পরিচিতি সত্তার রাজনীতি : উত্তর আধুনিকতা বনাম মার্কসবাদ
ডা. মনোজ দাশ
১. ভূমিকা-
জাতি, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, আদিবাসী, দলিত, যৌনতা, ইত্যাদি সামাজিক অবস্থান বা সত্তাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দাবি ও আন্দোলনকে পরিচিতি সত্তার রাজনীতি বলে। আধুনিক বিশ্বে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছে এই পরিচিতি সত্তার রাজনীতি। বিশ শতকের শেষভাগে উত্তর আধুনিকতা এই পরিচিতি সত্তার রাজনীতির তাত্ত্বিক ভিত গড়ে তোলে। মার্কসবাদ এই পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে সম্পূর্ণ বাতিল করে, নাকি পরিচিতি সত্তার রাজনীতিতে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বের মধ্যেই ধারণ করে পুঁজিবাদকে পরাজিত করার এক বৃহত্তর গণতান্ত্রিক জোটের সন্ধান করবে, তার তাত্ত্বিক ভিত্তি অনুসন্ধান করার জন্য আমার এ ছোট লেখাটির অবতারণা।
২. পরিচিতি সত্তার রাজনীতি: উত্তর আধুনিক তত্ত্ব-
বিশ শতকের শেষভাগে সমাজতত্ত্ব, দর্শন ও রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তন ঘটে। উত্তর আধুনিকতা নামক এক নতুন বৌদ্ধিক ধারা মার্কসবাদের সর্বজনীনতা, যুক্তি, প্রগতি, বিপ্লব, শ্রেণি-চেতনা ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাগুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই প্রেক্ষাপটেই উদ্ভূত হয় পরিচিতি সত্তার রাজনীতির নামে এমন এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন যা শ্রেণিসংগ্রামকে উপেক্ষা করে জাতি, লিঙ্গ, যৌনতা, জাতিগত পরিচয়, ধর্ম ও ভাষাকে কেন্দ্র করে আত্ম-পরিচয়ের দাবিকে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
উত্তর আধুনিক ফুকো তাঁর ‘Discipline and Punish’ ও ‘The History of Sexuality’- গ্রন্থে দেখান, ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রীয় নয়; বরং সমাজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে ছড়িয়ে থাকা এক নেটওয়ার্ক, যা ব্যক্তি ও তার পরিচিতি সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। জ্যঁ-ফ্রাঁসোয়া লিওতার তাঁর ‘The Postmodern Condition’-এ দাবি করেন- শ্রেণিসংগ্রাম, প্রগতি, মুক্তি বা যুক্তির মতো সর্বজনীন ধারণাগুলি আর বিশ্বাসযোগ্য নয়; বরং ছোট ছোট বয়ান ও অভিজ্ঞতার বহুত্বই সত্য।
আমেরিকার কালো নারীবাদী সংগঠন কম্বাহী রিভার কালেক্টিভ (Combahee River Collective) ১৯৭৭ সালের এক ঘোষণায় বলে– ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর পরিচয়ই তার রাজনৈতিক অবস্থান ও সংগ্রামের ভিত্তি। এখানে শ্রেণি আর কোনো বিশ্লেষণধারা নয়; বরং gender, race, ethnicity, sexuality প্রভৃতি পরিচয়ই রাজনীতির নতুন কেন্দ্রবিন্দু। এই তত্ত্ব রাজনীতির দৃষ্টি শ্রেণি থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে পরিচিতি সত্তায়– যেখানে প্রতিটি গোষ্ঠী তাদের বিশেষ অবস্থান ও অভিজ্ঞতাকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে থাকে। এই পরিচিতি সত্তার রাজনীতি ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে নারীমুক্তি আন্দোলন, কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলন, সমকামী আন্দোলন ও আদিবাসী অধিকারের আন্দোলনের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়।
এই উত্তর আধুনিক পরিচিতি সত্তার রাজনীতি কিছুটা হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে দৃশ্যমান করেছে। কিনমশং তা শ্রেণি সম্পর্কের প্রশ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুঁজিবাদের বহুত্ববাদী মুখোশে পরিণত হয়।
উত্তর আধুনিকতা মনে করে, মার্কসবাদে মানুষের শ্রেণিসত্তাকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একচেটিয়া প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। উত্তর আধুনিকতার অভিযোগ, মার্কসবাদে মানুষের অন্য সত্তাকে খাটো করে দেখানো হয়েছে। মানুষের বহুমাত্রাকে স্বীকার না করে শুধুমাত্র শ্রেণিমাত্রায় তাকে চিহ্নিত করে মার্কসবাদীরা শুধু ভুল করেছেন তা-ই নয়, আসলে শ্রেণিমাত্রাকে অবলম্বন করে মার্কসবাদীরা মানুষের অন্যমাত্রাকে দমন করতে চেয়েছেন। এভাবে এই দমনের রাজনীতিকে সংগঠিত করে তারা মানুষের একটি বিশেষ মাত্রার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। উত্তর আধুনিকতা দাবি করে, মার্কসবাদী শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতির সীমাবদ্ধতা হচ্ছে- তা বুঝতে চায় না প্রতিটি মানুষের নানা সত্তা থাকে। যে মানুষ শ্রমিক, সে আবার পুরুষ কিংবা বাঙালি কিংবা মুসলমান। উত্তর আধুনিকতা মনে করে, মার্কসবাদে শ্রেণিস্বার্থ ও শ্রেণিসংগ্রামের নিরিখে সব সামাজিক বিষয়কে বিচার করার ফলে নিপীড়িত মানুষের অন্য ধরনের সংগ্রামকে উপেক্ষা করা হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণির নেতৃভূমিকার ওপরে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার ফলে অন্যান্য শ্রেণির ভূমিকা যথার্থভাবে মূল্যায়িত হয়নি।
উত্তর আধুনিকতার মতে, কোনো কিছুই অন্যকিছু দিয়ে নির্ধারিত হয় না। কোনো কিছুই অন্যকিছুর অস্তিত্বের জন্য অত্যাবশ্যক নয়। মানুষের বহু সত্তার মধ্যে কোনোটিই এককভাবে প্রধান নয় এবং এসবের মধ্যে কোনো আন্তঃসম্পর্ক নেই। যেহেতু এসবের মধ্যে কোনো আন্তঃসম্পর্ক নেই, সেজন্য সুবিধাবঞ্চিত নিপীড়িত অংশগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, দরকারও নেই। বঞ্চিতরাই যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে স্বতন্ত্রভাবে তার অবস্থা পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করবে। এভাবে উত্তর আধুনিকতা মানুষকে বিভিন্ন গোষ্ঠী-ধর্ম-অঞ্চল ইত্যাদিতে বিভক্ত করে তাদের মধ্যে সংঘাত ও প্রতিযোগিতার সম্পর্ক তৈরি করে দেয়। শ্রেণি সেখানে কোনো বিষয়ই নয়, বড়জোর পরিচিতির একটা অংশমাত্র। এভাবে উত্তর আধুনিকতার পরিচিতি সত্তার রাজনীতি শ্রেণি ঐক্য নষ্ট করার কাজে ব্যবহৃত হয় এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ শ্রেণি আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
৩. পরিচিতি সত্তা নিয়ে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী কৌশল-
উত্তর আধুনিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরা সরাসরি বা তাদের এনজিও প্রজেক্টের মাধ্যমে পরিচিতি সত্তাকে ব্যবহার করে মানুষের শ্রেণি সমাবেশ ঘটাতে বাধা প্রদান করে। এ ধরনের পরিচিতি সত্তার আন্দোলন পার্টি-রাজনীতি, মতাদর্শ ও রাজনৈতিক কর্মসূচির সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় না। তারা একটি নির্দিষ্ট ইস্যুতে তথাকথিত অ-রাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলনের পক্ষপাতী। ‘অ-রাজনৈতিক সংগঠনই সামাজিক পরিবর্তন আনতে পারে’- এমন একটা বোধের জন্ম দেয় তারা। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা অ-রাজনৈতিকতার গোলকধাঁধার জন্ম দেয়। পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রকৃত মুক্তির রাজনীতিতে পরিণত করতে হলে, এই গোলকধাঁধা থেকে বের হয়ে এসে তাকে ঐক্যবদ্ধ শ্রেণিসংগ্রামের ধারায় স্থাপন করতে হবে। এই কাজতো বুর্জোয়ারা করবে না, এই কাজের দায়িত্ব নিতে হবে বামপন্থিদের।
৪. চিরায়ত মার্কসবাদে শ্রেণিসংগ্রাম এবং পরিচিতি সত্তার রাজনীতি:
মানুষের শ্রেণি ও অন্য সত্তা সম্পর্কিত উত্তর আধুনিক বোধের সাথে মার্কসবাদের কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। মার্কসবাদ একটা সমাজকে দেখে বহু মাত্রিকতার মধ্যে। এই বহুত্বের মধ্যে অনেক ধরনের প্রশ্ন থাকে, বিভিন্ন সত্তা ও দ্বন্দ্ব থাকে। সমাজে যেমন থাকে মানুষের শ্রেণি, জাতি, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ সত্তা ও দ্বন্দ্ব। এসব সত্তা ও দ্বন্দ্বের মধ্যে শ্রেণিপ্রশ্নই সবচেয়ে মৌলিক। এই শ্রেণিপ্রশ্নই, এই দ্বন্দ্বই সমাজটির প্রধান বৈশিষ্ট্য। অন্য বিষয়গুলোও শ্রেণিপ্রশ্নের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। শ্রেণিদ্বন্দ্ব যে পরিমাণে নিরসন হয়, অন্য দ্বন্দ্বগুলোর সেই পরিমাণে নিষ্পত্তি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এজন্য শ্রেণিদ্বন্দ্ব এখানে মৌলিক ও প্রধান দ্বন্দ্ব। অন্য দ্বন্দ্বগুলো শ্রেণিদ্বন্দ্বের ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীল নয়, তাদের স্বাধীন কিছু বিকাশের ধারা আছে, এসব দ্বন্দ্বও শ্রেণিদ্বন্দ্বকে প্রভাবিত করে। মার্কসবাদ মানুষের শ্রেণিসত্তাকেই একমাত্র সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেনি, মানুষের অন্যান্য সত্তার নিজস্ব গতিশীলতাকে মার্কসবাদ গুরুত্ব দেয়। কিন্তু শেষ বিচারে সমাজের অন্যান্য বিরোধের পরিণতি এবং সমাজের সামগ্রিক বিকাশ নির্ভর করে শ্রেণিদ্বন্দ্ব নিরসনের ওপর। এজন্য ঐতিহাসিক কারণেই সমাজ প্রগতির প্রশ্নে শ্রেণিসত্তাকেই মার্কসবাদ মানুষের প্রধান সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে। আবার যেহেতু শ্রেণিসত্তার সাথে অন্যসব সত্তার আন্তঃসম্পর্ক আছে, সেজন্য শ্রমিকশ্রেণির সাথে সুবিধাবঞ্চিত নিপীড়িত অংশগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগও আছে। বঞ্চিতরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অবস্থা পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করতে পারে।
উত্তর আধুনিকতার পরিচিতি সত্তার রাজনীতি মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে গুরুত্ব দেয়, কিন্তু মানুষের ওপর বস্তুগত শোষণের প্রশ্নকে অবহেলা করে। এভাবে সাংস্কৃতিক পরিচয়কে গুরুত্ব দিয়ে উত্তর আধুনিক তত্ত্বনির্ভর পরিচিতির রাজনীতি শ্রেণি সম্পর্কের ঐক্যকে ভেঙে ফেলে। এলেন মেইক্সিনস উড তাঁর The Retreat from Class: A Nwe True Socialism-এ সমালোচনা করে বলেন– উত্তর আধুনিক ‘পরিচিতির রাজনীতি সমাজকে খণ্ডিত করে; এটি শ্রমজীবী শ্রেণির ঐক্যকে দুর্বল করে দেয়।’
মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের রচনাগুলোতে বারবার বলেছেন, ইতিহাসের চালিকাশক্তি হলো শ্রেণিসংগ্রাম। আর মানুষের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, জাতিগত বা লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনগুলোর গভীরে রয়েছে উৎপাদন সম্পর্কের ভেতরকার শ্রেণি-বৈপরীত্য।
এই দৃষ্টিতে, চিরায়ত মার্কসবাদ পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে সমাজের মূল সংগ্রাম হিসেবে নয়, বরং ভিত্তিকাঠামো দ্বারা নির্ধারিত উপরিকাঠামোগত (superstructural) ফল হিসেবে দেখে। চিরায়ত মার্কসবাদীরা পরিচিতি ভিত্তিক রাজনীতিকে কখনোই আলাদা কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হিসেবে দেখেননি; বরং তাঁরা বিশ্বাস করতেন, শ্রেণিসংগ্রাম জয়ী হলে সমস্ত পরিচিতি-ভিত্তিক নিপীড়ন স্বাভাবিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আবার চিরায়ত মার্কসবাদীরা ‘পরিচিতি’ প্রশ্নকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেননি। জনগণকে সংকীর্ণ ভাগাভাগিতে বিভক্ত করে দেয়, এমন জনগোষ্ঠীগত পরিচিতি সত্তার তারা বিরোধিতা করেছেন। আবার এসব জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পক্ষে থেকেছেন, তাদের ওপর প্রকৃত নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে শক্তিশালী করেছেন।
চিরায়ত মার্কসবাদ মনে করে, এসব নিপীড়ন ও বৈষম্যের উৎস অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে নিহিত, ভিন্ন ভিন্ন সমস্যাগুলোর মূল অন্তর্নিহিত কাঠামো একটাই, তা হচ্ছে ‘শোষণের রাজনৈতিক অর্থনীতি।’ যেমন: নারী নিপীড়ন- পরিবারের ও শ্রমবিভাগের অর্থনৈতিক ভিত্তির সঙ্গে যুক্ত। জাতিগত নিপীড়ন- উপনিবেশ ও পুঁজিবাদী মুনাফার সম্প্রসারণের ফল।
অতএব, চিরায়ত মার্কসবাদ পরিচিতির বাস্তবতাকে অস্বীকার না করে তা শ্রেণি কাঠামোর অন্তর্গত রূপে বিশ্লেষণ করে। লেনিনও এক অর্থে পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে শ্রেণিসংগ্রামের কাঠামোয় যুক্ত করেছিলেন। তিনি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে শ্রমিকশ্রেণির বিশ্ব বিপ্লবের অংশ হিসেবে দেখেছিলেন। অর্থাৎ, জাতিগত পরিচিতি ও জাতীয়তা প্রশ্নকে তিনি শ্রেণি রাজনীতির কৌশলগত অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
