সাহিত্য ও লেখকের দায়
Posted: 19 নভেম্বর, 2023
মানুষের চিন্তা, চেতনা, আবেগ, অনুভব ও কৌতুহলকে যা স্পর্শ করে তার সবই সাহিত্যের অনুষঙ্গ। এসব অনুষঙ্গ যেমন সাহিত্যের উপজীব্য, তেমনি এসবকে জাগিয়ে তোলা বা এসবের বিস্তৃতিও সাহিত্যের কাজ। এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন লেখক। এজন্য একজন লেখকের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা ও সময় চাই।
একজন সাহিত্যিকের কাজ শুধু সাহিত্য সৃষ্টি নয়। তার উপর সামাজিক দায়ও বিশাল। এই দায়-দায়িত্বের প্রসঙ্গ আসলে প্রশ্ন জাগে একজন লেখক আসলে কেন লিখবেন? কার জন্য লিখবেন? কোন দায়বদ্ধতা থেকে লিখবেন? আমরা বুঝি লেখক যেহেতু সামাজিক জীব এবং মননশীলতার মধ্যে তার বিচরণ, তাই সামাজিক দায় তার অন্যান্যদের চেয়ে আলাদা। যে কারণে সে সময়কে মাথায় ধরেই লিখতে বসেন।
একজন লেখক মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন। তিনি মুক্তমনা। তার মানেটা কি দাঁড়ায়? দাঁড়ায় তিনি মানুষের বুদ্ধির মুক্তির জন্য লেখা লেখি করেন। যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠার জন্য লেখালেখি করেন, বিজ্ঞানমনস্কতার জন্য লেখালেখি করেন। সমাজ যদি শোষণ বঞ্চনামুক্ত না হয় তাহলে একজন লেখকও মুক্তির স্বাদ বঞ্চিত হন। লেখকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে জাঁ পল সার্ত্রে বলেছেন, ‘লেখকের স্বাধীনতা বোঝা যায় নাগরিকদের স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে। কেউ তো ভৃত্যদের জন্য লেখেন না। গদ্য শিল্পটা একটি শাসনব্যবস্থার সাথেই খাপ খাওয়াতে পারে গণতন্ত্র যেখানে ‘গদ্য’ অর্থ বহন করে। যখন কেউ হুমকিপ্রাপ্ত, তখন অন্যকেও সেটা দেয়া হয়। আর কলম দিয়ে এসবের দমন করতে যাওয়া যথেষ্ট নয়। এমন এক দিন আসবে যখন কলমকে বলপ্রয়োগ করে থামিয়ে দেয়া হবে, তখন লেখককে অবশ্যই অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে। এভাবে হয় তো আপনাকে একটা জায়গায় পৌঁছুতে হয়, যে মতই আপনি দেন না কেন, সাহিত্য আপনাকে একটা যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দেবে। লেখালেখি হলো স্বাধীনতা চাওয়ার একটি পন্থা; একবার আপনি লেখালেখি শুরু করেছেন তো বাধ্যতামূলকভাবে তা চালিয়ে যেতে হবে, আপনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে পড়বেন।’
আমরা এমন একটি সমাজে এসে পৌঁছেছি পুঁজির অসম বিকাশের মধ্য দিয়ে কতিপয় মানুষ ধনী হয়ে উঠছে। সমাজের সার্বিক নিরাপত্তা বিপন্ন। সমাজে শ্রেণির ভেতরে দূরত্ব বাড়ছে। বৈষম্য-বঞ্চনা ভয়াবহ আঁকার নিয়েছে। এ সময় বুদ্ধিজীবীরা সবাই সরকারের চারদিকে ঘিরে তার গুণগানে ব্যস্ত। বুদ্ধিজীবী বলতে যে শ্রেণি তারা মধুপানে ব্যস্ত। সংবাদপত্রের অবস্থা তথৈবচ। এসময় লেখক-শিল্পী ছাড়া অচলায়তনের বিরুদ্ধে কে দাঁড়াবে? টমাস পেইন ছিলেন আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণাদাতা লেখক, দার্শনিক। এমন বলা হয়ে থাকে, ওয়াশিংটনের তরবারি ব্যর্থ হতে বাধ্য হতো, যদি না টমাস পেইনের লেখনী সেখানে শক্তি জোগাত। তেমনি ফরাসি বিপ্লবের মন্ত্রণাদাতা ছিলেন দার্শনিক ভলতেয়ার, রুশো, মন্টেনকু । আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পীদের অবদান অনস্বীকার্য।
জগতে সবকিছুই গতিশীল। পরিবর্তনশীল। গতি ও পরিবর্তনই একমাত্র সত্য। মানুষের জীবন, সাহিত্য-সংস্কৃতির গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদই প্রথম লিখিত সাহিত্য হিসেবে আমাদের সামনে আসে। চর্যাপদ বাঙালির প্রাচীন যুগের সাহিত্য চর্চার নিদর্শন। তখন থেকে ছন্দবদ্ধ বাক্য অন্তমিলযুক্ত চরণ যূথবদ্ধ করে সৃষ্টি করা হতো কাব্যময় আবেদন। বাংলা সাহিত্যে গদ্যের প্রচলন যখন শুরু হয়নি তখন মানুষের জীবনযাপনের কথা, মনের কথা, ভালোবাসা বা প্রেমের উপাখ্যান, আধ্যাত্মিক বিষয় সবকিছুই রচিত হতো ছন্দবদ্ধ পদ্যে। মধ্যযুগে সৃষ্ট যত সাহিত্য রচিত হয়েছে তার সবই ছিল ছন্দে আবৃত। রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য এবং পরবর্তীতে বিষাদসিন্ধু, পদ্মাবতীসহ সকল কাহিনীই ছন্দভিত্তিক কাব্যে রচিত। পরবর্তী সাহিত্যে অবশ্য জীবনের গল্প অনেক বেশি করে লিখিত হতে থাকে। মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র রায় গুনাকর যখন লিখলেন- আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। এই একটি লাইনেই কবি সে সময়কালের মানুষের প্রত্যাশাকে কাব্যময় করে তুললেন। আধুনিককালে কুসুম কুমারী দেবী লিখলেন- আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। সাথে সাথেই একটা সমাজের প্রয়োজন আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। সারাজীবন অনেক অনেক কবিতা বা গান বা সাহিত্য রচনা করেও সকলে কবি বা সাহিত্যিক বা শিল্পীর মর্যাদা লাভ করতে পারেন না। কবি গাছ-লতা-ফুল-পাখি-মানুষ ও প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করেন এবং মনের মাধুরী মিশিয়ে শৈল্পিকভাবে তা তুলে ধরেন। সমাজের মধ্যে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা, অসংগতি শিল্পসম্মতভাবে যিনি স্পষ্ট উচ্চারণে তুলে আনেন, তিনিই হয়ে ওঠেন মানুষের কবি, সমাজের কবি, প্রতিবাদের কবি, ভালোবাসার লেখক, মানবতার সাহিত্যিক। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কবিতা লেখার জন্য জেল পর্যন্ত খাটতে হয়েছে। তাঁর অনেক বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তিনি শিল্পের জন্য শিল্প সৃষ্টি করেননি, সমাজের অসংগতিকে তুলে ধরেছেন শৈল্পিকভাবে। সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেই তাঁর কলম কখনো থামেনি।
এক সময় কবিতা সৃষ্টি করতে কবিকে ছন্দ-অলংকার-অন্তমিল-পর্বমিল-রূপক-উপমা-তুলনার সম্মিলন ঘটাতে হতো। এরপর এলো গদ্য কবিতার যুগ। কবি সুকান্ত গদ্য কবিতার মধ্য দিয়ে সমাজের যে চিত্র এঁকেছেন তা আজও খেটে- খাওয়া বঞ্চিত সাধারণ মানুষের প্রাণের কথা। তিনি লিখলেন- আমি যেন সেই বাতিওয়ালা/ যে রাজ পথে পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য, নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার অথবা শোন রে মালিক, শোন রে মজুদদার! তোদের প্রাসাদে জমা হলো কত মৃত মানুষের হাড়- হিসাব কি দিবি তার? সুকান্তের এসব কবিতা নিছক কোনো স্লোগান নয়। এগুলো মানুষের আকাঙ্ক্ষার শিল্পময় প্রতিফলন। সোমেন চন্দের ইঁদুর বা দাঙ্গা গল্প পড়লে সামাজিক চিত্র ও সমাজের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমনকি সত্যেন সেনের গান, উপন্যাস, রণেশ দাশগুপ্তের লেখার মধ্যে প্রকাশ হয় লেখকের দায় কি?
কবি জীবনানন্দ দেখালেন কত সাবলীল ও শক্তিশালী হতে পারে গদ্য কবিতা। তিনি লিখলেন- হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি/ পৃথিবীর পথে/ সিংহল সমুদ্র থেকে নিশিথের অন্ধকারে মালয় সাগরে... চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন/ আমারে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
কবিতার ক্ষেত্রে সংখ্যাগতভাবে নয়, জীবনঘনিষ্ঠ শিল্পসম্মত কবিতাই কবিকে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখে। ব্রিটিশ সরকার যখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে আটক করেন তখন নজরুল লিখলেন ‘কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট... লাথি মার ভাঙরে তালা/ যত সব বন্দী-শালায়-আগুন জ্বালা/ আগুন জ্বালা/ ফেল উপাড়ি। শামসুর রাহমান স্বাধীনতার পর লিখলেন- স্বাধীনতা তুমি এবং বাতাসে লাশের গন্ধ কবিতা। শুধু এই দু’টো কবিতাই শামসুর রাহমানকে অমর করে রাখার জন্য যথেষ্ট। এদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জোগাতে অনেক কবিতাই গান হিসেবে গাওয়া হতো ।
সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এরশাদ স্বৈশাসনের বিরুদ্ধে কবি মোহাম্মদ রফিকের সাহসী উচ্চারণ ছিলো ‘সব শালা কবি হবে/ পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই/ দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই।’ কবি নবারুণ ভট্টাচার্য লিখলেন ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না- কী শাণিত উচ্চারণ। কবি রফিক আজাদ বললেন- আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ, ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো। কবি রফিকের এ স্পষ্ট উচ্চারণ হয়ে ওঠে সময়ের স্পর্ধিত কাব্য। কিন্তু বর্তমান সময়ের বড় একটি অংশ লেখক/ কবির কলম যেন কিছুটা নড়বড়ে আর তৈলাক্ত এবং অনেক সময় তা হয়ে ওঠে অ-কবিতা, অশিল্প। সেখানে তুমি-আমি আর তেলের মিশ্রণে এমন সব চাটুকারি চটকদার উচ্চারণে কবিতার জন্ম হয় যা সময়ের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হয়। তাইতো লেখকের জনসমাদরে এখন ভাটার যুগ চলছে। তবুও নতুন প্রজন্মকে জাগিয়ে তোলার জন্য সাহিত্যের মতো শক্তিশালী আর কী আছে!
অনেকেই বলে থাকেন এ সময়ে জীবনঘনিষ্ঠ লেখা জীবন বাস্তবতাকে তুলে আনা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। নিজের জীবন বিপন্ন করে কে মানবিক লেখা তৈরীর সাহস দেখাবে? এ সব বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না। এদেশ আজ এমন এক সময় অতিবাহিত করছে যখন দেশে ন্যূনতম সমালোচনা করার মতো পরিবেশ নেই। কথায় কথায় নিবর্তনমূলক আইন দিয়ে লেখক কবিসহ মুক্তচিন্তার মানুষের গলা টিপে ধরা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ দিশেহারা। ক্ষমতাসীনেরা মানুষের ভোট ও কথা বলার অধিকার সম্পূর্ণভাবে কেড়ে নিয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক লেখক মুশতাক আহমেদ বিনা বিচারে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই আইনে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ শত শত মুক্তমনের মানুষ ভোগ করছেন অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পার হলেও স্বাধীনতা আজও অর্থবহ হয়নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার সমাধান হয়নি। এখনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নেই, সরকারি কর্মচারীরা ঘুষ- দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমগ্ন হয়ে পড়েছে। একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি মিল কারখানা আধুনিকায়নের অর্থ জোগান না দিয়ে লোকসান দেখিয়ে তা বন্ধ ঘোষণা করছে। প্রাণ-প্রকৃতি- ধ্বংস করা হচ্ছে। এমনি সংকটময় মুহূর্তে লেখকের লেখায় মানুষের যাপিত জীবনের ব্যথা-বেদনা-স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা ও দ্রোহের কথাস্পর্ধিত কাব্যময় হয়ে উঠুক, মানুষ এটাই প্রত্যাশা করে। লেখক-সাহিত্যিকরা যদি প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হন, তবে ইতিহাসে তা দুঃসময় বলেই লেখা থাকবে।