বাজারে বাড়ে দাম সরকারের হুঙ্কারই সার

Posted: 11 ফেব্রুয়ারী, 2024

স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫২ বছর পার হলেও দেশে একটি স্থিতিশীল বাজারব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি সরকার। অতি মুনাফার লোভে নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করছে লুটেরা ব্যবসায়ীরা। ফলে মূল্যবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় প্রতিনিয়ত কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। চালসহ অধিকাংশ পণ্যের দাম অস্বাভাবিক ও অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ায় জীবন যন্ত্রণায় কাতর দেশবাসী। লুটের টাকায় ভোগ-বিলাসে গা ভাসানো উচ্চবিত্তরা অবস্থা সামাল দিতে পারলেও মধ্যবিত্তের অবস্থা খুবই করুণ। আর কোনো রকমে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে নিম্নবিত্ত বা গরিব মানুষ। পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতা দখলের পর পরই বাজারে নতুন করে বেড়ে গেছে চালসহ বেশিরভাগ পণ্যের দাম। নির্বাচনের সময় বাজারে তদারকি শিথিল হয়ে পড়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দেয়। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণেই ধানের বাম্পার ফলনের পরও ভরা মৌসুমে চালের দাম বেড়েছে। শীত যায় যায় করলেও শীতকালীন সবজির দাম চড়া। তেল, লবণ, চিনি, পেঁয়াজসহ এমন কোন পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। রোজার মাস সামনে রেখে গত কয়েক বছর ধরেই ব্যবসায়ীরা কৌশলে অনেক আগেই দাম বাড়িয়ে রাখে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। আগের মতোই ভোটের পর নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বাজারে গিয়ে হাঁকডাক দিচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা কোন কোন পণ্যের দাম দুই-এক টাকা কমিয়েও দিচ্ছেন। এটা হলো তাদের খেলা। আগে ৫-১০ টাকা দাম বাড়িয়ে রেখে পরে এক-দুই টাকা কমিয়ে দেয়া হয়। এতে সরকার আত্মতুষ্টিতে বগল বাজালেও সাধারণ মানুষকে দামের আগুনেই পুড়তে হয়। জীবন-জীবিকার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ‘বাজার ব্যবস্থাপনা’ ও ‘দ্রব্যমূল্য’ নিয়ে এদেশে যতোটা রাজনীতি হয়েছে, তার চেয়ে সুনির্দিষ্ট কাজ হয়েছে অনেক কম। আজ পর্যন্ত দেশে একটি স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক বাজার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারেনি সরকার। ফলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে গৃহিত বেশির ভাগ উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। অবশ্য দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটির ফায়সালা করতে হবে– তা হলো সরকার তা চায় কিনা? আশা করা যায়, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের কাছে দায়বদ্ধ যে কোনো সরকারই তা চাইবে। এরপর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো– কীভাবে চায়? এ প্রশ্নেই চলে আসে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির বিষয়টি। এক্ষেত্রে সরাসরি প্রশ্নটি আসে– দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকার বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়, নাকি চাহিদা-যোগানোর ওপর নির্ভর করে ‘মুক্তবাজার’ ব্যবস্থায় মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল হতে চায়। নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ বা গণরোষের ভয়– যে কারণেই হোক না কেনো, প্রতিটি সরকারই বাজারের ওপর কম-বেশি নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করে থাকে। যদিও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারা ‘মুক্তবাজার’ নীতি গ্রহণ করেছে। দেশীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পণ্য উৎপাদন বা সরবরাহ সংকটের প্রভাব কিংবা অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে যখনই দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে– তখন কোনো না কোনোভাবে ‘মুক্তবাজার’ তত্ত্বকে এর রক্ষা কবচ হিসেবে সামনে আনা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, ‘মুক্তবাজার’ যদি দিনের পর দিন মানুষের দুর্ভোগই বাড়াবে, তাহলে সেই ব্যবস্থা বাদ দেয়াই কি শ্রেয় নয়? সাধারণ মানুষের ‘প্রকৃত আয়’ ও ‘ক্রয়ক্ষমতা’ বৃদ্ধি কিংবা ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ’ করতে হলে রাষ্ট্র ও সরকারকে অবশ্যই কার্যকর পথ গ্রহণ করতে হবে। ‘বাজার মৌলবাদ’ (মার্কেট ফান্ডামেন্টালিজম) নীতি আঁকড়ে ধরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রচেষ্টাই সফল হবে না। মুক্তবাজার নীতি বহাল রেখে বহুজাতিক কোম্পানি এবং মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষাই যদি মূল লক্ষ্য হয়– তাহলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ অব্যাহত থাকবে– এটাই স্বাভাবিক।