প্রগতি সহিত্যচর্চার বাতিঘর রণেশ দাশগুপ্ত

Posted: 22 জানুয়ারী, 2023

একই সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং রাজনীতি নিয়ে ভাবনা-চর্চার এক দৃঢ়-বলিষ্ঠ পথিকৃত রণেশ দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৯৭)। এই পথচলায় তিনি আলোর পথ দেখিয়েছেন প্রগতির পথে চলমান মানুষদের। উদার মানসিকতা, সামগ্রিক মানবকল্যাণ, সার্বিক মানবমুক্তি, উদার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, শোষণ-বঞ্চনাহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ছিল রণেশ দাশগুপ্ত-র পথচলার ভিত্তি। সেই ভিত্তি ছিল কঠিন কংক্রিটে গাঁথা। ফলে আমৃত্যু তিনি অবিচল থেকেছেন তাঁর আদর্শিক পথচলায়। আলোর পথে চলেছেন, আর আলো ছড়িয়েছেন, তাই আঁধার হটানিয়া এক আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। আলো খুঁজেওছেন তিনি বিশ্বময়। বিচরণ করেছেন বিশ্বসাহিত্য-সংস্কৃতির ভাণ্ডারে। নির্যাস গ্রহণ করেছেন বিশ্বভাণ্ডারের বিচিত্র সংগ্রহশালা থেকে। মন্থন করেছেন আপন ঐতিহ্যভাণ্ডার। হয়ে উঠেছেন এক ঋদ্ধ ভাণ্ডারী। সমৃদ্ধ সেই ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছেন ভবিষ্যতের পথে। আলোকচ্ছটায় উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে সেই আলো-আঁধারী পথ। এ যেন এক ‘আলোর শিখা’। স্বীয় ভাবনা-বিবেচনা-মেধা, সত্যের পথে অবিচল সংগ্রাম আর দৃঢ় প্রত্যয়ে রণেশ দাশগুপ্ত হয়ে উঠেছেন বাঙালির প্রগতির পথে পথ চলার মস্তিষ্ক বা ‘নৌস’– যেমনটি এরিস্টটল ছিলেন প্লেটোর একাডেমিতে। রণেশ দাশগুপ্ত-র পথচলা বিচিত্রতর। শিল্প-সাহিত্য চর্চা-অনুধ্যান, জীবিকার অন্বেষায় চাকরি, সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা, সংগঠন গড়ে তোলা, দৃঢ়তার সঙ্গে নিজ ভাবনার লেখ্য ও বাচ্য উপস্থাপনা, কারাভোগ, কারাগারে আন্দোলন গড়ে তোলা, বিশ্বসাহিত্য মন্থন করে তার নির্যাস নিজ সাহিত্যে সংযুক্ত করা কিংবা হুবহু অনুবাদের মাধ্যমে বাঙালি পাঠকের কাছে তুলে ধরা ইত্যাদি কোনো কিছুই বাদ যায়নি রণেশ দাশগুপ্তর জীবন সংগ্রাম থেকে। বাদ গিয়েছে কেবল নিজের সুখ-শান্তি আর বিলাসীতার অধ্যায়। চির অকৃতদার রণেশ দাশগুপ্ত তাই হয়ে উঠেছেন নিখাদ জীবন সংগ্রামী। রণেশ দাশগুপ্ত-র জন্ম বঙ্গভঙ্গ রদের বছর ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে। ব্রিটিশ-বেনিয়া শাসকগোষ্ঠী তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে বাংলাকে বিভাজন করার উদ্যোগ নেয় ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে। কিন্তু সংগ্রামী বাঙালি তা মেনে নেয়নি। সংগ্রাম করেছে দীর্ঘ প্রায় এক দশক। পরাভূত করেছে শাসকগোষ্ঠীকে। সেই সংগ্রামে যুক্ত হয়েছেন সমসাময়িক সময়ের সর্বস্তরের ধী-শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিবৃন্দ থেকে দেশের আপামর সাধারণ মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (এস. এন. ব্যানার্জি), কৃষ্ণকুমার মিত্র, সুবোধচন্দ্র মল্লিক, পুলিনবিহারী দাস, অশ্বিনীকুমার দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল, মুকুন্দদাস, ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী এবং আরও অনেকে যুক্ত থেকেছেন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্বাসন, ফাঁসি কোনো কিছুই দমাতে পারেনি সেই আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গ রদ হয় ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে। ‘ভারত এ্যাক্ট’ সংসদে পাশ হয় এই বছরের ২৫ জুন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ক্রমে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক-বিস্তৃত এবং শক্তিশালী সেই আন্দোলন দমাতে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী নানা কৌশল অবলম্বন করে। জারি করে নতুন নতুন আইন আর নিষেধাজ্ঞা-বিধি; চালায় কঠিন-কঠোর দমন-পীড়ন। আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ পয়ত্রিশ (১৯১২-১৯৪৭) বছরের সংগ্রামের পর ব্রিটিশরা এদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশবিরোধী এই সংগ্রাম নিয়েও নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। মতানৈক্য হয় আন্দোলনের পথ ও পাথেয় নিয়ে। সশস্ত্র সংগ্রাম না শান্তির পথে আগুয়ান এই বিতর্কের প্রকাশ্য রূপ পায় ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে সুরাটে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের ত্রয়োবিংশ সম্মেলনে। রাসবিহারী ঘোষের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ‘চরমপন্থি-নরমপন্থি মতভেদ, গ-গোল, সভা প-’ এর ধারাবাহিকতায় বাংলায় স্বাধীনতা সংগ্রাম দুই সমান্তরাল ধারায় অগ্রসর হতে থাকে। একদিকে সশস্ত্র বিপ্লব, অন্যদিকে অহিংস পথে পথ চলা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ অহিংস পথের পক্ষে অবস্থান নিলেন। অনেক বিপ্লবী সেদিন রবীন্দ্রনাথকে ‘বিভ্রান্ত’ বলে আখ্যায়িত করেন। গান্ধীর নেতৃত্বে এই পথ ক্রমে বিকশিত হতে থাকে। অপেক্ষাকৃত তরুণ সংগ্রামীরা সহিংস-সশস্ত্র বিপ্লবের পক্ষে অবস্থান নেয়। এদের মধ্যে অনেকে পরে অহিংসার পথে ফিরে আসেন আর অসংখ্য বিপ্লবী ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ প্রাণ বলি দেন। এমন প্রতিবেশে বেড়ে ওঠা রণেশ দাশগুপ্ত কৈশোর না পেরোতেই বিপ্লবী দলের সংস্পর্শে আসেন। মাত্র নয় বছর বয়সে রাচি জিলা স্কুলের নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রাবস্থায় তিনি বিপ্লবীদের সংগে যুক্ত হন। রণেশ দাশগুপ্ত সতের বছর বয়সে প্রবেশিকা পাশ করে ভর্তি হন বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজে। থাকতেন কলেজের ছাত্রাবাসে। সেখানে তিনি সরাসরি যোগ দেন অনুশীলন সমিতিতে। সরাসরি অংশ নেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে। কলেজেও গড়ে তোলেন আন্দোলন– ডাক দেন ছাত্র-ধর্মঘটের। সেই অপরাধে কলেজ থেকে বিতাড়িত হন টগবগে তরুণ রণেশ দাশগুপ্ত। বাঁকুড়া ছেড়ে এবার কলকাতা। ভর্তি হন কলকাতা সিটি কলেজে। থাকেন রামমোহন রায় হোস্টেলে। সেখানেও নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন রণেশ দাশগুপ্ত। এই কলেজ থেকেই তিনি আই. এস. সি. পাশ করেন ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে চিন্তিত অভিভাবক এবার তাঁকে পাঠিয়ে দেন বরিশালে। ভর্তি হন সত্য-প্রেম-পবিত্রতার ধারক ব্রজমোহন কলেজে– ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে। প্রথমে কিছু দিন জীবনানন্দ দাশের পৈত্রিক বাড়ি ‘সর্বানন্দ ভবন’- এ থেকে উঠে আসেন কলেজ ছাত্রবাসে। বরিশাল তখন স্বাধীনতা সংগ্রাম-আন্দোলনে উদ্বেলিত। মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত-র মানসপুত্র চারণকবি মুকুন্দদাস তখন উজ্জ্বলতার শীর্ষে। বরিশালের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি পাড়া মহল্লায় স্বাধীনতা সংগ্রাম দানা বাধতে থাকে। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, অনুশীলন সমিতি ছাড়াও স্থানীয় অসংখ্য সংগঠন এই আন্দোলনে সামীল হয়। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত প্রতিষ্ঠিত ব্রজমোহন বিদ্যালয় ও ব্রজমোহন কলেজ শুরু থেকেই দেশাত্মবোধের অগ্নিশপথে উদ্দীপ্ত। বরিশালে নারী সংগঠনের অগ্রদূত মনোরমা বসু তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মিছিল সমাবেশের অগ্রভাগে। তাঁর সঙ্গে আছেন মনিকুন্তলা সেন, বীনা দাস, বিভা দাশগুপ্ত প্রমুখ। আইন অমান্য আন্দোলন চলার সময় মনোরমা বসু কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা তুলে দেন পার্টি অফিসের ছাদে (২৬ জানুয়ারি ১৯৩০)। ২ ফেব্রুয়ারি মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরুলে পুলিশ হামলা চালায়। প্রতিবাদে ৩ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করা হয় বরিশালে। মনোরমা বসু গ্রেফতার হন ৬ ফেব্রুয়ারি; বিচারে ৬ মাসের জেল। বরিশাল শহরের পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠে বিপ্লবী সশস্ত্র সংগঠন; প্রতিষ্ঠিত হয় অসংখ ‘ব্যায়ামাগার’ আর প‘াঠাগার’। নিয়মিত শরীরচর্চা, লাঠিখেলা প্রশিক্ষণ, দেশি অস্ত্র চালনা শিক্ষাদান এবং সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সাহিত্য পাঠ ছিল এইসব ব্যায়ামাগার-পাঠাগারের মূল লক্ষ্য। অধ্যাপিকা শান্তিসুধা ঘোষ প্রমুখের উদ্যোগে ব্রজমোহন কলেজেও চলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। এমন রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞের মধ্যেই রণেশ দাশগুপ্তের বরিশাল আসা এবং ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি। সঙ্গত কারণেই স্বাধীনতা সংগ্রামে উত্তাল সেই বরিশালে রণেশ দাশগুপ্ত এর থেকে দূরে থাকতে পারেননি। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জড়িয়ে পড়েন অনুশীলন সমিতির বরিশালের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। ব্রজমোহন কলেজ ছাত্রাবাসে গড়ে তোলেন ‘জাগরণী গোষ্ঠী’ নামে বিপ্লবী গ্রুপ-সংগঠন। প্রায় তিন বছর বরিশালে অবস্থানকালে বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন রণেশ দাশগুপ্ত। (চলবে) লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী