শহীদ সাংবাদিক মানিক সাহা স্মরণে
Posted: 22 জানুয়ারী, 2023
‘দেশের এই অবস্থা থাকবে না। ক্ষমতাসীন সরকারের পরিবর্তন হবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’ এমন আশার কথা প্রায়শই শোনাতেন আমাদের মানিকদা (সাংবাদিক মানিক সাহা)। ২০০১ সালের অক্টোবরের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী দেশব্যাপী হত্যা, নির্যাতনের ঘটনায় দেশের শান্তিপ্রিয় প্রতিটি মানুষ যখন একপ্রকার দিশেহারা হয়ে উঠেছে, এমনকি মানিক সাহা নিজেই যখন সন্ত্রাসী, চারদলীয় জোট সরকারের প্রভাবশালী প্রশাসনের অহেতুক হয়রানির আতংকে রাতের পর রাত বাড়ির বাইরে কাটাচ্ছেন, তখনও খুলনা শহরের আহসান আহমেদ রোডের দৈনিক সংবাদের ছোট অফিস রুমে আমরা যারা তার সাথে সার্বক্ষণিক কাজ করতাম আমাদের এসব বলে সাহস যোগাতেন। সাংবাদিক মানিক সাহা হত্যার ৯ম বার্ষিকীর প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে তার সেই আশার বাণীগুলো একটু বেশি জোরেই কানে বাজছে। খুব জোরালোভাবে একটি প্রশ্ন সামনে আসছে- সাংবাদিক মানিক সাহা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত বিচার হবে তো? কেননা হত্যা পরবর্তী সময়ে তৎকালীন প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা খুলনা প্রেসক্লাবে মানিক সাহা হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি মাত্র কয়েকদিন আগে জনগণের একচেটিয়া ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। জোট সরকারের অনিয়ম দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৬ সালে বহুল আলোচিত ওয়ান ইলেভেনের পটপরিবর্তনের প্রায় দুই বছর পর নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে দেশের অনেক পরির্বতন চোখে পড়লেও সাংবাদিক নির্যাতন, হত্যা, হুমকি, অপহরণের ঘটনা আগের মতোই অব্যাহত আছে বলা যায়। গত দুবছর তত্ত্বাবধায়কের আড়ালে সামরিক শাসনামলে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছে গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকতা পেশা তথা সাংবাদিকরা। ওয়ান ইলেভেনের জরুরি অবস্থার দিন পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত সাংবাদিকরাও রেহাই পায়নি পুলিশি নির্যাতন থেকে। আর পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমের ওপর ক্ষমতাসীনদের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা কলুষিত করেছে এই মহান পেশাকে। ফলে গত দুই বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বিচার ও হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করবেন আশা করা হলেও তেমনটি হয়নি। বিচার হয়নি সাংবাদিক মানিক সাহা হত্যাকাণ্ডের। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে একটি প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা শাস্তি পায়নি। বিচারের নামে কালক্ষেপণের মাধ্যমে পার হলো ৯টি বছর। আজও নীরবে চোখের পানি ফেলে নিহত সাংবাদিকদের আত্মীয় স্বজন, সহকর্মীসহ নিকটজনরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন সারাদেশের সাংবাদিকরা। তবুও ১৫ জানুয়ারি এই শহীদ সাংবাদিক মানিক সাহার হত্যাবার্ষিকীতে আমরা নির্ভীক সাংবাদিকতা পেশাকে সমুন্নত রাখার শপথ নিতে চাই।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভাগীয় শহর থেকে মানিক সাহা পেশার প্রতি আন্তরিকতা, সততা ও সাহসিকতার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতি মিলেছে তাকে হত্যার পর বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক একাধিক “পুরস্কার” তার অবদানের অনেকটা স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি শেষে জীবনের শুরুতেই গরিব- মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতন্ত্রের আদর্শে দীক্ষিত হয়ে সুন্দর বাংলাদেশের প্রত্যাশায় কাজ শুরু করেছিলেন মানিক সাহা। সাধারণ মানুষের হাসি-কান্নার সাথী হয়ে ওঠেন খুব সহজেই। তার মৃত্যুর পর শহরের ফুল দোকানিরা বলেছিল, জাতীয় বিশেষ দিনগুলোতেও এত ফুল তারা বিক্রি করেননি, রাস্তার পাশের পান দোকানির আহাজারি, মানিক দা জিজ্ঞাসা করেছিল কখনো চাইনিজ খেয়েছি কি-না? না খেলে তিনি খাওয়াবেন, সাউথ হেরাল্ড স্কুলের আয়া-পিয়নদের বেতন বাড়ানোর কথা বলেছিলেন একমাত্র মানিক দা’। পাটকল শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের কথা লিখতেন সবার আগে, তার মতো করে আর কেউ বলবে না তাদের কথা। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে হাজারো কণ্ঠ থামিয়ে দেয়া হয়েছে। নির্ভীক সাংবাদিক মানিক সাহাকে ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি সকালে খুলনা প্রেসক্লাবের সামনে বোমা মেরে হত্যা করা হয়। তার হত্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেক বিষয় সামনে চলে এসেছে। বিভিন্ন সচেতন মহল তার শক্রু হিসেবে যাদের মনে করেন তাদের মধ্যে রয়েছে, স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকারী মৌলবাদী চক্র, প্রেসক্লাবের আধিপত্য বিস্তারে অপচেষ্টায় লিপ্ত প্রতিক্রিয়াশীল কয়েক সাংবাদিক, পরিবেশ ধ্বংস করে লবণ পানিতে চিংড়ি চাষে লিপ্ত প্রভাবশালী চক্র, চোরাচালানী-অস্ত্র ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, সুন্দরবন ধ্বংসকারী এবং মংলা বন্দর লুটপাটকারীর। রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বায়বদ্ধতার কারণে এদের বিরুদ্ধে মানিক সাহা সব সময়ই ছিলেন সক্রিয়। তিনি আজীবন লড়াই করেছেন অসহায় দুর্বলের পক্ষে, স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক মৌলবাদী চক্রের বিরুদ্ধে। এই চিত্র স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার সাংবাদিকতা, রাজনীতি ও অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। তাই সর্বশেষ ২০০১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যখন দেশব্যাপী ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় ও বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর বর্বর নির্যাতন শুরু হয় তখন তিনি দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সাথে দাঁড়িয়েছেন নির্যাতিতদের পাশে। বিবিসি, ইটিভি ও দৈনিক সংবাদে বস্তুনিষ্ঠভাবে নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন। শুধুমাত্র এটুকু করে থেমে থাকে নি সাংবাদিক মানিক সাহা। সহকর্মীদেরকেও উদ্বুদ্ধ করেছেন সত্য প্রকাশে সাহসী ভূমিকা রাখতে। মানিক সাহা কখনো কখনো প্রশাসনকেও এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করতেন। সরকার ও প্রশাসন অনেক ঘটনায় ক্ষুদ্ধ ছিলেন তার ওপর। এরকম একটি ঘটনা ঘটে ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ‘খুলনা জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি’র সভায় খুলনা প্রেসক্লাবের প্রতিনিধি হিসেবে মানিক সাহা অংশ নেন। তিনি তার আলোচনায় পত্রপত্রিকার রেফারেন্সে ওই এলাকায় সংখ্যালঘু ও বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন। এক পর্যায়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরকে অতিরঞ্জিত আখ্যায়িত করে বলেন, নির্যাতনের সকল অভিযোগ সঠিক নয়। এসময় সাংবাদিক মানিক সাহা মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেন, ‘নির্যাতনের প্রমাণ হাজির না করতে পারলে সাংবাদিকতা ছেড়ে দেবো। তবে আপনাকেও ওয়াদা করতে হবে ঘটনার প্রমাণ পেলে আপনি মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করবেন’। এতে ক্ষুদ্ধ মন্ত্রী সভা শেষ না করেই দ্রুত সভাস্থল ত্যাগ করেন। অবশ্য জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গোয়েন্দা সংস্থা মানিক সাহার ওপর সর্তক দৃষ্টি রাখতো। দেশের বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ওই বছরের শেষের দিকে যখন দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে গ্রেফতার ও হয়রানি করা হয়েছিল। সেই সময় একইভাবে হয়রানির চেষ্টা করা হয় সাংবাদিক মানিক সাহাকেও। স্বার্থান্বেষীরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে মানিক সাহাকে প্রধান বাধা মনে করে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। আর শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়।
গত ৯ বছরে মানিক সাহার হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা যায়নি। প্রশাসন বা সাংবাদিকরা তার হত্যাকাণ্ডের সঠিক কারণ চিহ্নি করতে পারেননি। অনেকে মনে করেন মানিক সাহার হত্যাকাণ্ড কোন একক ব্যক্তির সিন্ধান্তে হয়নি। সাংবাদিকদের তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এই হত্যা পরিকল্পনার সাথে জড়িত থাকতে পারে। অসৎ পথে কালো টাকা উপার্জনকারী অনেকেই এক্ষেত্রে অর্থের যোগান দিয়ে থাকতে পারে। আর ক্ষমতাসীন দলের কোন কোন এজেন্সি অথবা প্রভাবশালীদের কারো কারো এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ততার যে অভিযোগ হত্যাকাণ্ডের পর পরই উঠেছিলো, সেগুলোও উড়িয়ে দেয়া যায় না। অন্যান্য ঘটনার মতো মানিক সাহা হত্যাকাণ্ডের পর কথিত চরমপন্থি দল জনযুদ্ধ তাৎক্ষণিকভাবে এ হত্যার দায়-দায়িত্ব স্বীকার না করে, চার দিন পর এই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব স্বীকার করে ফটোকপি করা লিফলেটের মাধ্যমে। এর আগে এক মন্ত্রী ও কয়েক এমপি খুলনায় গিয়ে গণরোষের মুখে পড়েন। যা নিয়ে সে সময় জনমনে ব্যাপক প্রশ্ন দেখা দেয়। সে প্রশ্ন আজও রয়ে গেছে। কোন একটি পক্ষ, না একাধিক পক্ষ একসাথে হয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব ছিলো প্রশাসনের। কিন্তু পুলিশ তদন্তের পর এই মামলার যে চার্জশিট দিয়েছে, তা তার সহকর্মী সাংবাদিকরা, পরিবারের সদস্যরা এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সহযোদ্ধারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি। আর আমরা যারা সার্বক্ষণিক তার কাছে ছিলাম তারা হতাশ ও ক্ষুদ্ধ হয়েছি।
রাষ্ট্রযন্ত্রের এই ব্যর্থতা শুধু সাংবাদিকদের ক্ষুদ্ধ করেনি। সাংবাদিকতার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা। গত এক যুগে দেশে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ১৪ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি পাতি নেতা, সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ চরমপন্থি, চোরাচালানকারী ও প্রশাসনের হুমকি তো আছেই। অব্যাহত হুমকির কারণে অনেকে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু অব্যাহত হত্যা, হামলা, মামলার মুখে কতদিন টিকে থাকতে পারবেন সেটিই এখন মুল প্রশ্ন। কারণ এ নিয়ে প্রশাসনের রয়েছে রহস্যময় নিরবতা। খুলনায় প্রবীণ জননেতা অ্যাড. মঞ্জুরুল ইমাম হত্যাকাণ্ডের পর একটি বে-সরকারি টিভি চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে মানিক সাহা বলেছিলেন, ‘পূর্ববর্তী হত্যাকাণ্ডের কোন বিচার না হওয়ায় ঘাতকরা উৎসাহিত হচ্ছে, সংঘটিত হচ্ছে নতুন নতুন হত্যাকাণ্ড।’ মানিক সাহা’র মৃত্যুর পর তার কথাগুলোই বার বার ধ্বনিত হয়েছে আমাদের কানে, আমাদের মনে।
সরকার, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ যদি এ অঞ্চলের সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, ঘাতক সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজরা যদি পার পেয়ে যেতে থাকে, তবে যে বর্বর রাজত্বের সূচনা হবে- তা নড়িয়ে দিতে পারে গোটা রাষ্ট্রেরই ন্যায় বিচারের খুঁটি। বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক মহলের বিবেচনা করা জরুরি। এই জরুরি কাজটি এখনই শুরু হবে বলে আমরা আশাবাদী। সাংবাদিক মানিক সাহা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তি প্রদানে অঙ্গীকার বদ্ধ তৎকালীন বিরোধীদল আজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। মানিক দা’র কথামতো সবকিছু হয়তো ঠিকও হয়ে যাবে। কিন্তু বাগেরহাটের সবিতা রাণী যেমন তার সাজানো সংসার আর ফিরে পাবে না, তেমনই নাতাশা-পর্ষিয়া’র তার প্রিয় বাবা শহীদ সাংবাদিক মানিক সাহাকেও ফিরিয়ে দিতে পারবে না এই সরকার। কেবলমাত্র একটাই প্রশ্ন- এইসব বর্বর হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার হবে তো? মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের প্রিয় মানিক’দার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী