কেন সাম্যবাদী সমাজ চাই?

Posted: 22 জানুয়ারী, 2023

কেন আমরা মানুষের জন্য একটা সাম্যবাদী সমাজ চাই, সে ব্যাখ্যা একভাবে ভীষণ সেকেলে, আরেকভাবে ভীষণ নতুনও বটে। আমরা জানি না একদিন মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হবে কি না, কিংবা মানুষ বিবর্তিত হয়ে আরো উন্নততর প্রাণির উদ্ভব ঘটবে কি না। তবু মানুষ নামের চেতনাসম্পন্ন যে ঐতিহাসিক সত্তাটি এই পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো কল্পনাকে বাস্তবে রূপান্তর করার সক্ষমতা দেখালো, যা থেকে তার উদ্ভব- সেই খোদ প্রকৃতিকেই ক্ষেত্রবিশেষে যে পদানত করলো, ঐতিহাসিক সেই মানবসত্তা নিঃসন্দেহে বহুকাল টিকে থাকবে তার সৃষ্টিশীলতায়। এই মানুষ শুধুমাত্র জীবন-ধারণ ও বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম কোনো প্রাণী নয়, এই মানুষ একটি সচেতন সৃষ্টিশীল প্রজাতিসত্তার নাম, যে তার জৈবিক প্রবৃত্তিগত প্রণোদনাকে অতিক্রম করে মত্ত রয়েছে সচেতন ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের উদ্ভব তাই প্রথম প্রাণের উদ্ভবের মতোই বৈপ্লবিক। সরদার ফজলুল করিম বলতেন, ব্যক্তির মৃত্যু আছে, মানুষের মৃত্যু নেই। জৈবিক মৃত্যু একদিন আমাদের দেহকে ব্যাকটেরিয়ার খাদ্যে পরিণত করবে, আমাদের শরীরের অস্থিমজ্জার অণু-পরমাণু মিশে যাবে প্রকৃতিতে, তবু জীবিতাবস্থায় আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, কার্যকলাপ, আমাদের চিন্তা, আমাদের দ্বারা উচ্চারিত অথবা লিখিত প্রতিটি শব্দ, এই প্রকৃতিতে (এবং মানুষের সংবেদন-পরিমণ্ডলে) কোথাও না কোথাও কোনো পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটিয়ে চলছে। ব্যক্তির প্রতিটি কার্যকলাপ পরিবর্তিত করছে আশেপাশের সংবেদন-পরিমণ্ডলকে, যা আবার প্রভাবিত করছে অন্য ব্যক্তিকে। এভাবেই ব্যক্তির ভূমিকাও থেকে যাচ্ছে দুনিয়ায়, অদৃশ্য ব্যক্তি থেকে যাচ্ছে এমনকী মৃত্যুর পরেও। শক্তিশালী প্রতিভাধর মানুষের তৈরি সংবেদন-পরিমণ্ডলকে আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে, কেননা তা বহু মানুষকে সরাসরি সংবেদন জোগায় (যেমন রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের মনকে নাড়া দেয়, মার্ক্সের ক্যাপিটাল আমাদের এ সমাজকে বুঝতে শেখায়)। কিন্তু প্রতিটি মানুষই কম-বেশি এরকমভাবে তার ছাপ রেখে যায় তার সংবেদন পরিমণ্ডলে যা আবার ছাপ ফেলে অন্যের ওপর। আমাদের অজস্র অদৃশ্য পূর্বপুরুষের কার্যকলাপের রেশ রয়ে গেছে আমাদের সংবেদন-পরিমণ্ডলে, তার তা থেকেই সংবেদন নিয়ে আমরা আজকের ‘আমি’, আজকের ‘ব্যক্তি-মানুষ’। আমাদের এই গোটা প্রজন্মের মৃত্যুর পরেও আমরা অল্পবিস্তর হলেও টিকে থাকবো উত্তরপ্রজন্মে, আমাদের ক্রিয়াকলাপে পরিবর্তিত সংবেদন-পরিমণ্ডল প্রভাবিত করবে নতুন প্রজন্মের মানুষ ও তাদের সৃষ্ট সংবেদন-পরিমণ্ডলকে অর্থাৎ তার বস্তুজগতকে। জীবদ্দশায় আশেপাশের বস্তুজগত ব্যক্তি মানুষের চেতনায় নানাভাবে প্রতিফলিত হয়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই মানুষকে বিরূপ প্রকৃতি ও পরিবেশে লড়তে হয়, মানুষ হয়ে টিকে থাকতে বস্তুজগত থেকে পাওয়া সংবেদনগুলো মিথষ্ক্রিয়তায় ও সংশ্লেষণে নতুন নতুন র্অথ বা চিন্তা তৈরি করে। আবার সেই চিন্তা যখন প্রকাশিত হয় ভাষার মাধ্যমে, সেটিও তখন আরেকজনের কাছে নতুন সংবেদনরূপে হাজির হয়। অসামান্য প্রতিভাধর কারো হয়তো সংবেদনগুলোকে সংশ্লেষণের ক্ষমতা বেশি থাকে, প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত সংবেদন-সংশ্লেষণে নতুন নতুন জটিল-যৌগিক কাঠামোতে নতুন নতুন প্রভাবশালী চিন্তার উদ্ভব ঘটান তিনি। কোন কোন চিন্তা এমনই অভিনব ও প্রভাববিস্তারী হয়ে ওঠে যে তা আশেপাশের বস্তুজগত ও পরিবেশকে (এবং তা থেকে সৃষ্ট সংবেদনকে) ভীষণভাবে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করে। সুতরাং যে ‘আমি’ প্রতিনিয়ত মরে যাচ্ছি নতুন ‘আমি’র জন্মের কারণ হয়ে, সেই আমিই আবার হয়তো বহুকাল টিকে থাকছি অন্য কোন আমি’র মাঝে সংবেদন-সাগরে এক ক্ষুদ্র সংবেদন তরঙ্গ হয়ে! আমার মাঝেই মানুষ বেঁচে আছে আবার মানুষের মাঝেই ব্যক্তি ‘আমি’ বেঁচে থাকবো! মানুষ হিসেবে আমাদের টিকে থাকা, মানুষের জীবনকে সক্রিয় ও অর্থপূর্ণ হিসেবে ভাবতে পারার সক্ষমতাই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে। আর ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে পারার সামর্থ্যই মানুষ হিসেবে সাম্যবাদী সমাজ গড়তে আমাদের তাড়িত করে। মার্কস বলেছেন, অর্থনীতি হলো ভিত্তিকাঠামো; যার ওপর দাঁড়িয়ে সমাজের নানা উপরিকাঠামো, যেমন রাজনীতি, সংস্কৃতি, দর্শন, সাহিত্য, রাষ্ট্রকাঠামো ইত্যাদি নির্মিত হয়। উপরিকাঠামো এবং ভিত্তিকাঠামোর সম্পর্কটা দ্বান্দ্বিক, অর্থাৎ, উপরিকাঠামোও কখনো কখনো ভিত্তির কাঠামোকে প্রভাবিত করে। ব্যাপারটা বস্তু ও চেতনার সম্পর্কের মতো। সংবেদনক্ষম বস্তু থেকে চেতনা’র উদ্ভব, আবার সেই চেতনাই তার আশপাশের বস্তজগতকে পরিবর্তিত করে এবং ভিন্নতর সংবেদনপরিমণ্ডল তৈরি করতে পারে। সমাজের ক্ষেত্রেও অর্থনীতি হলো মৌল বস্তুগত কারণ, যা থেকে উপরিকাঠামোর বিভিন্ন উপাদান নির্মিত হয়, এবং এবং উপরিকাঠামো বিষয়গুলো পরস্পরের সাথে এবং ভিত্তিমূলের সাথে জটিল দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকরা এই ভিত্তি ও উপরিকাঠামোকে বিশদ ও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন। গ্রামসিও দেখিয়েছেন, উপরিকাঠামোয় আধিপত্য (হেজিমনি) বিস্তার করে কিভাবে শাসকশ্রেণি ভিত্তিকাঠামোর মূল দুর্গকে অক্ষত রাখে। এই মৌল অর্থাৎ ভিত্তিকাঠামোকে অন্যভাবেও দেখা যায়। অর্থনীতি নিছক টাকা-পয়সার ব্যাপার নয়, একটি জৈবিক-সামাজিক প্রক্রিয়াও বটে। সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে প্রতিটি জীবসত্তারই নিজস্ব উৎপাদন কাঠামো আছে। একটি ব্যাকটেরিয়া কিংবা এককোষী প্রাণী, তার জীবন ধারণের জন্য প্রকৃতি থেকে সরলতর উপাদান সংগ্রহ করে। সংগৃহীত উপাদানগুলোকে সে তার ভেতরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অঙ্গাণুগুলোর মাধ্যমে সংশ্লেষন করে নিজের জন্য শক্তি উৎপন্ন করে, বেঁচে থাকে ও বংশবৃদ্ধি করে এবং কোষদেহে উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থগুলোকে প্রকৃতিতে ফেরত পাঠায়। প্রকৃতির সাথে প্রকৃতিরই এক সজীব অংশের এই আদান প্রদান কী তার নিজস্ব উৎপাদন কাঠামো নয়? সজীব কোষটির নিজস্ব বেঁচে থাকার উপাদান সংগ্রহ ও সংশ্লেষণ করার মাধ্যমে প্রকৃতির সাথে তার গড়ে ওঠা সম্পর্কই কি তার উৎপাদন সম্পর্ক নয়? বহুকোষী প্রাণি, উন্নততর প্রাণীরও জীবন ধারণের জন্য প্রকৃতি থেকেই উপাদান সংগ্রহ করতে হয়, কিন্তু তার বেঁচে থাকার প্রক্রিয়া আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত, তার শরীরদেহ বিভিন্ন অঙ্গতন্ত্রে বিভক্ত, একেক অঙ্গের আকার-আকৃতি ও কাজ একেকরকম, কিন্তু এরা সকলে মিলেই একটি একক। এই সম্মিলিত এককও প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে এবং উৎপাদন করে তার জৈবিক জীবনধারণের জন্যে। প্রকৃতির সাথে জীবদেহের এবং কোষগুলোর পরস্পরের সাথে পরস্পরের জটিল সম্বন্ধকে কি তাদের উৎপাদন সম্বন্ধ বললে অত্যুক্তি হবে? এই জটিল উৎপাদন সম্বন্ধই কি তাদের বেঁচে থাকবার ভিত্তিকাঠামো নয়? মানুষও প্রাণী। অথচ অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় তার পার্থক্য অনেক। মিল একটি জায়গায়, যে তার জীবনধারণের জন্য সমস্ত উপাদান সংগ্রহ করতে তাকে প্রকৃতির কাছেই ফেরত যেতে হয়, তবে সে ক্ষেত্রবিশেষে প্রকৃতিকে বশে আনতেও সক্ষম। মানুষের জীবন যেহেতু বিশাল এক অর্থ বহন করে, যেহেতু মানুষ সৃষ্টিশীল, তাই মানুষের বেঁচে থাকা বলতে, জীবনধারণ বলতে শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকা বোঝায় না। মানুষের কৌতুহল অদম্য, তার সৃষ্টিশীলতা অসীম, কল্পনাশক্তি অসামান্য, তাই তার জীবন জটিল এবং চাহিদা অশেষ। তার শুধু দেহকে পুষ্টি যোগালে চলে না, তার সৃজনশীল মনকেও পুষ্টি যোগাতে হয়। একারনে তাকে নিজ শরীরের বাইরে উৎপাদন করতে হয় নানা কিছু, এমনকী সে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সংবেদন পরিমণ্ডলে নিজেকে নতুন করে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে। এই উৎপাদন সে একলা করতে পারে না, তাকে যুথবদ্ধ হতে হয়। তার এই জৈবিক-মননগত চাহিদা পূরণে তাকে সমাজ সৃষ্টি করতে হয়, সামাজিকভাবে বস্তুগত ও মননগত দ্রব্য উৎপাদন করতে হয়। মানুষের এই জটিল সামাজিক উৎপাদনপ্রক্রিয়া এবং উৎপাদনের হেতু মানুষ-প্রকৃতি ও মানুষ-মানুষের সম্পর্কই তার অস্তিত্বের পূর্বশর্ত। এই অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো মৌল কাঠামো, যাকে অর্থনীতি বলা যেতে পারে, যা নির্ভর করছে উৎপাদন ও উৎপাদনসংশ্লিষ্ট সম্পর্কগুলোর ওপর। সামাজিকভাবে উৎপাদিত বস্তুগত ও মননগত দ্রব্যগুলো গোটা মানুষ প্রজাতির মধ্যে কিভাবে বণ্টিত হচ্ছে, সেটিই অনেকখানি নির্ধারণ করছে মানুষের সৃষ্ট অন্যান্য উপরিকাঠামোর চরিত্রকে। এই বন্টনের প্রক্রিয়া সামাজিকভাবে যে বস্তুগত শর্ত তথা সংবেদন-পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে রাখছে, সেটা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে সে সময়কার মনুষ্যসৃষ্ট দর্শন, রীতি-নীতি, আইন-কানুন, রাষ্ট্রকাঠামো, প্রথা, সংস্কৃতির মতো বিষয়গুলো। দেহের সুস্থতার জন্য যেমন দেহের প্রতিটি কোষে সুষমভাবে পুষ্টিপ্রবাহ প্রয়োজন, সমাজদেহেও সমস্ত একক মানুষে ঠিকভাবে পুষ্টিপ্রবাহ না পৌঁছালে, সে সমাজদেহকে তো রুগ্ন বলতেই হয়! রুগ্ন দেহে সুস্থতার জন্য লড়াই চলতেই থাকে, আর সেটাই পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি। বাস্তব সমাজ থেকে প্রাপ্ত লড়াইয়ের এই সংবেদনই (শ্রেণিসংগ্রাম) পরিবর্তন নিয়ে আসে, ওলটপালট করে দেয় ভিত্তিকাঠামোতে গড়ে ওঠা পুরনো অসামঞ্জস্যপূর্ণ উৎপাদন সম্পর্কগুলোকে। উৎপাদন সম্পর্কে সমতা না আসা পর্যন্ত এই ভাঙ্গা গড়া চলবেই আর লড়াইয়ের প্রণোদনা ও সংবেদনও সমাজে উপস্থিত থাকবে বিপ্লবী বার্তা নিয়ে। জীবনের ভ্রুণ যেখানে থাকে সেখানেই তা সংগ্রামে প্রকাশিত হতে চায় এবং একসময় বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে, প্রতিকূল পরিবেশে অভিযোজিত হয়ে সগৌরবে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। সাম্যের স্বপ্ন-বীজ হলো মানুষের মহোত্তম ভাব- প্রচণ্ড শক্তিশালী, সম্ভাবনাময়, অভিযোজনক্ষমতাসম্পন্ন এক ভ্রুণ। একমাত্র মানুষই পারে তা থেকে বাস্তব ফসল ফলাতে, কেননা স্বপ্নকে-চিন্তাকে বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম সৃজনক্ষম সৃষ্টিশীল শিল্পীসত্তার নামই তো মানুষ। সুতরাং মানুষ থাকলে সমাজ থাকবে, সমাজ থাকলে সেখানে সমতার আকাঙ্ক্ষা থাকবে, সমতার আকাঙ্ক্ষা থাকলে সাম্যবাদের স্বপ্ন-বীজ এবং তার জন্য লড়াইয়ের সংবেদন সমাজভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবেই। সুতরাং মানুষ হয়ে উঠতে চাইলে আমাদের সাম্যবাদী হয়ে উঠতেই হয়! লেখক : শিক্ষক, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়