অপরিকল্পিত শিক্ষাক্রম
ভালো হলেও মন্দ
Posted: 19 নভেম্বর, 2023
দেশের বর্তমান শিক্ষাক্রম নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। কেউ প্রশংসা করছেন তো কেউবা চরম সমালোচনা। শিক্ষক ও অবিভাবকদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। চলতি বছর চালু হওয়া শিক্ষাক্রমের নিয়মনীতি নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বোচ্চ মানসম্মত শিখনের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্য। বিষয়টি মাথায় রেখে চলতি বছর দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। এটিকে বলা হচ্ছে ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ শিক্ষাক্রম। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণিতে নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। তবে এটি বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই পর্যাপ্ত শিক্ষক যেমন দরকার, তেমনই শিক্ষকদের দক্ষতাও দরকার।
২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরে ফলভিত্তিক শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে যোগ্যতাভিত্তিক নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। এতে পড়ানোর ধরন, মূল্যায়ন ও পাঠ্যবইয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। শিক্ষাবিদদের অনেকেই নতুন শিক্ষাক্রমকে ভালো বলছেন। আগামী বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। এরপর চালু হবে উচ্চমাধ্যমিকে।
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথাগত পরীক্ষা কমে যাচ্ছে, জিপিএ’র পরিবর্তে ফলাফল হবে তিন স্তরে। আগামী বছর থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে অভিন্ন বিষয় পড়ানো হবে। বিভাগ বিভাজন হবে উচ্চমাধ্যমিকে। এতদিন একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক নাকি ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়বে, সেটি ঠিক হতো নবম শ্রেণিতে।
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তখন শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বোর্ডের অধীনে দুটি পরীক্ষা হবে। আর নতুন শিক্ষাক্রমে প্রায় সব শ্রেণিতেই বড় অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীনের ভিত্তিতে। এজন্য শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের রেকর্ড সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নতুন এই শিক্ষাক্রম চালুর আগে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা, বাস্তবায়নের বাস্তব অবস্থা যাচাই ও চাহিদা নিরূপণ সমীক্ষা করেছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ২০১৯ সালের ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম চালু আছে, বিশ্বের এমন বেশকিছু দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর তুলনামূলক চিত্রসহ বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা ১১টি দেশের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বাংলাদেশে বেশি। ওই সমীক্ষা প্রতিবেদন করার সময় দেশে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম চালু হয়নি। তখন মাধ্যমিক স্তরে গড়ে ৪২ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক ছিলেন।
নতুন শিক্ষাক্রম চালুর পর দেখা যাচ্ছে, মাধ্যমিকে এখন গড়ে ৩৮ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন। তবে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এই অনুপাত আরও বেশি। সেখানে গড়ে ৫২ শিক্ষার্থীকে পড়ান একজন শিক্ষক। শুধু তা-ই নয়, কোনো কোনো বিদ্যালয়ে একেকটি শ্রেণিকক্ষে ৬০ থেকে ৭০ শিক্ষার্থী নিয়েও শিক্ষকদের ক্লাস করতে হয়।
অথচ ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মধ্যে মাধ্যমিকে গড়ে প্রতি ৩০ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষকের ব্যবস্থা করার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। প্রাথমিকেও গড়ে ৩৮ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন। প্রাথমিকে এখনো শিক্ষকের ৩৮ হাজার পদ শূন্য।
এনসিটিবি সমীক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যে চিত্র তুলে ধরেছে, তাতে দেখা যায়, যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম থাকা সিঙ্গাপুরে গড়ে ১২ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন। মালয়েশিয়ায়ও একই চিত্র। থাইল্যান্ডে গড়ে ২৪ শিক্ষার্থীর জন্য একজন, ইন্দোনেশিয়ায় ১৫ শিক্ষার্থীর জন্য একজন, কম্বোডিয়ায় ২৯ শিক্ষার্থীর জন্য একজন, অস্ট্রেলিয়ায় ৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন, ফিনল্যান্ডে গড়ে ১৩ শিক্ষার্থীর জন্য একজন এবং ডেনমার্কে ১১ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন।
অন্যদিকে ভারতে গড়ে ২৮ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন (ভারতে প্রবেশভেদে শিখন ফলভিত্তিক ও যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম চালু আছে)। অবশ্য সমীক্ষা প্রতিবেদনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের তথ্যগুলো কয়েক বছর আগের। হালনাগাদ তথ্য কিছুটা হেরফের হতে পারে।
যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনায় নিয়ে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ কম শিক্ষার্থীকেই শিখিয়ে ওপরের ক্লাসে পাঠানোর কথা। কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাতে এত ফারাক রেখে এটি বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সমন্বয় ঘাটতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে ধোঁয়াশা এবং প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব দেখছেন অনেক শিক্ষক। এ বছর চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে উপকরণ বেশি লাগছে। এতে খরচও বেশি হবে। তবে পর্যাপ্ত উপকরণের ঘাটতি আছে।
এদিকে অবিভাবকদের অনেকেই এই শিখন পদ্ধতি মানতে পারছেন না। অনেকের অভিযোগ, তাদের সন্তানদের স্কুলে নিয়ে গিয়ে রান্না-বান্না থেকে ঘর গৃহস্থালির কাজ করানো হয়, খেলাধুলা করানো হয়, গান-বাজনা করানো হয়। এসব তারা চান না। তারা চান তাদের সন্তান বিদ্যালয়ে গিয়ে শুধুই পড়াশোনা করুক। যদিও অনেকেই বর্তমান শিখন পদ্ধতির প্রশংসা করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই জাপানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ছবি পোস্ট করে বর্তমান শিক্ষাক্রমকে সমর্থন জানিয়েছেন। সেসব ছবিতে দেখা যায়, কেউ ধান চাষ করছে, কেউ মেশিন চালাচ্ছে, কেউ যন্ত্রপাতি বানানোর চেষ্টা করছে, কেউবা খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত।
দেশের তরুণ-যুবাদের একটা বড় অংশ বর্তমান শিক্ষাক্রমকে সমর্থন করছেন। যদিও তারা শিক্ষক ঘাটতি ও উপকরণের অভাব পূরণের আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে অনেকেই বেকার তৈরির উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন। একের পর এক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, নামসর্বস্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক বিবেচনায় জাতীয়করণ, গণহারে পাস করানো, পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়েই নতুন নতুন নিয়ম প্রচলন ও কর্মবিমুখ শিক্ষাই শিক্ষিত বেকার তৈরির কারণ বলে প্রতীয়মান হয়।
শুধুমাত্র মুখস্তবিদ্যা পরিহার করে কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। সারাবিশ্ব যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করছে, শিক্ষাখাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে তখন আমরা পড়ে আছি মান্ধাতা আমলের শিখন পদ্ধতি ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের সাথে সাথে বাড়ছে ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম ও মাদ্রাসা শিক্ষার মাঝে ভেদাভেদ। বৈষম্যহীন, একমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাই পারে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে। কেননা, প্রয়োজন মাফিক ও গতিশীল শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।
লেখক : শব্দ শ্রমিক