বিপদ বাড়াচ্ছে সরকারের আইএমএফ তোষণ
Posted: 22 জানুয়ারী, 2023
করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি, খাদ্য, শিল্পের কাঁচামালসহ সব পণ্যের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার দ্রুত অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট- একের পর সমস্যায় বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে চলমান অনিশ্চয়তা সহসাই কাটছে না। কোনো কোনো দেশে মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী হলেও সার্বিকভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলার সঙ্কট ও আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা নিয়ে জটিলতা। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বেড়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্য ও লেনদেনে ঘাটতি বেড়েছে। সেই সাথে যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সঙ্কট, গ্যাস সরবরাহে অনিশ্চয়তা, সরকারের ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধি, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে লাগাম টেনে ধরা, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা, শিল্পখাতে পুঁজি প্রবাহ হ্রাস পুঁজিবাজারের নিম্নগতি এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ায় অর্থনীতি স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। এসব প্রবণতা মুল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলায় সাধারণ মানুষের আয়-ব্যয়ের মধ্যে তৈরি হয়েছে বড় রকমের পার্থক্য।
তার উপর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) খুশি করতে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। এতে সরকারের আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কিছুটা কমলেও সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে বাড়ছে শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিচালন ব্যয়। বাড়বে কৃষি উৎপাদন ও পরিবহন খরচ। সব কিছুর মিলিত ফল গিয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। এমনিতেই জিনিসিপত্রের দাম অসহনীয় অবস্থায় চলে গেছে। তার ওপর আরেক দফা দাম বাড়লে মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্কট চরম আকার ধারণ করবে।
তবে মানুষের এই সঙ্কট নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। কারণ সাধ্যের চেয়ে বড় আকারের বাজেট ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়নে হোঁচট খেতে হচ্ছে। পরিকল্পনা মতো রাজস্ব আয় বাড়েনি। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-নভেম্বর) গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আহরণের গড় প্রবৃদ্ধি কমেছে ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ। এই সময়ে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রাজস্ব ঘাটতি ১৫ হাজার ১২২ কোটি টাকা।
কাক্সিক্ষত হারে আয় না বাড়লেও সরকারের ব্যয় অনেকটাই বেড়ে গেছে। ফলে আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলাতে ঋণনির্ভরতা বেড়েছে। কিন্তু সরকারের ঋণের অন্যতম উৎস সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের হিসাব অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমান ছিল ৩৪ হাজার ৯৩৪ কোটি কোটি টাকা। এর বিপরীতে পুরনো সঞ্চয় ও সুদ হিসেবে বিনিয়োগকারীরা তুলে নিয়েছে ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ, সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় হয়েছে বেশি। এ কারণে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। এ সময় সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৬৫ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেছে ৩৩ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা।
ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের ঋণে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু নভেম্বর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
সরকার ঋণ করে বাজেট ব্যয় সামাল দিলেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি আরো বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও প্রকৃত আয় কমবে।
এদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে চলমান মন্দার মধ্যেই রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি খাতে ২ হাজার ৭২২ কোটি ডলার- যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে সাড়ে ১০ শতাংশ বেশি। এরমধ্যে গত ডিসেম্বর মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৫৩৭ কোটি ডলার- যা এক মাসের রপ্তানি আয়ের হিসাবে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৪৯ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৪ কোটি ডলার। সেই হিসাবে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আগের বছরের তুলনায় ২৮ কোটি ৭ লাখ ডলার বেশি রেমিট্যান্স এসেছে।
অন্যদিকে কম প্রয়োজনীয় ও বিলাস পণ্য নিরুৎসাহিত করার পরও সার্বিক আমদানি ব্যয় বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ২৫৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার- যা আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য ও লেনদেনে বড় রকমের ঘাটতি রয়েই গেছে। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বৈদেশিক বাণিজ্য (ব্যালেন্স অব ট্রেড) ঘাটতির পরিমান দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭৯ কোটি ডলার। একই সময়ে বৈদেশিক লেনদেনে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৩৮ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এই ঘাটতির পরিমান ৪৩৬ কোটি ডলার বেশি। লেনদেনের ঘাটতির প্রভাবে ৩২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
চলতি হিসাবে ভারসাম্য ও রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোর পথ হচ্ছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির বাড়ানো। এখন পর্যন্ত এই দুই খাতের পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত ইতিবাচক হলেও আগামীতে সেই ধারা অব্যাহত রাখা কঠিন হতে পারে। বড়দিন ও শীত মৌসুমের জন্য পাওয়া ক্রয়াদেশ সরবরাহের পর তৈরি পোশাক রপ্তানি পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে বলে উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা। যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। প্রধান দশটি রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে রয়েছে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইতালি, নেদারল্যান্ড ও ফ্রান্স। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হলে এসব দেশের অর্থনীতির চলমান সঙ্কট বাড়বে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবার ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কাঁচামালের আমদানি খরচ বৃদ্ধি এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে রপ্তানি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশের রপ্তনি পণ্য।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুদ্ধ ও তার প্রভাবে বিশ্বমন্দা দীর্ঘায়িত হলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে পণ্য রপ্তানিতে। কারণ সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বাজার ইউরোপ। সেখানে মন্দা পরিস্থিতি গভীর ও দীর্ঘায়িত হলে রপ্তানিতে বড় রকমের আঘাত আসবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের একটি বড় অংশ আসে চীন থেকে। করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কারণে চীনের অর্থনীতি হোঁচট খেলে সেখান থেকে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাহত হবে। এতেও রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের চাপিয়ে দেয়া মুনাফামুখী বাজার অর্থনীতিই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক চলমান সঙ্কটের মূল কারণ। অতীতে তাদের চাপিয়ে দেয়া নানা শর্ত মানতে গিয়ে একদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বোঝা বেড়েছে, অন্যদিকে একের পর এক শিল্প কারখানা বন্ধ ও ছাঁটাইয়ের কারণে বেকার হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সঙ্কুচিত হয়ে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ইতোমধ্যে দেশে দেশে ব্যর্থ প্রমাণ হওয়া আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের চাপিয়ে দেয়া নীতি থেকে সরে এসে যখন গণমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কার্যকর করা জরুরি, তখন নতুন করে তাদের শর্তের জালে জড়িয়ে পড়ছে সরকার।