নারী যে শক্তি বলে তার ভবিষ্যৎ গড়বে

Posted: 22 জানুয়ারী, 2023

জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি, চিন্তা-চেতনায় মানবসভ্যতা প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলছে ঠিকই, কিন্তু এই প্রগতি কেবল পিতৃ ও পুরুষতন্ত্রের একটি চাকার ওপর ভর করেই টিকে আছে। বর্তমান প্রগতির পরিমাপ এটুকুই। অন্যদিকে অর্ধজনগোষ্ঠীর নারীকেন্দ্রিক চাকাটি ভঙুর বা ক্ষীণ গতিতে আটকে আছে। এতে মোটা দাগে এই বলা যায় যে, এই সভ্যতা বা প্রগতি খুড়িয়ে চলছে এটা অসম্পূর্ণ। পক্ষান্তরে নারীর স্থান নির্ধারিত হয়েছে পুরুষ ও পিতৃতন্ত্র কর্তৃক অর্থনীতির দখলদারিত্বের এক নির্মম শোষণ-বৈষমের কাঠামোর বন্দিদশায়। পুরুষতন্ত্র তার শক্তিধর অবস্থানকে পাকাপোক্ত করার নিমিত্তে নারীকে ঠকানোর কূটকৌশলগুলিকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে তাদের আদিম উদ্দেশ্য ও প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করেছে। আর নারীর আজীবনের নিয়তি হয়ে তাকে দলে-পিষে সেবাদাসী ও ভোগ্যপণ্যের সামগ্রী বানিয়ে দিয়েছে। তার দৃষ্টিতে নারীকে কেবল অন্ধকার-অবরুদ্ধতায় রেখেই সর্বত্র পুরুষ আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব। গড়ে তোলা হয়েছে পুরুষ আধিপত্য ও নারী অধীনতা। নারী উপহার পেয়েছে অবরুদ্ধতা-অধিকারহীনতা আর সকল প্রকার শোষণ-বৈষম্য-নির্যাতন-নিপীড়ন। মহীয়সী বেগম রোকেয়া নারীশিক্ষা সমিতির এক সভায় ১৯২৭ সালে নারীর অবস্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে সভানেত্রীর বক্তৃতায় বলেছিলেন- ‘ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট কাহারা জানেন? সে জীব ভারত নারী। এই জীবগুলির জন্য কখনো কখনো প্রাণ কাঁদে নাই। পশুর জন্য চিন্তা করিবারও লোক আছে, তাই যত্র তত্র পশু ক্লেশ নিবারণী সমিতি দেখিতে পাই। কিন্তু আমাদের ন্যায় অবরোধ বন্দিনী নারীজাতির জন্য কাঁদিবার একটি লোকও এ ভূ-ভারতে নাই।’ বিশ্বজুড়ে নারীর অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও আবার খারাপও হয়েছে অনেক দেশে। ইরান-পাকিস্তান-আফগানিস্তানসহ আরো কিছু মুসলিম রাষ্ট্রে দু’তিন দশক আগের চেয়ে অনেক শোচনীয় এমন নারীর অবস্থা। নারী ভোটদান, শিক্ষা ও পেশাসহ কিছু অধিকার পেলেও বিশ্ব অগ্রগতির অধিকারে তারা নিঃস্বই। পুরুষতন্ত্র নির্মিত কাঠামোয় গড়ে তোলা হয়েছে- পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র নামক যে সংগঠনগুলো তার প্রণীত কতিপয় বিষয়গুলো যেমন- বিয়ে, শিক্ষা, পেশা, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সবই নারী প্রগতিবিরোধী। রাজনীতিতে নারীর অবস্থান অতি নগন্য। ধর্মীও বিধিবিধান নারীর জন্য আরো ভয়ঙ্কর ও বিপদজনক মধ্যযুগীয় বটেই। অর্থনীতিতে পুরুষই সর্বময় ক্ষমতাধর এবং সংসারের প্রধান। কিন্তু পরিবারে নারীর পরিশ্রম অনেক বেশি ও ক্লান্তিকর। কিন্তু নারীর শ্রম নিরর্থক। পৃথিবীজুড়ে এখন প্রধান শ্রমিক শ্রেণি নারী। তারা উৎপাদন করছে দেশের অধিকাংশ সম্পদ। কিন্তু তাদের পারিশ্রমিক ন্যূনতম। বাংলাদেশের গামের্›টস শিল্পে ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক। এই দেশে বৈদেশিক আয়ের একটা বড় অংশ এখানে নারী শ্রমিক। হয়তো তার আয়ে সংসার চলে। অথচ আয় না করা স্বামী বা পিতা প্রাধান্য করে পরিবারে-সমাজে। এসব বিবেচনায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। পুরুষ এগোয় ভবিষ্যতের দিকে, নারী হয় ভবিষ্যৎহীন। এ অবস্থায় এসেও নারী যদি তার ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করতে না চায় বা তার জীবনের বিকাশের বিষয়গুলো খুঁজে আয়ত্ত করতে না পারে তবে একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও বলতে হয়- নারীর পশ্চাৎপদতা, মানুষ হওয়ার চেষ্টার কোনো ভবিষ্যৎই গড়ে উঠবে না। পুরুষের অধীনস্ততায় নারীর নির্ভরশীলতা ভাসিয়ে দেয়ার অর্থ হলো- নিজের বিপন্নতা ও পর্যুদস্ততা। নারীর সর্বপ্রকার প্রগতিশীলতা বা অগ্রগতিকে নিজেই থামিয়ে দেয়া। মনে রাখতে হবে, কেবল প্রগতিশীলতাই নারীর জন্য শুভ, পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা নয়। নারীকে তার ভবিষ্যৎ রচনায় পুরুষ ও পিতৃতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পুরুষতন্ত্রের প্রিয় নারীত্ব বর্জন করতে হবে। ঘৃণা করতে শিখতে হবে সম্ভোগের সামগ্রী হওয়াকে। পুরুষতন্ত্রের সমস্ত শিক্ষা-দীক্ষা নারীকে ত্যাগ করতে হবে। ছেড়ে দিতে হবে সুমাতা, সুগৃহিণী, গভীর ধারণা। তাকে আয়ত্ত করতে হবে সু-শিক্ষা এবং গ্রহণ করতে হবে পেশা। তাকে নিজেকে শাণিত করে হতে হবে সক্রিয় ও প্রতিবাদী। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে সমৃদ্ধ করতে হবে নিজেকে। ব্যক্তিত্বে প্রখর সত্তায় স্বাধীন ও সৎ হতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতে হবে। পিতৃতন্ত্রের পাতা সকল ফাঁদ অর্থাৎ পুরুষ নির্ভরতা ত্যাগ করে সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল একটি ব্যক্তি-মানুষ হয়ে উঠতে হবে। নারীকে প্রস্তুত হতে হবে সব ধরনের প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য, তাকে সর্তক হতে হবে। পুরুষতন্ত্রের প্রণীত সকল নিয়মনীতিতে পুরুষতন্ত্র কখনো নারীমুক্তি বা মুক্ত ভবিষ্যৎ চায় না। নারীকে মনে রাখতে হবে সে মানুষ, নারী নয়। নারী শুধু তার লৈঙ্গিক পরিচয়, পুরুষ প্রভু আর নারী পরিচারিকা নয়, এটাও মনে রাখতে হবে পুরুষতান্ত্রিক সকল শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারীর লড়াই সর্বদা জারি রাখতে হবে। নিজের ভবিষ্যৎ বা মানুষ হয়ে ওঠার মূল হাতিয়ার হবে শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন। নিজের ভবিষ্যৎ নারীর নিজেকেই গড়তে হবে, পুরুষ বা অন্য কেউ গড়ে দেবে না। নারীর ঐক্য, শিক্ষা, আর্থিক সাবলম্বন এবং সাহস তার লড়াই করার পথে প্রেরণা জোগাবে। দর্শন হয়ে দাঁড়াবে নারীমুক্তি বা নারীর ভবিষ্যৎ রচনায়।