৫. সমকালীন সৃজনশীল মার্কসবাদী দৃষ্টিতে পরিচিতি রাজনীতি:
১৯৭০-৯০ দশক থেকে অনেক মার্কসবাদী চিন্তাবিদ পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে শ্রেণিসংগ্রামের সম্প্রসারিত ক্ষেত্র হিসেবে দেখতে শুরু করেন। এরনেস্ট লাকলাউ ও শ্যান্তাল মুফ (যারা উত্তর আধুনিকতা ও মার্কসবাদের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে গ্রন্থিবন্ধনের কথা বলেন) তাদের Hegemoû and Socialist Strategy, ১৯৮৫ রচনায় বলেন- ‘শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একমাত্র নয়। ক্ষমতার বিভিন্ন ক্ষেত্র (লিঙ্গ, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি) পরস্পর জড়িয়ে আছে। তাই সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে গ্রহণ করতে হবে বৃহত্তর ও বহুমাত্রিক প্রতিরোধের এক গণতান্ত্রিক জোটের ধারণা।’
ন্যান্সি ফ্রেজার (মূলত উপরোক্ত একই ধারার প্রতিনিধি) পরিচিতি সত্তার রাজনীতি ও শ্রেণির রাজনীতির মধ্যে ভারসাম্যের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ন্যায্য গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে শ্রেণি ও পরিচিতি–উভয় দিককে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। এতে দীর্ঘমেয়াদে শ্রেণি প্রশ্ন দুর্বল হয়ে পড়ে না। বরং শেষ বিচারে শ্রেণি রাজনীতির বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
৬. উপসংহার :
মার্কসবাদ একমাত্র শ্রেণিকেই বাস্তব বলে মনে করে না; বরং অন্যসব নিপীড়নের রূপকে শ্রেণি কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্তভাবে বিশ্লেষণ করে। মার্কসবাদ পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে সম্পূর্ণ বাতিল করে না; বরং তাকে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে, পুনঃসংজ্ঞায়িত করে। এটা করতে যেয়ে, পার্টিকে কেবলমাত্র পরিচিতি সত্তার রাজনীতির একটি দল হয়ে উঠলে চলবে না। ‘পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে’ মার্কসবাদ কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক-স্বীকৃতি পর্যন্ত সীমিত রাখবে না। আজকের বিশ্বের মুক্তির রাজনীতি কেবল সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে সম্ভব নয়, বরং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে শ্রেণিকাঠামোর মধ্যে ধারণ করেই মুক্তির রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে।
মার্কসবাদ পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে শ্রেণি রাজনীতির এক ঐতিহাসিক সম্প্রসারণ হিসেবে বিবেচনা করে, এটিকে অর্থনৈতিক ও শ্রেণিভিত্তিক দমন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে পরিণত করার মাধ্যমে নিজের তত্ত্বের ভেতরেই ধারণ করে নেবে।
এই প্রক্রিয়াকে অগ্রসর করতে মার্কসবাদীদের দুইভাবে কাজ করতে হবে।
প্রথমত, স্বাধীন অবস্থান থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে শ্রেণিসংগ্রামের সম্প্রসারিত রূপ হিসেবে গণ্য করে তার পক্ষে থাকতে হবে, তাদের ওপর প্রকৃত নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাদকে মোকাবিলা করে ক্ষমতা দখল করার মাধ্যমে ন্যায্য গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য শ্রমিকশ্রেণির সাথে সমাজের সব নিপীড়িত-বঞ্চিত-দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও শক্তিকে নিয়ে ‘বৃহত্তর গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্লক’ গড়ে তুলতে হবে।
শুধুমাত্র এভাবেই উত্তর আধুনিক পরিচিতি সত্তার সংকীর্ণ ভাগাভাগির রাজনীতির বিকল্প হিসেবে ঐক্যবদ্ধভাবে শ্রেণির রাজনীতিকে যৌক্তিক সম্প্রসারিত পরিসরে বিজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিবি
Login to comment..








প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন