে একটি বিস্ময়কর ঘটনাক্রমের পর বিজেপি প্রার্থী মুকেশ দালালই থেকে যান একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। আরেকটি আসন ইন্দোর থেকেও শোনা যায় যে বিভিন্ন প্রার্থীদের জোর করে অথবা ‘বুঝিয়েসুঝিয়ে’ প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়া হয়। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন না কোনও কংগ্রেস প্রার্থী। এবং একজন এসইউসি প্রার্থী সংবাদ সংস্থাকে জানান কীভাবে তাঁকে ও অন্যান্য নির্দলীয় প্রার্থীদের সরে দাঁড়ানোর জন্যে জোরাজুরি করা হয়। তিনি প্রত্যাহার করেননি। পেয়েছেন ৭,১৭৯ ভোট। কিন্তু নোটার পক্ষে রায় দেন ২,১৮,৬৭৪ জন ভোটার।
৭. সবকা বিকাশ নয়
ভারতের একমাত্র মুসলিম প্রধান সাবেক রাজ্য কাশ্মীরে বিজেপি-র প্রার্থী দেওয়ার সাহস হয়নি। বৌদ্ধ প্রভাবিত লাদাখে বিজেপি প্রার্থী তৃতীয় স্থান পেয়েছে। কুকি-জো জনগোষ্ঠীর প্রতি হিংসার অভিঘাত পড়া রাজ্য মিজোরামে বিজেপি প্রার্থী সম্ভবত চতুর্থ স্থান নেমে গেছে। খ্রিস্টান প্রধান নাগাল্যান্ডে বিজেপির কোনও প্রার্থী ছিল না। শিখ প্রাধান্যের রাজ্য পাঞ্জাবে বিজেপি শূন্য পেয়েছে। এবং তিনটি আসনের মধ্যে মাত্র দু’টি আসনে দ্বিতীয় স্থানে থাকতে পেরেছে। মুসলিম প্রধান লাক্ষাদ্বীপে বিজেপির ছিল না কোনও প্রার্থী।
৮. বাঁশওয়ারা ও বনসকণ্ঠে নজর
২১ এপ্রিল রাজস্থানের বাঁশওয়ারায় নির্বাচনী প্রচার সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবারের নির্বাচনী প্রচারের প্রথম ঘৃণাভাষণটি রাখেন। তিনি বলেন, ‘কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা বলেছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তির প্রথম দাবিদার দেশের মুসলিমরা। এর অর্থ, ওরা সকলের সম্পদ কেড়ে নেবে এবং তারপর যাদের সন্তান সংখ্যা বেশি (মুসলিমদের ঠেস দিয়েছেন) তাদের দিয়ে দেবে। তারা এই সমস্ত সম্পদ দিয়ে দেবে অনুপ্রবেশকারীদের (ঘুসপেটিয়া)। আপনারা কি আপনাদের কষ্টার্জিত সম্পদ আক্রমণকারীদের দিতে চান? কংগ্রেসের ইস্তেহার এই কথাই বলেছে, আমাদের মা বোনেদের যে স্বর্ণালঙ্কার আছে সেগুলো পরিমাপ করা হবে, সংগ্রহ করা হবে এবং দান করে দেওয়া হবে। এই সম্পদ তাদের বিতরণ করে দেওয়া হবে... মনমোহন সিং সরকার বলেছিল সম্পত্তির প্রথম দাবিদার মুসলিমরা। এই সমস্ত শহুরে নকশালরা আমাদের মা বোন বা তাদের মঙ্গলসূত্রকেও ছাড় দেবে না। তারা এত দূর পর্যন্ত যাবে।’ ওই আসনে বিজেপি প্রার্থী রাজ কুমার ইন্ডিয়া জোটের অংশীদার ভারত আদিবাসী দলের প্রার্থীর কাছে ২,৪৭,৫০৪ ভোটে গো-হারা হেরেছেন।
গুজরাটের বনসকণ্ঠেতে ১ মে মোদী ‘দুই মোষ’-এর প্রসঙ্গ তুলেছেন। তিনি বলেছেন, আপনার যদি দু’টো মোষ থাকে, তবে ইন্ডিয়া জোট একটা কেড়ে নেবে এবং তাদের ভোট ব্যাঙ্ককে দিয়ে দেবে। এই আসনে কংগ্রেস দলের বেণীবেন নাগাজী ঠাকোর ৩০,৪০৬ ভোটে জয়ী হয়েছেন। এক দশকের মধ্যে গুজরাটের এটাই প্রথম লোকসভা আসন, যেখানে কোনও অ-বিজেপি প্রার্থী জয়লাভ করলেন।
৯. মোদীর নির্বাচনী ঝটকা
নরেন্দ্র মোদী, তাঁর ২৩ বছরের নির্বাচনী জীবনে এবারই প্রথম পেলেন না সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পাওয়া হলো না অর্ধেক আসনও। গুজরাটে ২০০২ সাল থেকে এবং জাতীয় ক্ষেত্রে ২০১৪ সাল থেকে বিভাজনের রাজনীতির যে কুৎসিৎ ভক্তিবাদ তাঁর নামে চলেছে তার ওপর নেমে এসেছে প্রবল আঘাত। ৪৮ পৃষ্ঠার ইস্তেহারে নিজের নাম ৬৭ বার উল্লেখ করে তিনি এই নির্বাচনকে তাঁর নিজের বিষয়কে যেভাবে গণভোটে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, তার নিরিখে বলা যায় এই ফলাফল একইসঙ্গে অবশ্যই তাঁর ব্যক্তিগত পরাজয়ও।
লেখক : সীমা চিস্তি
ভাষান্তর : শুভ প্রসাদ নন্দী মজুমদার
সূত্র : মার্কসবাদী পথ