পার্টির রাজনৈতিক রণকৌশলগত ভাবনা-১

Posted: 28 নভেম্বর, 2021

[বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি তার দ্বাদশ কংগ্রেসে সম্মিলিত প্রজ্ঞা ও মতামতের ভিত্তিতে পার্টির রণকৌশলগত রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণ করবে। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সে বিষয়ে সদস্যদের মতামত ও পরামর্শের জন্য ‘রাজনৈতিক প্রস্তাবের’ খসড়া প্রণয়ন করে তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এই খসড়া ‘রাজনৈতিক প্রস্তাবে’ দেশের বিরাজমান অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রবণতাসমূহ, এবং একইসাথে আন্তর্জাতিক-আঞ্চলিক অবস্থা, বিশ্লেষণ করে পার্টির রাজনৈতিক কর্মকৌশলের প্রস্তাবনা নির্ণয় করা হয়েছে। এই খসড়া দলিলের বিশেষ-বিশেষ কিছু অংশ ‘একতা’র পাতায় পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে।] অধ্যায়- ৩ অর্থনীতি, কৃষি, কৃষক, ক্ষেতমজুর, শিল্প, শ্রমিক প্রসঙ্গ দেশের বিরাজমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও প্রবণতা সম্পর্কে দলিলে বলা হয়েছে- “বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদী বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রান্তে অবস্থিত একটি দেশ। এর ফলে, পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের তেজি অবস্থার সময় তার কিছু সুবিধা নিতে পারলেও, তার মন্দাবস্থায় সংকটের সবটাই আমাদের দেশের ওপর চেপে বসে। পরিণতিতে আমাদের প্রান্তঃস্থিত অবস্থান ক্রমাগত আরও নাজুক হতে থাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় লুটপাটের ধারা শুরু হয় এবং সমাজে নব্য ধনিক শ্রেণি জন্ম নেয়। ১৯৭৫-এ এই লুটেরা ব্যবস্থা ও ধারা সাংবিধানিক-প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় এবং তার পর থেকে এখন পর্যন্ত একটানা লুটেরা পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক ধারাতেই দেশ পরিচালিত হয়ে আসছে। ‘লুটপাটের অর্থনীতির’ সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ‘লুটপাটের রাজনীতি’ জন্ম নেয়ার স্বাভাবিক পরিণতিতে জনগণের ভোটাধিকারসহ গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাকেও সমূলে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। অর্থনীতি ও সমাজের যেটুকু অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়, তা লুটেরা শাসকদের কোনো কৃতিত্বের নিদর্শন নয়। বরং তা মূলত কৃষকসমাজ, শ্রমিকসমাজ, বিশেষ করে পোশাকশিল্পের নারীশ্রমিক, প্রবাসীশ্রমিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ইত্যাদি উৎপাদনশীল শ্রেণিসমূহের পরিশ্রম ও বেঁচে থাকার সৃজনশীল সংগ্রামেরই ফসল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বর্তমানে দেশ বস্তুত এক ধরনের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটজালে আবদ্ধ হয়ে আছে।” খসড়া দলিলে অতঃপর বলা হয়েছে যে- “৯০ দশকে আমাদের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ এবং সর্বশেষ ৭ শতাংশের কাছাকাছি উপনীত হয়েছিল। সম্প্রতি করোনাকালে (২০১৯-২০) তা ৩.৫ শতাংশে নেমে আসে। এ সময় দরিদ্র লোকের মাথাগুনতি হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।... কিন্তু অর্থনীতির প্রকৃত চেহারা শুধু প্রবৃদ্ধির হার দিয়ে বা চরম দারিদ্র্যের মাত্রা দিয়ে মূল্যায়ন করা যায় না। ... প্রধানত বিদেশে কর্মরত শ্রমজীবীদের পাঠানো অর্থের কল্যাণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রবৃদ্ধির হার এতটা হওয়া সম্ভব হয়েছিল।... “বর্তমান সরকার দাবি করেন যে, আমাদের দেশে দারিদ্র্য-হার হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, দেশের দারিদ্র্য হারের পরিমাপ নির্ভর করে দারিদ্র্যের সংজ্ঞায়নের ওপরে। তাছাড়া দারিদ্র্যের বিষয়টি শুধু একটি অর্থনৈতিক বিষয়ই নয়, তার রয়েছে ইতিহাসের প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত একটি সামাজিক মাত্রিকতাও। ... পরিসংখ্যান ও সূচক সবই হচ্ছে সামষ্টিক গড় সূচক। এর প্রত্যেকটির নিচে লুকিয়ে রয়েছে ধনী-গরিবের বৈষম্যের এক নির্দয় বাস্তবতা। আমরা সবাই জানি, গড় হিসাব প্রকৃত বণ্টন বৈষম্যের হিসাবটি লুকিয়ে রাখে। তাই এসব পরিসংখ্যানের দ্বারা পরিস্থিতির প্রকৃত ও পূর্ণ চিত্র প্রতিফলিত হয় না। অগ্রগতি সম্পর্কে প্রচারিত এসব গালগল্প ম্লান হয়ে যায় যখন সমাজে ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য ও ধন-বৈষম্য, বেকারত্ব-কর্মহীনতা, কমিশন প্রাপ্তির লোভে প্রকল্প নির্ভরতা, নানা ধরনের লুণ্ঠন-দুর্নীতি, গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাব, সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের উত্থান, নৈতিকতার অবক্ষয়, সামাজিক সুরক্ষার ঘাটতি, শিক্ষার গুণগত মানের ঘাটতি, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, চিকিৎসাক্ষেত্রে গরিবের অসহায়ত্ব, কৃষকের ফসলের লাভজনক দামের অভাব, শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরির ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বনিম্নতম অবস্থান, উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পরিবর্তে বিদেশে বিপুল অর্থের পাচার ইত্যাদি নেতিবাচক বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে বুঝতে মোটেও কষ্ট হয় না যে, বর্তমান তথাকথিত ‘উন্নয়ন ধারা’র আসল অবস্থাটি কতটা ফাঁপা।” খসরা দলিলে লুটপাটের চিত্র বর্ণনা করে বলা হয়েছে- “বাংলাদেশের ব্যাকিং খাতে শুধু পুকুর চুরি হয়নি, ‘সাগর’ চুরিও হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বিপুল অর্থ। ... ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। সমাজে শোষণ-বৈষম্য বাড়ছে। ... গত ৫/৬ বছরে লুটপাটের এই ধারা শুধু অব্যাহত রয়েছে তা-ই নয়, বিদেশে টাকা পাচার আরও উলঙ্গভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যাসিনো বাণিজ্য, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক খাতে লুটপাট, ই-কমার্সসহ ভুয়া প্রতিষ্ঠান করে লুটপাটের কুৎসিত ঘটনাবলির কিছু কিছু প্রকাশিত হয়ে দেশবাসীকে স্তম্ভিত করেছে। ‘বালিশ-কাণ্ড’, ‘পর্দা-কাণ্ড’ ইত্যাদি বলে পরিচিত দুর্নীতির ঘটনার উন্মোচিত হওয়ার মাধ্যমে সরকারি অফিসের লুটপাটের চিত্র মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে চলছে মেগা লুটপাট। অন্যদিকে এসবের পেছনে যে বিপুল খরচ ও ঋণ তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বোঝার ভার বৃদ্ধি করে চলেছে। ... করোনাকালে যখন ২/৩ কোটি মানুষ নতুন করে বেকার হয়েছে এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গিয়েছে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবমতে, দেশের মোট ৯৪ হাজার কোটিপতির মধ্যে নতুন করে ১১, ৬০০ কোটিপতি যুক্ত হয়েছে। এসবের অনুকরণজাত প্রভাবে ঘুষ-উৎকোচ-স্পিডমানি ইত্যাদি আজ এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।” রাজনৈতিক প্রস্তাবের এই খসড়ায় বলা হয়েছে- “বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল-মডেল বলে দাবি করা হলেও, সাধারণ মানুষের জীবনে তার ছোঁয়া এসে পড়ছে না। তারা এখনও নানাবিধ দৈনন্দিন জীবন-যন্ত্রণা ও গভীর সমস্যা-সংকটে জর্জরিত হয়ে আছে। ... সরকারি পদ ও রাষ্ট্রীয় পদ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে। বর্তমানে কর্মক্ষম বয়সী মানুষের আধিক্যের যে সুবিধা দেশে রয়েছে, তাকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়া তো হয়ইনি, বরং দেশে বেকারত্ব ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ... মানুষ ‘টুকটাকের অর্থনীতি’ বা অনানুষ্ঠানিক খাতে যোগ দিয়ে সেখানে ‘অধিক কাজ, কম ভোগে’র মাধ্যমে কায়-ক্লেশে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। দেশের কৃষি ও গ্রামীন অর্থনীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- “কৃষি আজ চিরাচরিত কায়দায় চলছে না। ... বর্গাপ্রথার প্রায় অবসান হয়ে সন-জমা প্রথার প্রচলন ঘটেছে। কৃষি এখন অনেকটাই পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির সঙ্গে মিশে গিয়ে বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে দরিদ্র ও মাঝারি কৃষকরাও অকৃষকদের জমি ভাড়া নিয়ে কৃষি কাজে আত্মনিয়োগ করছেন। ... শহরের এক শ্রেণির কিছু ধনী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কৃষি জমি কিনে গ্রামে বিনিয়োগ করছে। ... গ্রামে ফসলের বহুমুখীকরণ হচ্ছে। মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গবাদি পশু, ফলমূল, সবজির মতো খাতগুলো দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। ... লোকসানের ভয় থাকা সত্ত্বেও এসব খাতে নিয়োজিত হয়ে কৃষক ও ক্ষেতমজুরেরা টিকে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাজারের অনিশ্চয়তা ও তার কাছে অসহায়ত্বের কারণে অধিকাংশ কৃষক তার লাভ-লোকসানের হিসাব মিলাতে না পেরে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। এসব কারণে গ্রামাঞ্চলে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়ে নতুন মাত্রার শ্রেণিবিন্যাস ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কৃষির উদ্বৃত্ত শ্রম শিল্পে নিয়োজিত হতে না পারায় মূর্ত ও প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব বাড়ছে। “কৃষিখাতে সরকারের বরাদ্দ গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত আপেক্ষিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে হাইব্রিড বীজের বাজারে অনুপ্রবেশ, আমাদের ঐতিহ্যবাহী বীজ ও বিভিন্ন ধরনের ফসলের শুধু বিলুপ্তিই ঘটাচ্ছে না, কৃষি ও কৃষককে বহুজাতিক কোম্পানির অবাধ শোষণের কাছে জিম্মি করে ফেলছে। ... সরকার ব্যক্তিখাতে প্রণোদনার কথা বললেও, দেশের সর্ববৃহৎ ব্যক্তি খাত কৃষি থাকছে উপেক্ষিত। ...এই সময়কালে কৃষক ধানসহ উৎপাদিত ফসলের লাভজনক দাম পায়নি। এমনকি বেশিরভাগ সময়ে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামেও তা বিক্রি করতে কৃষক বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীরা ফসলের চূড়ান্ত দামের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ততোধিক অংশ নিজেদের পকেটে নিয়ে গেছে।” “বর্তমানে গ্রামের পরিবারগুলোকে কৃষির পাশাপাশি অকৃষির দিকেও ঝুঁকতে হচ্ছে। গ্রামে ভূমিহীনদের অনুপাত বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৭৫ শতাংশে উপনীত হয়েছে। ... ভরা মৌসুমের কোনো কোনো সময় কৃষি-মজুরি বৃদ্ধি পেলেও, সারা বছর ক্ষেতমজুরের কাজের নিশ্চয়তা নেই এবং সেসময় নামমাত্র মজুরিতে তাদের কাজ করতে হয়। ... অনেক সময়ই সমগ্র পরিবার বা একটি মজুরবাহিনী চুক্তি ভিত্তিতে কৃষিকাজে নিয়োজিত হচ্ছে। ... স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বে কৃষিজমি ও জলাভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত না করায়, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ শিল্পায়নের নামে কৃষিজমি ধ্বংস করা হচ্ছে। ... অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে গিয়ে কষ্টকর জীবনযাপন করে, শহরাঞ্চলে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কাজে অংশ নিয়ে উপার্জিত অর্থের একাংশ গ্রামে পাঠাচ্ছে। তাতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছুটা সচলতা দেখা যাচ্ছে। ... তবে কৃষি, কৃষক ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া চলছে তা ধ্বংস ডেকে আনবে। বাজারের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হবে মুনাফালোভী মুষ্টিমেয় লুটেরা ব্যবসায়ীদের। তাই এ কথা বেশ পরিষ্কার যে, সেরূপ বিপর্যয় ও ধ্বংস রোধ করতে হলে আমূল ভূমি সংস্কার, কৃষিবাজারের সংস্কার এবং সমগ্র গ্রামীণ অর্থনীতির বা গ্রামজীবনের পরিকল্পিত বিপ্লবী পুনর্গঠন আজ অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে উঠেছে। ... দেশের শিল্প খাত ও শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে অনেক কথার মধ্যে বলা হয়েছে- “বর্তমানে আমাদের অর্থনীতির আরেকটি অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে শিল্পখাত এবং তাতে নিয়োজিত শ্রমজীবী মানুষেরা। আর সেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে পোশাকশিল্প খাত। শুধু উন্নত ইউরোপ-আমেরিকায় নয়, মধ্য-উন্নত দেশেও (ভারত, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ইত্যাদি) আমাদের পোশাক রপ্তানি হচ্ছে। এক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যাওয়ার যে বিশাল সম্ভাবনা আছে, তা কাজে লাগানো যাবে কি না সেটি অনেকটা নির্ভর করছে এই খাতে বর্তমানে যে ৪০ লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মরত তাদের (এবং সব শ্রমজীবীর) ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তি, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ভোগ, উন্নত প্রশিক্ষণ, জীবনমানের উন্নতি, শ্রমিক-কল্যাণের সুবিধা প্রাপ্তি ইত্যাদি ... এবং সেইসঙ্গে এসবের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা ও শ্রমদক্ষতা বৃদ্ধি, কর্মসহায়ক পরিবেশ, নতুন নতুন প্রযুক্তিতে আরও বিনিয়োগ, উন্নত ব্র্যান্ডের প্রবর্তন, সেইসঙ্গে বিনিয়োগকারীকে বন্দর, বিদ্যুৎ, জমি, গ্যাস, পানি ইত্যাদির নিশ্চয়তা প্রদান এসবের ওপর। ... একইসঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতন্ত্র ও সুশাসন কায়েম, মালিকদের মাঝে অতি ভোগ প্রবণতা ও বিদেশে অর্থপাচার প্রবণতা রোধ, বিদেশি মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ-সক্ষমতা অর্জন এবং সরকারের পক্ষ থেকে বাজার অনুসন্ধান, ব্যাপকভাবে উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদির ব্যবস্থা করাও জরুরি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমন্বিত পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। বরং যে বিপুল আয় এই শিল্পে হচ্ছে, তার বেশিরভাগ অংশই মালিকেরা ভোগে নিঃশেষ করছে এবং বিদেশে পাচার করছে। ...এদিকে, এ সময়কালে গড়ে প্রতি বছর শ্রমিকের মাথাপিছু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলেও সেই অনুপাতে তাদের মজুরি বাড়েনি। দেখা যায় যে, এ সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে শ্রমিকরা নিজেদের খাটুনি দিয়ে বাড়তি চার টাকা যোগ করে থাকলে, তা থেকে নিজেরা পেয়েছিল মাত্র বাড়তি এক টাকা আর মালিকরা নিয়ে নিয়েছে তিন টাকা। বাংলাদেশের শিল্পখাতে শ্রমিকদের ওপর আপেক্ষিক শোষণের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। পোশাকশিল্প খাতের শ্রমিকদের যে অবস্থা, তা সমগ্র শিল্প খাতেরই সাধারণ চিত্র। ... সংগঠিত খাতের পাশাপাশি অসংগঠিত খাত ও সেবা খাতে যে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কাজ করছে, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। দেশে আজও কোনো ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ নির্ধারণ করা হয়নি। এ দেশের শ্রমিকরা শুধু ন্যায্য মজুরি থেকেই বঞ্চিত থাকছে না, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারও তাদের নেই। শ্রম আইনে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে এবং আইনে যতটুকু অধিকার আছে তা-ও সরকারিভাবে এবং বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থা দ্বারা বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। উপযুক্ত কর্মপরিবেশ, কর্মস্থলের নিরাপত্তা ইত্যাদি ন্যূনতম বিষয়ের নিশ্চয়তাও তাদের ক্ষেত্রে নেই। প্রবাসী শ্রমিকরা বিপুল রেমিট্যান্স পাঠালেও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেই। অনেক ক্ষেত্রে তারা নির্মম শোষণ-বঞ্চনা-প্রতারণার শিকার হচ্ছে এবং এমনকি অনেককে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হচ্ছে। এ দেশের শ্রমিক শ্রেণি আজ নিদারুণ শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়ে আছে। ...”