বেশির ভাগ নারী শ্রমিকরা ভুগেন অপুষ্টিতে
Posted: 26 জুন, 2022
সেই প্রাগৌতিহাসিক কাল থেকে পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা জীবনের সবক্ষেত্রেই শোষিত হয়। নারীদের শ্রমকে গুরুত্ব না দেওয়ায় বা তাদের শ্রমকে আমলে না নেওয়ায় স্বভাবতই মনে করা হয় পুরুষের তুলনায় নারীর কম খাদ্যের প্রয়োজন। নারীকে শারীরিকভাবে পুরুষের তুলনায় দুর্বল মনে করা হতো বা এখনো হয়। একারণে পর্যাপ্ত বেড়ে ওঠার জন্য নারী তার প্রয়োজনীয় খাদ্য, পুষ্টি উপাদানগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। কালের বিবর্তনে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য কিছুটা হ্রাস পেয়েছে কিন্তু নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারগুলোতে এখনো নারীরা নিদারুণ পুষ্টিহীনতায় ভোগে। শুধুমাত্র ঘরে থাকা নারীরা নয় অধিকাংশ নারী উপার্জনক্ষম হলেও, পরিবারের পুরো ব্যয়বহন করলেও নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে কখনও চিন্তা করার সুযোগ হয়ে ওঠে না। নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করাটাকে তারা বিলাসিতা মনে করেন। দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা কর্মস্থলে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ঘরে এসেও অনেক কাজ করতে হয় কিন্তু পরিবারের চাহিদা মেটাতে যেখানে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার সুযোগ একেবারেই নেই।
রেখা একজন গার্মেন্টস শ্রমিক। বয়স তেত্রিশ। তার সকাল ৮ থেকে রাত ৯ টা পর্যন্তও অনেক সময় কাজ করতে হয়। রেখার প্রায়শই ভীষণ মাথাব্যাথা অনুভূত হয়। মাথাব্যাথা কমানোর জন্য ব্যাথানাশক ওষুধ খান। ডক্তারের স্মরণাপন্নও হয়েছেন। ডাক্তারের মতে তার রক্তশূন্যতা। এজন্য লৌহজাতীয় খাবার বেশি খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। কয়েকবার রক্তও দিতে হয়েছে। কিন্তু এই দুর্মূল্যের বাজারে তার পক্ষে পুষ্টিকর খাবার কিনে খাওয়া সম্ভবপর নয়। আর বারবার রক্ত দেওয়াও ব্যয়সাপেক্ষ। তাই তিনি ওষুধ সেবন করেই ব্যাথা কমানোর চেষ্টা করেন।
রুবিনা আগে একটা গার্মেন্টসে চাকুরি করতেন। এখন তিনি চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ বসে বসে কাজ করতে করতে তার কোমড়ের হাড্ডি ক্ষয় হয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি রান্না করে করে কর্মজীবী মানুষদের খাওয়ান। কিন্তু আগে কখনোও পারেননি নিজে ক্যালসিয়াম ভিটামিন ‘ডি’ যুক্ত খাবার খেতে। আর এখন পঞ্চাশ, ষাট টাকা কেজি দরে চাল কিনে কোনোরকমে দুবেলা পেট ভর্তি করেন। পুষ্টিকর খাবারের কথা চিন্তা করাই অসম্ভব। প্রসবকালীন সময়েও ভালো খাবার খেতে পারেননি। তিনি বলেন, বাচ্চা পেটে নিয়াও একটুও জিরাইতে পারি নাই। সন্তান জন্মদানের পর ভীষণ অসুস্থও হয়ে পরেছিলেন তিনি।
সিলেটে চা বাগানে কর্মরত চা শ্রমিক মীরা হাজরা। বয়স চল্লিশ, চার সন্তানের জননী। দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি পান। তিনি বলেন চালের কেজি ৫০ টাকা। এই টাকা দিয়ে দুবেলা ভাত খাইতে পাই না, ভালো খাবার কেমনে খাবো? প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাবে, স্বামীর চাপে ছেলে সন্তানের আাশয় কম বয়সে একাধিক বার মা হতে হয়। মাতৃত্বকালীন অবস্থাতেও এই চিত্র অপরিবর্তিত থাকে। আলাদাভাবে কোনো পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার সুযোগ হয় না। তাই নিদারুণ অপুষ্টিহীনতা নিয়েই নতুন শিশুকে জন্ম দেয়। অনেক সময় এটা তাদের প্রাণনাশেরও কারণ হয়। এছাড়াও নতুন ভূমিষ্ঠ শিশুও অপুষ্টিহীনতা নিয়ে জন্মে। মাঝে মাঝে অসুস্থ বোধ করলে হাসপাতালে গিয়ে প্রেসার মাপান। ডাক্তার ওষুধ লিখে দেয়, ভালো খাবার খেতে বলে। কিন্ত মীরা হাজরা বলেন এতো কম পয়সায় নিজে ডিম দুধ খাবার স্বপ্ন আমি দেখি না।
হুরায়রা একটা গার্মেন্টসে বারো বছর ধরে কাজ করে। তিন সন্তান আর স্বামীর সংসারের করচ তাকেই বহন করতে হয়। দুই সন্তানকে স্কুলে পড়ান। বাড়ি ভাড়া আর সন্তানদের স্কুলের খরচ দেওয়ার পর অতিসামান্যই খাওয়ার পেছনে খরচ করতে পারেন। এই দুর্মূল্যের বাজারে সবার জন্য প্রত্যেকবেলায় ভাত জোগাড় করাই মুশকিল, পুষ্টিকর খাবার খাবেন কী করে। তিনি বলেন যখন পেটে বাচ্চা ছিলো তখনও ঠিক মতো খাবার খেতে পারি নাই। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার কারণে মেরুদণ্ড আর হাত পায়ের হাড়ে ভীষণ ব্যাথায় ভুগছেন। এতো কম আয়ে সংসার চালানো দায় সেখানে ডাক্তার দেখানো, ওষুধপত্র কেনা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অসম্ভব।
অল্পবিস্তর সব জায়গাতেই একই চিত্র। নরী শ্রমিকদের আয়ে পুরো সংসার চলছে, তাদের অর্থনৈতিক অবদান থাকা সত্ত্বেও চরম পুষ্টিহীনতায় ভুগেন। বেশিরভাগ নারীদের শরীর ভেঙে পড়ে। রক্তশূন্যতা, মেরুদণ্ডের হাড়ে ব্যাথা বা হাড় ক্ষয় এগুলো খুবই সাধারণ ঘটনা। এছাড়া অল্পবয়সে এবং অপরিকল্পিতভাবে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কারণে এই পুষ্টিহীনতার প্রভাব আরো প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। অধিকাংশ নারী শ্রমিকের চেহারায় একটা ক্লান্তির ছাপ থাকে। এছাড়াও সেই চিরায়ত নারী সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের স্বাস্থ্যকে নিয়ে তারা একেবারেই ভাবতে নারাজ। পরিবারের আর সবাই যতটুকু খাবার খায়, অভাব অনটন এবং তাদের সেই আদিম চিন্তার দরুণ তারা তার চাইতেও কম খাবার খেয়ে থাকেন। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও পর্যাপ্ত খাবারের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় অতি অল্প বয়সেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন।