২৯ বিমা কোম্পানির হাতে জিম্মি দশ লাখ গ্রাহকের টাকা
Posted: 19 নভেম্বর, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক :
তারল্য সংকটের কারণে দেশের ২৯ জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান অর্থ পরিশোধ না করায় অন্তত ১০ লাখ গ্রাহকের বিমা দাবি নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। মেয়াদপূর্তির পরও টাকা ফেরত পাচ্ছেন না লাখ লাখ বিমা গ্রাহক। এসব ঘটনার কারণে দেশের মানুষের বিমা কোম্পানির প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়। ৫০ লাখ মোটরচালিত যানবাহনের মধ্যে বিমার আওতায় আছে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার ৬২৬টি। দেশে ৮১টি বিমা কোম্পানি থাকলেও তার আওতায় আছে মাত্র ২ কোটি মানুষ।
দেশের বিমাখাত নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত চার বছরে গ্রাহকদের দুই হাজার ৭০ কোটি টাকার বিমা দাবি নিষ্পত্তি করেছে দেশের বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো। এটি মোট বিমা দাবির ৪০ দশমিক ৪২ শতাংশ। একই সময়ে আরও মোট তিন হাজার ৫০ কোটি টাকার বিমা দাবি অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে।
বীমা হল অর্থের বিনিময়ে জীবন, সম্পদ বা মালামালের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ন্যায়সঙ্গত ও নির্দিষ্ট ঝুঁকির স্থানান্তর। এর মাধ্যমে ব্যক্তি বা বীমা প্রতিষ্ঠান অর্থের (প্রিমিয়ামের) বিনিময়ে মক্কেলের আংশিক বা সমস্ত সম্ভাব্য ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে। এটি অনিশ্চিত ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি অংশ।
বিমা আইন ২০১০ অনুসারে, পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের কাছে সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে বিমা দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে। গত ১২ অক্টোবর এক বৈঠকে দেশের বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিসেম্বরের মধ্যে সব বিমা দাবি নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছে আইডিআরএ। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও সানলাইফ ইনসিওরেন্সকে তাদের জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে।
যে ২৯ বিমা প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। প্রতিষ্ঠানটির বিমা দাবি নিষ্পত্তির হার মাত্র ১ শতাংশ। আইডিআরএর তথ্য অনুসারে, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিমা দাবি নিষ্পত্তির হার ৫ শতাংশ, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ৬ শতাংশ ও গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১৪ শতাংশ।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সের অমীমাংসিত বিমা দাবির পরিমাণ ২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। বিমা দাবির বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি গত ৪ বছরে ১৩৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।
আইডিআরএর এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বিমা প্রতিষ্ঠান থেকে ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে এবং ৪৩২ কোটি টাকার হিসাব অনিয়মও ধরা পড়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়। বর্তমানে স্বতন্ত্র পরিচালকদের নিয়ে গঠিত পরিচালনা পর্ষদ ফারইস্ট ইসলামী লাইফ পরিচালনা করছে।
এ দিকে, গত ৪ বছরে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্সুরেন্সের অমীমাংসিত বিমা দাবির পরিমাণ ১৪০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। একই সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি সাত কোটি ২৭ লাখ টাকার বিমা দাবি পরিশোধ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রাহকদের বিমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তি করা না হলে তা এই খাত সম্পর্কেই মানুষের কাছে খারাপ বার্তা দেবে।
বাংলাদেশের অনেক মানুষের ধারণা, বিমা মানেই পিছিয়ে পড়া এক খাত, যেখানে কালো টাকায় গড়ে তোলা কোম্পানিগুলো টাকা সাদা করার আড়ালে সব সময় সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করে। কিন্তু মূলধন সৃষ্টি, সামাজিক সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান, বৃদ্ধ বয়স ও আপৎকালের সম্বল, মানসিক প্রশান্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থের যোগান সৃষ্টি এবং রাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি হ্রাসে বীমার প্রয়োজনীয়তা ও ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। মানুষের স্বাস্থ্য, যানবাহন, ভ্রমণ, সম্পত্তিসহ নানা ক্ষেত্রে ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দিতে বীমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বর্তমানে সক্রিয় ৮১টি বিমা কোম্পানি। এসব কোম্পানির বিমার আওতায় আছে ২ কোটির কম মানুষ। অথচ দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। অর্থাৎ, মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশের মতো মানুষ বিমার আওতায়। আর ৫০ লাখ মোটরচালিত যানবাহনের মধ্যে বিমার আওতায় আছে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার ৬২৬টি (২০২২)।
গত সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান মাত্র ০.৪ শতাংশ। অন্যদিকে, বিশ্বের ১ নম্বর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে ৯২.১ শতাংশ বা ৩০ কোটি ৪০ লাখ মানুষ জীবন বীমা (স্বাস্থ্য বীমার) আওতায় ছিল, যা ২০২৩ সালের প্রথম ৬ মাসে দাঁড়ায় ৯২.৩ শতাংশে। দেশটিতে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৬ কোটি ৯০ লাখ গাড়ি বিমার আওতায় ছিল। দেশটিতে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় এবং আর্থিক মূল্যমান সৃষ্টি করে এমন যে কোনো জিনিসই বিমার আওতায় নেওয়া অনেকটা বাধ্যতামূলক। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিবেশীসহ প্রায় সমঅর্থনীতির দেশগুলোতে বিমা খাতের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ৮০টি বিমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ভারতে আছে ৫৮, নেপালে ৩৪, ভিয়েতনামে ৫৩, পাকিস্তানে ৫৪, শ্রীলঙ্কায় ২৭, থাইল্যান্ডে ৭৪ এবং নাইজিরিয়ায় ৫৭টি। এসব দেশের জিডিপিতে বিমার অবদানও অনেক বেশি।
২০২২-২৩ সময়কালে দেশের অর্থনৈতিক সংকটে ব্যাংকিং খাতে বড় তারল্যের জোগান দিয়েছে বিমা কোম্পানিগুলোই। লাইফ ও নন-লাইফ বিমা কোম্পানির অর্জিত প্রিমিয়ামের ওপর একই বছরে সরকার ১ হাজার ৩০৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ভ্যাট ও ট্যাক্সও পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা শুধু বিমা খাত নয়, পুরো আর্থিক খাতের জন্যই সমস্যা।
ঋণখেলাপিতে জেরবার ব্যাংক খাত। রিজার্ভ কমতে কমতে তলানিতে ঠেকছে। গত কয়েক বছরে দেশ থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ও বাজার সিন্ডিকেটে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবনের নিরাপত্তার টাকা জিম্মি হয়ে আছে বিমা কোম্পানি গুলোর হাতে। অনতিবিলম্বে এসব সংকটের সমাধান চান ভুক্তভোগী মানুষ।