আপসহীন সাহসের প্রেরণা কমরেড বিমল মুখার্জী
মিজানুর রহমান সেলিম
শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের সাহসী সৈনিক কমরেড বিমল মুখার্জী মাত্র ৬৭ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। তিনি বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত হবার পরে গত ৩১ জুলাই ২০২৫ তারিখ থেকে প্রথম ঢাকা বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসার পরে ঢাকা পিজি হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পরিণত বয়স পেয়ে এই জগতের মায়া ত্যাগ করেননি। আমরা তাঁকে অকালে হারিয়েছি। কমরেড বিমল মুখার্জীর মৃত্যুতে আমরা একজন সৎ-সাহসী ও কমিউনিস্ট নেতাকে হারিয়ে গভীরভাবে মর্মাহত।
কমরেড বিমল মুখার্জী ১৯৫৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর তাঁর নিজ গ্রাম ঝালকাঠী জেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের তারপাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা বঙ্কিম বিহারী মুখার্জী পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের মালিখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত না থাকলেও তাঁর বরিশালের ঝাউতলার বাড়িটি কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলন সংগ্রামের দূর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। কমরেড নলিনী দাস, কমরেড মুকুল সেন, কমরেড নুরুল ইসলাম মুন্সি এবং কমরেড জগদীশ আইচ সরকার-এর মতো কমিউনিস্ট নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও শলাপরামর্শের কেন্দ্র হিসেবে এই বাড়িটি ব্যবহৃত হতো। এমন একটি বাড়িতেই কমরেড বিমল মুখার্জীর বেড়ে ওঠা। এ বাড়ির সকল ছেলেমেয়েরাই এসব বিপ্লবীদের প্রেরণায় ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল চেতনায় বেড়ে উঠেছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তাঁর পিতা বঙ্কিম বিহারী মুখার্জী জ্ঞানচর্চায় উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রগতিশীল চিন্তাকে ধারণ করতেন। বিমল মুখার্জীর বড় ভাই অধ্যাপক অমল মুখার্জী বিজ্ঞান বিষয়ের একজন ভালো শিক্ষক ও ভালো মানুষ হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যের তত্ত্বাবধানে ঝালকাঠী কীর্ত্তিপাশা হাইস্কুল মাঠে ও হাসপাতাল মাঠে স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের কাঠের বন্দুক ও বাঁশের লাঠি দিয়ে যুদ্ধের কলাকৌশল শেখানোর ট্রেনিং দেয়া হতো। এসব ট্রেনিং-এ কমরেড বিমল মুখার্জী অংশগ্রহণ করেছেন। তবে পরবর্তীতে তাঁর বাবার কর্মস্থল নাজিরপুরের মালিখালীতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে বরিশাল বি.এম স্কুলে পড়ালেখার সময়ই তিনি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ চলাকালে কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা কমরেড নলিনী দাসের সংস্পর্শে এসে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের সেবা শুশ্রুষার কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এ কথার প্রকৃত মর্মার্থ কমিউনিস্ট নেতা নলিনী দাসের জীবনাচরণ দেখে বিমল মুখার্জী উপলব্ধি করতে পারেন এবং সে সময়ই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পরে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার সময়ে পার্টির নেতৃত্ব আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় কমরেড বিমল মুখার্জী তাঁর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার্টির নিষিদ্ধ কাগজপত্র ও জরুরি কাজের খবরাখবর আনা নেয়ার দায়িত্ব পালন করতেন। তখন তিনি পার্টির সদস্যপদ লাভ না করলেও তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে নেতাদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। নিষিদ্ধঘোষিত পার্টিতে নানাভাবে থাকার কারণে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরণ করে। পরে কয়েকমাস জেল খেটে জামিনে মুক্তি পান। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পঁচাত্তর পরবর্তী বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই, জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের সময় বিমল মুখার্জী একইভাবে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
১৯৭৬ সালে সরকারী বি.এম কলেজে পড়াশোনার সময় থেকেই বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক কাজকর্ম ও আন্দোলন সংগ্রামের কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। তখন থেকেই বরিশাল শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শহর ছাত্র ইউনিয়নের কাজে জেলা ছাত্র নেতৃত্বের সাথে যুক্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ন হন। এসময় শুধু ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক ও আন্দোলন সংগ্রাম নয়, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের সংস্পর্শে এসে পার্টির কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে যুক্ত থেকে বিমল মুখার্জী পার্টি নেতৃত্বের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হন। বিশেষ করে তাঁর জীবনের শৃঙ্খলাবোধ ও সততা সকলকে মুগ্ধ করে। এ সময়েই ১৯৭৭ সালে কমরেড বিমল মুখার্জী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রস্তাবনা ঠিক করার জন্য পার্টির ছাত্র শাখার সভাগুলো কমরেড বিমল মুখার্জীর বাসায় অনুষ্ঠিত হতো। এসব বৈঠকের সকল ধরনের গোপনীয়তা বিমল মুখার্জী রক্ষা করতেন। এভাবে তাঁর জীবনাচরণে সকল ক্ষেত্রে প্রশ্নহীন সততার কারণে তাঁকে ছাত্র ইউনিয়ন ও পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টির অর্থের হিসাব-নিকাশ সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এজন্যই ১৯৮১ সালে এবং ১৯৮৪ সালে ছাত্র ইউনিয়নের বরিশাল জেলা সম্মেলনের পরে দু’টি কমিটিতেই তাকে কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তিনি সবসময় পার্টির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আপসহীন থাকতেন। বিমল মুখার্জী সারা জীবনই ছাত্র ইউনিয়ন ও পার্টির আন্দোলন সংগ্রামের অগ্রভাগে থেকেছেন। একাধিকবার আটকও হয়েছেন। উল্লেখ্য যে, তার পরিবারের সকল সদস্যের অসাম্প্রদায়িক উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও বামপন্থার প্রতি সমর্থন থাকার জন্যে বিমল মুখার্জীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারা কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াননি, বরং সকলের নৈতিক সমর্থন পেয়েই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে পেরেছেন।
কমরেড বিমল মুখার্জী শুধু ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই যুক্ত ছিলেন না। তিনি বহুবিধ স্থানীয় সমস্যা সমাধানের ও সামাজিক আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঝাউতলা পুকুর রক্ষা আন্দোলন, কাঞ্চন পার্ক নির্মাণ আন্দোলন, জেল খাল খনন আন্দোলনসহ রাস্তাঘাট, সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষার নানামুখী আন্দোলনেরও একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে কমরেড বিমল মুখার্জীর একটি অসাধারণ কাজ আমাদের অনেকেরই অজানা ছিল। তিনি বছরের পর বছর প্রতিদিন ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে পাড়ায়, মহল্লায় ঘুরে ঘুরে ফুল তুলে ফুলগুলো পুজোর অর্ঘ্য হিসেবে ১৫/২০টি ঘরে পৌঁছে দিতেন। সনাতন ধর্মের নারীদের মধ্যে অন্ধকারে ভোরে ফুল তুলে আনার রেওয়াজ আছে। তাদের কষ্ট ও সম্ভ্রমের কথা চিন্তা করে বিমল মুখার্জী এ কাজের দায়িত্বটি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। একজন কমিউনিস্ট নেতার এ ধরনের কাজ নজিরবিহীন, যা তিনি মানবিক দায়বোধ থেকেই করেছেন।
কমরেড বিমল মুখার্জী দীর্ঘদিন যাবৎ কমিউনিস্ট পার্টির বরিশাল মহনগর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে জেলা কমিটির নেতৃত্বেও ছিলেন। এ বছরও তাঁর নেতৃত্বে মহানগর সম্মেলন অনুষ্ঠানের সকল আয়োজন সম্পন্ন হবার পরে সম্মেলনের দিনই তিনি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে চিকিৎসার জন্য প্রথম ঢাকা বক্ষব্যাধি হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কমরেড বিমল মুখার্জী স্ত্রী ও দু’টি কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। স্ত্রী রীনা মুখার্জী একজন গৃহিণী। জ্যেষ্ঠ কন্যা কথা মুখার্জী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য জাপানের স্কলারশিপ নিয়ে Toïo University of Marine Science & Technology-তে অধ্যয়নরত। বৃত্তি পেয়ে জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাওয়ায় বিমল মুখার্জী যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, জ্যেষ্ঠ কন্যা কথা মুখার্জী পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেছিল। কনিষ্ঠ কন্যা কলি মুখার্জীও অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। সে এখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমরা মানবমুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত প্রাণ একজন সাহসী সৈনিক কমরেড বিমল মুখার্জীকে অকালে হারিয়ে গভীরভাবে মর্মাহত। একজন কমিউনিস্ট হিসেবে মানুষের সার্বিক মুক্তির আন্দোলনে তাঁর সারাজীবনের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বর্ণাঢ্য লড়াকু জীবনের প্রতি আমরা বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং তাঁর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সম্পন্নের দায় গ্রহণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি। কমরেড বিমল মুখার্জীর স্মৃতির প্রতি রক্তিম অভিবাদন।
লেখক : সভাপতি, বরিশাল জেলা, সিপিবি
Login to comment..








প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন