পিতৃতান্ত্রিক মনস্তত্ত্বের প্রভাব নারীর জীবন ও
মনোজগতে প্রবলভাবে বহমান
Posted: 16 এপ্রিল, 2023
মনুষ্য প্রজাতির পরাজিত লিঙ্গের নাম নারী। নারীতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটে পিতৃ বা পুরুষতন্ত্রের বিজয়ী অভ্যুত্থানে। নারীর পরাজয়ের তত্ত্ব রচনা করেছেন অনেক দার্শনিক। তবে এঙ্গেলস এর তত্ত্বটিই সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক। যার নাম পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি (১৯৮৪)। তিনি দেখিয়েছেন যে, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ও সম্পত্তির মধ্যে, সম্পত্তির মালিকানা ও নারী অধীনতার ভিত্তির ওপরই স্থাপিত পিতৃতন্ত্র। তাই পিতৃতন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে শোষণের ওপর। মানুষের একটি লিঙ্গ শোষণ করছে আরেকটি লিঙ্গকে। নারী শোষণের মহত্তম যন্ত্রটির নাম পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র। পিতৃতন্ত্র কেবলমাত্র নর-নারীর বাইরের জগতটাকেই নিয়ন্ত্রণ করেনি, নিয়ন্ত্রণ করেছে তাদের মনোজগত অর্থাৎ মনের প্রকৃত অবস্থাকেও। মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটির নাম তার মনোজগত। মনোজগত ঠিক করে দেয় জীবন চলার প্রকৃতি ও ছন্দ। যেহেতু হাজার বছর ধরে পিতৃতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব নির্মমভাবে সমাজ সংসারকে গ্রাস করে রেখেছে, তাই নারী-পুরুষের জীবন ও মনোজগতে এর প্রভাব অনেক গভীর ও সর্বক্ষণের। ফলে এই মনস্তত্ত্বের ভাবাদর্শ নর-নারী মনের ভেতরে গেঁথে নিয়েছে প্রবলভাবেই। পিতৃতান্ত্রিক ভাবাদর্শ শুরু থেকেই নারীসত্তাকে স্বীকার করেনি এবং ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারের অতল গর্তভরে, নারীকে অবরুদ্ধতা, সেবা দাসত্ব ও যৌন দাসত্বের শেকলে বন্দি করে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। পণ্যসামগ্রীর পরিচিতিতে ঠাঁই করে দিয়েছে নারীকে। নারী গোষ্ঠীকে নিঃস্ব এবং অধিকারে সর্বশান্ত করে সর্বহারা শ্রেণিতে ঠেলে দিয়েছে। এই মনস্তত্ত্বে নারী ব্যক্তি নয়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের বস্তুতে পরিণতি পেয়েছে। অন্যদিকে পুরুষকে দিয়েছে আকাশ ছোঁয়া অধিকার। সৌর্ঘে-বীর্ঘে মহা-পরাক্রমশালী পুরুষ। দাপটে ও প্রতাপে ধরিত্রী কাঁপানো। পুরুষতন্ত্রের নিয়মনীতিতে বানানো পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র নামক সংগঠন গুলোর পুরুষতত্ত্বের প্রভাবে নারীর মনজগত ও জীবন হয়ে উঠেছে সংকুচিত, মর্যাদাহীন, অসহায় এক পরজীবী শ্রেণির। দীর্ঘকাল চাপিয়ে দেয়া এক মনস্তাত্ত্বিক জগতের বাসিন্দা হওয়ায় নারীর নিজস্ব মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠার কোন সুযোগই হয় নি।
এই পুরুষতান্ত্রিক বিবাহ রীতি ও পুরুষের আর্থিক প্রভুত্ব নারীর মনোজগত ও জীবনকে মারাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিয়ের রীতিতে সকল ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে কনের পিতা-মাতাকে কন্যাদায়গ্রস্ত হিসেবে পরিচিতি নিয়ে বরপক্ষের নিকট নতজানু অবস্থায় দাঁড়াতে হয়। সামাজিক নিয়মে বরের সম্মান রক্ষার্থে এবং শ্বশুর বাড়িতে মেয়েকে ভাল রাখার জন্য যৌতুক নামক অনেক উপঢৌকল পাঠাতে হয় গরিব পিতামাতাকেও। এই মনস্তত্ত্ব জন্ম দিয়েছে যৌতুক প্রথা নামক সমাজে একটি কু-প্রথার। সেই আদি থেকে অদ্য পর্যন্ত এই কু-প্রথা যৌতুকের বলি হয়েছে অসংখ্য নারীর জীবন।
আরেকদিকে পুরুষের আর্থিক প্রভুত্ব অসহায় নারীর মনোজগতের নিয়ন্ত্রণ করে প্রবলভাবে। কারণ নারী আর্থিক শক্তিহীন, পুরুষ নির্ভর। পরিবারে নারীকে যৌনদাসী হয়ে উঠতে হয়। বাঁচতে হয় ভোগ্য পণ হয়ে। নারীর নিজের মন ও শরীর নিজের থাকে না। এমনকি তার কোন যৌন স্বাধীনতাও থাকে না এই তন্ত্রে। স্বাধীন সত্তা হারিয়ে নারী বিবেচিত হয় পিতৃতান্ত্রিক ধারক বাহক ব্যক্তি পুরুষের অস্থায়ী সম্পত্তি হিসেবে। নারী আত্মমর্যাদাহীন হয়ে অসম্মানের জীবনে আত্মহুতি দেয়। নারীর ওপর প্রতিপদক্ষেপ এত অভিভাবকত্ব করা হয় যে, ফলে নারী চির শিশুর মত মনোজগতের অবস্থানে আশ্রয় নেয়। নারীকে চিহ্নিত করা হয় অবলা নারী অর্থাৎ অসহায় নারীর স্থানে। পুরুষতন্ত্রের মনস্তাত্ত্বিক কু-প্রথাগুলো নারীকে বন্দি জীবনে নিক্ষেপ করেছে এবং বিনা বাক্যে নারীকে পশুর নিম্ন দশাটি মেনে নিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। নারীর অসহায়ত্বই পুরুষকে সর্ব ক্ষমতাধর হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। নারীকে সেবাদাসী হয়ে ঘরকণ্যার দায়িত্ব পালন সহ সন্তান জন্মদান, লালন-পালনের শৃঙ্খল আটকে থেকে তার সৃষ্টিশীল প্রতিভার বিলোপে ঘটেছে নিরবে। অথচ এই পুরুষ মনস্তত্ত্বে নারীর সেবা কর্মের কোন সামাজিক ও আর্থিক স্বীকৃতি মেলেনি অদ্যাবধি।
চলিত রীতিতে নারী তার জীবন ধারণ বা কোন উন্নতির জন্য নির্ভর করতে হয় পুরুষের ওপর। তাই এই তন্ত্র নারীকে পরগাছার অস্তিত্ব দিয়েছে। নারীর কোন ক্ষমতা নেই, পুরুষের রয়েছে অসীম ক্ষমতা। এই মনস্তত্বে নারীকে তুচ্ছ অচ্ছিল্যের মর্যাদা দেয়া হয়। পদে পদে পীড়নের ফলেন নারীর স্বভাবে দেখা দেয় সংখ্যালঘু দের বৈশিষ্ট্য। নারীর কোন মনবল, আত্মবিশ্বাস থাকে না। এমন কি সংখ্যাগুরুর অত্যাচারের ভয়ভীতিতে সর্বদা সংকিত থাকতে হয়। জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনিশ্চিয়তা বাসা বাঁধে। সমাজ নারীকে দেখে অশ্রদ্ধার চোখে, তাই তারাও নিজেদের দেখে ঐ একই দৃষ্টিভঙ্গিতে। নিজেদের কোন কৃতিত্বকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। এমনকি সমাজ-রাষ্ট্র নারীর কৃতিত্বের মর্যাদা দিতে চায় না। এর নিদর্শনে বর্তমান সময়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো- নিকট অতীতে আমাদের নারী ফুটবল দল সাফ শিরোপা জয়ের গৌরব বয়ে আনলেও এবারের অলিম্পিক গেমে এই নারী দলকে পাঠালো না রাষ্ট্র অর্থসংকটের অজুহাত দেখিয়ে। এই নারীদের অদম্য আকাংখার কোন মর্যাদাই পেল না ফুটবল ফেডারেশনের কাছে। নারী বলেই এই কৃতিত্বকে এত দ্রুত ভুলে গেল দেশ। অথচ এই দেশে ঘুস, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নে লক্ষ কোটি টাকা পাচাঁরের বড় বড় কাহিনীর উৎসব চলছে। এখানে রাষ্ট্রের টাকার অভাব হয় না। এ বিষয়টিতেও পুরুষতান্ত্রিক মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারী ফুটবলের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখানো হলো, দেশের পরীরাও মর্যাদা পেল না। ভবিষ্যতের উৎসাহ হাড়িয়ে গেল। ফিলিপ, গোল্ডবার্গ, ‘নারীরাকি নারীদের বিরুদ্ধে সংস্কারগ্রন্থ’ মর্মে একটি গবেষণায় দেখান যে- নারীরাও নারীদের সম্বন্ধে পোষে খুব নিম্ন ধারণা। এই সত্যের কারণে পরিবার গুলোতে নানা কলহ বিবাদে প্রতিদিনের পারিবারিক শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে।
পিতৃতন্ত্রে নারীরা নাগরিক অধিকার পায় না। একই সাথে সংখ্যাগুরু হয়েও মর্যদায় সংখ্যালঘুর ভূমিকায় থেকে তাদের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানসীকতা গড়ে ওঠে। তারা নিজেকে এবং নিজেদের শ্রেণিকেও অবজ্ঞা করে। কয়েক হাজার বছর ধরে নারীদের নিকৃষ্ট শ্রেণি হিসেবে প্রচার করে তাদের অপরাধকেও বাড়িয়ে দেখে সমাজ। তাই সামান্য অপরাধে তারা সমাজের কাঠগড়ায় ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে ওঠে।
মার্কিন গবেষকরা দেখিয়েছেন- কৃষ্ণকায়েরা ও নারীরা মানসিকতায় একই রকম্ তারা বুদ্ধিতে খাটো, তাদের স্বভাব আদীম ও আবেগপরায়ন তারা নিজেদের ভাগ্যে সন্তুষ্ট তাকে এবং নিজেদের সকল অনুভূতি লুকিয়ে রাখে। এই গবেষণাকেও আমরা পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিতেই বিচারে নিতে চাই- এখানেও নারীকে সর্ব বিষয়ে তুচ্ছ করে অসম্মান করে দেখা হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায়, পিতৃতন্ত্রের হীন মনস্তাত্ত্বিক ভাবাদর্শের আবহের মধ্যেই নারীকে বিচরণ করতে হচ্ছে এবং একবিংশ শতকের নারী প্রগতির বিষয়ে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়েই নারী নিজেকে অগ্রসর করার চেষ্টায় রত। শিক্ষা, স্বাবলম্বনে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং যুগ যুগের অধিকারহীনতা ও অধস্তনতাকে পরাস্ত করে নিজেকে শানিত করার প্রত্যয়ে বিশ্বের নারী সম্প্রদায় সচেতনতা বৃদ্ধির নিরলস লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বিশ্ব পরিসরের পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে তাদের শোষণ বৈষম্যের অবস্থানকে চিহ্নিত করে সম-অধিকারের লড়াইয়ের মঞ্চে নিজেদেরকে দৃশ্যমান ভূমিকায় দাঁড় করাচ্ছে। যুগ-যুগের পিতৃতান্ত্রিক মনস্তত্ত্বের নিগড়ে আবদ্ধ নারীর মনজগতের শৃঙ্খল ভাঙার লড়াই করছে নিজের মনোজগতে এবং রাস্তার মিছিলে সম্মিলিত আগ্রতে ও চেতনায়। তাইতো ২০২৩ সালের বিশ্ব নারী দিবসে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের নারীরা বিভিন্ন অধিকারের দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে রাজপথে। বিশ্বের প্রায় সব রাজধানীই নারী দিবসে কেঁপে ওঠে- অধিকার সচেতন নারীদের ক্ষুব্ধ স্লোগানে আর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে। এমন কি তালেবানি শাসনে দমনমূলক দেশ হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক আখ্যা পাওয়া দেশ আফগান নারীরাও বুকে অসীম সাহস ধারণ করে তাদের বর্তমান দমন ও পীড়নমূলক অবস্থার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে রাস্তায় আন্দোলন করেছে এবং বিশ্ব নারীদের তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে দীপ্ত কণ্ঠে।
আর এই আবহই প্রমাণ করছে যে, নারী প্রগতির বন্ধ দ্বার লড়াই-সংগ্রামের তীব্র আঘাতে ক্রমশ খুলে যাচ্ছে। নারী অধিকারের নব-অরুণোদয়ের উষালগ্নে আমরা পৌঁছে গেছি। বিশ্ব নারীর সম-অধিকারের সম্মিলিত শক্তির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে নারী বিশ্বে। সমস্ত পিতৃতান্ত্রিক মনস্তাত্ত্বিক একপেশে অবদমন ও বন্দীদশায় ভাবাদর্শের নিগড় ভেঙে সমস্ত নির্যাতন-নিপীড়ন-শোষণ-বৈষম্যের অবসান ঘটাবো আমরা নারীরা। মুক্তির মন্দির শোপান তলে’ দাঁড়িয়ে আমরা শপথে আজ বলীয়ান। আলোময় আগামী আমাদের মুক্তির হাতছানি দিচ্ছে। তাই আগামী আমাদের।