একতরফা প্রহসনের নির্বাচনের পথে দেশ!

Posted: 19 নভেম্বর, 2023

গণদাবি ও জনমত উপেক্ষা করে এবং রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে দেশ একতরফা প্রহসনের নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। ‘স্বাধীন ও সাংবিধানিক’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন সম্পন্ন করা এবং এই লক্ষ্যে তারিখ ঘোষণা করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সহজে দেখলে মনে হবে নির্বাচন কমিশন এই দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিয়ে নানা তারিখ দেওয়া, নির্বাচন কমিশনের অস্থিরতার মধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলো। সংলাপের আলোচনা আবার নতুন করে যখন এলো, তখন অনেকেই মনে করছেন, তফসিল ঘোষণা হয়তো বিলম্ব হবে, তখনই এই তারিখ ঘোষিত হলো। কিন্তু দেশের মানুষ মনে করে সরকার চেয়েছে বলে, দ্রুততার সাথে এই সময় নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছে। কোনো উৎসবমুখর পরিবেশে এই তফসিল ঘোষণা হয়নি। অতীতের সব রেকর্ডকে ম্লান করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক স্তরের কড়া পাহারা, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কঠোর নজরদারির মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই তফসিল ঘোষণা করেছেন। অতীতে এমনটা দেখা যায়নি। এসময়ে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ যে তৈরি হয়নি, তা নির্বাচন কমিশনও বুঝেছে। নির্বাচন নিয়ে দেশে সংঘাত-সংকটময় পরিবেশ চলছে। প্রাণহানি ঘটছে। হয়তো এসব পরিস্থিতি বিবেচনা করে তফসিল ঘোষণার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার সংঘাত পরিহার করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসম্ভব নয়।” নির্বাচনের সময়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কথা অনেক বেশি সামনে আসে। নিবন্ধিত অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সারা দেশে উল্লাস প্রকাশ, মিছিল করেছে। একই সাথে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংলাপকে নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, “সংলাপের সময় শেষ হয়ে গেছে।” দেশে প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থা অনেকদিন ধরে অকার্যকর হয়ে গেছে। ক্ষমতা নিশ্চিত করতে একতরফা নির্বাচনের নানা ধারা সামনে চলে এসেছে। ৯০’র দশকে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জন করা ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’-এটা অনেক দিন ধরে নির্বাসনে গেছে। নতুন প্রজন্মের ব্যাপক জনগোষ্ঠী ভোট দেয়ার ও ভোট ব্যবস্থা দেখতে পারে না, ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচনকে ‘কালো টাকা-টাকার খেলা, পেশি শক্তি, সাম্প্রদায়িক প্রচার প্রচারণা ও প্রশাসনিক কারসাজির’ হাত থেকে মুক্ত করার সংগ্রাম অনেক দিনের। এখন প্রশাসনিক কারসাজির নানা রূপ এমনভাবে ছাপিয়ে গেছে যে, ভালো ভোটের জন্য অন্যান্য সংকট আলোচনায় আসছে না। এমনকি নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সমাধান হচ্ছে না। এটি না হওয়ায় দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না, গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও দেশবাসী দেখছে না। নির্বাচনের সময় কাছাকাছি চলে আসায় আন্দোলনে তাই পুুরো নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের আলোচনা ছাপিয়ে নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের আলোচনাই প্রধান হয়ে উঠেছে। নির্বাচন কমিশনের প্রধানসহ অন্যরাও নানা সময় বলেছেন, নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়ে উঠেনি। শেষে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতা ও নির্বাচনকালীন সরকার তাদের দায়িত্ব নয়- একথা বলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে তাদের ভূমিকা পালন করা থেকে তারা পিছিয়ে এসেছেন। এমনকি বলেছেন ১ শতাংশ ভোট পড়লেও আইনি সমস্যা নেই। সচেতন মহলের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছিল, নির্বাচন কমিশনকে সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চিত করতে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে তারপর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ছিল সরকারের সাথে কথা বলে, সরকারকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তদারকি সরকার গঠন করতে বলা, এবং এটি না হলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব নয়, তা-ও পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এই উদ্যোগ না নিয়ে সরকার যে একতরফা নির্বাচনের ডিজাইন তৈরি করেছে, তারই পরিকল্পনার সহযোগী হলো। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এটা স্পষ্ট করে তুলেছে যে, সরকার একতরফা নির্বাচন করে বিজয়ী হতে চায়। এজন্য নির্বাচনী রাজনীতির প্রধান পক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক তা চায় না সরকারি দল। অন্যদিকে ভোটের বিবেচনায় বিরোধী পক্ষ তাদের বিজয় নিশ্চিত করতে নির্বাচনী পরিবেশ চায়। দেশের এই সংকটের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় নিজেদের স্বার্থে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যান্য আধিপত্যবাদী বিদেশি শক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নানা তৎপরতা, হুমকি-ধামকি বাড়িয়ে চলেছে। স্বাধীন সার্বভৌম দেশে যা কাক্সিক্ষত ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া সরকার বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন, গ্রেফতার, নির্যাতন, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা হরণ এমন পর্যায় নিয়ে গেছে যে, স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অনেক সাধারণ মানুষ পর্যন্ত আজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাধ্যমে সমাধান প্রত্যাশা করছে। এই সুযোগে এসব শক্তি নানা অশুভ তৎপরতা চালাচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে, স্ব স্ব দেশের স্বার্থে স্ব স্ব অর্থনৈতিক, সামরিক জোটে বাংলাদেশকে আবদ্ধ করা বা আবদ্ধ হওয়া থেকে বিরত রাখতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। দেশের সম্পদের ওপর, সামরিক শক্তির ওপর আধিপত্য বিস্তারে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। দেশের এই সংকটময় সময়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের শক্তি সামর্থ্য তুলে ধরে সামনে আসছে। ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারা নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের তাবেদারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। কিংস পার্টি বা নতুন নতুন পার্টির আবির্ভাব দেখা যাচ্ছে। এরা মাঝেমধ্যে জনমত বিবেচনা করে সরকারবিরোধী কথাবার্তা বললেও প্রকারান্তরে ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারের একতরফা নির্বাচনের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। সরকার নানা কৌশল, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে ভোটকেন্দ্রে মানুষের উপস্থিতি দেখাতে চাইবে। এটা সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে। এসময় দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। বাজার পরিস্থিতি, সরকারের রিজার্ভ সংকট, পুরো পরিস্থিতিকে আরো সংকটের দিকে ধাবিত করবে বলে অর্থনীতিবিদরাও বলছেন। মানুষ তার জীবনের অভিজ্ঞতায় এটা বুঝতে পারছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কথাতেও সংকট দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। অর্থনৈতিক সংকটের কথা অস্বীকার করে আসা সরকারের পক্ষ থেকে রিজার্ভ বাড়াতে বিদেশের কাছে ডলার ধার চাওয়ার কথাও স্বীকার করা হচ্ছে। চলমান রাজনৈতিক সংকট দূর করতে অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ভোট নিশ্চিত না করতে পারলে, একতরফা নির্বাচন সম্পন্ন হলে সংকট আরো তীব্রতর হবে। তাতে চলমান দুঃশাসনও হবে দীর্ঘায়িত। এসময় সংঘাত-সংঘর্ষ বৃদ্ধির আলামত দেখা যাচ্ছে। হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও এবং বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস চোখে পড়ছে। এসব ঘটনায় অশুভ অগণতান্ত্রিক শক্তি নানা সুযোগ নিতে পারে। যা দেশকে আরো অগণতান্ত্রিক শাসনে ফেলার ঝুঁকির দিকে নিয়ে যাবে। এ অবস্থায় দেশে নানা হস্তক্ষেপ সম্পর্কে সজাগ থেকে দলীয় সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচনের তফসিল পরিবর্তন করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচনের জন্য পুনঃতফসিল ঘোষণার সংগ্রাম বেগবান করা প্রয়োজন। একই সাথে সরকারের একতরফা নির্বাচনের ফাঁদে পা না দিয়ে দুঃশাসন হটানো ও ব্যবস্থা বদলের সংগ্রাম গড়ে তুলতে জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এরপরও প্রহসনের ভোট সংগঠিত করার প্রচেষ্টা হলে ঐ নির্বাচন বর্জন করতে দৃঢ়ভাবে জনমত সংগঠিত করতে লাগাতার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।