আমাদের শিশির স্যার...

মুর্শেদুল হাকিম শুভ্র

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

১৯৮৪-৮৫ সালে বরিশাল শেরে-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে ঢুকেই শিশির স্যারকে পেয়ে যাই। তখন আমরা ছাত্র ইউনিয়নে সক্রিয় কর্মী। দেশে স্বৈরাচারী সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতায় জুড়ে বসেছে। সারা দেশে চলছে গণতন্ত্রের সংগ্রাম। অনেক রক্ত ঝরে গেছে ছাত্রদের শরীর থেকে। সাম্রাজ্যবাদ-সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চলছে। ‘শিশির স্যার আমাদের লোক’ এই কথাটা তখন ক্যাম্পাসে আমাদের শক্তি ও সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই স্যারের সাথে দেখা হচ্ছে। কথা হচ্ছে। স্যার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে শক্তিশালী সাহসী সংগঠন হয়ে উঠছে ছাত্র ইউনিয়ন। শিশির স্যার ছিলেন অত্যন্ত নম্র ভদ্র বিনয়ী একজন অধ্যাপক। কিন্তু দৃঢ়, সাহসী, নীতিতে অটল, পার্টি সংগঠনে নিবেদিত কমরেড। এমন মানুষের সংস্পর্শে আসা কাছে থেকে দেখা সত্যি গর্বের বিষয়। উনাকে নিয়ে কিছু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে, যা আমরা শুনেছি। উনি দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলার সিভিল সার্জন ছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন রীতিমত ‘জেহাদী’ স্বভাবের একজন। এমনকি অস্ত্রের মুখেও উনাকে দিয়ে আপস করানো যায়নি। আমাদের ক্যাম্পাসে চিকিৎসকদের মধ্যে তিনি ছিলেন- লিডার অফ দ্যা লিডার্স। চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রনেতা শাহাদাত কে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। রাজশাহীতে মেডিকেল কলেজে হত্যা করা হলো ছাত্র মৈত্রীর জামিল আখতার রতনকে। শিবির তখন ক্যাম্পাসে হত্যা এবং রগ কাঁটার সহিংস রাজনীতি চালাচ্ছে। আমাদের ক্যাম্পাসেও প্রতিবাদ চলমান ছিল। শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তখন জোরালো হয়ে উঠছে। কলেজে সংঘষময় পরিস্থিতিতে আমিসহ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে দুই বছরের জন্য বহিস্কার করা হলো। তখন এই বহিষ্কারের বিরুদ্ধে আমাদের পাশে ছিলেন শিশির স্যার। সে এক অভিজ্ঞতা বটে! স্যার আমাকে বললেন- কোন চিন্তা করো না। এতজন ছাত্রনেতাকে বহিষ্কার করে আমরা টিকে থাকতে পারব? একাডেমিক কাউন্সিলে শিশির স্যার এবং অন্য শিক্ষকদের প্রতিবাদের মুখে দুই মাসের মধ্যে আমাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। সময়টা সম্ভবত ১৯৯০-৯১ সালের দিকে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্র এবং স্থানীয় নির্বাচন। আমি তখন সবেমাত্র পাস করে ইন্টার্ণশিপ শুরু করেছি। নির্বাচনে আমাদের ঐক্য প্যানেল বামপন্থি চিকিৎসক এবং আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের

সিপিবি কেন্দ্রীয় কার্যালয় মুক্তিভবনে কমরেড ডা. শিশির কুমার মজুমদারের প্রতি রেড স্যালুট জানাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ
সমন্বয়ে। স্থানীয়ভাবেও সেরকম প্যানেল ঘোষণা করা হলো। শিশির স্যার স্থানীয়ভাবে আমাদের সভাপতি পদপ্রার্থী। সম্পাদকীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচন করবেন আমাদের হারুন স্যার। তখন তিনি ফিজিওলজির শিক্ষক। ভীষণ সক্রিয়, নির্ভিক আপসহীন একজন মানুষ হারুন স্যার। আমাদের প্রচার শুরু হলো। ভয়েই কিংবা অন্য কারণে হোক, হঠাত করেই শেষ সময়ে নমিনেশন তুলে নেন সহ-সভাপতি পদপ্রার্থী একজন আওয়ামীপন্থি অধ্যাপক। তখন বিএনপিপন্থিরা দলে ভারী। শিশির স্যার দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। একেবারে শেষ সময়। স্যার সবাইকে অবাক করে সহ-সভাপতি হিসেবে আমার নাম দিয়ে দিলেন। তখন কথা উঠেছিল একজন জুনিয়র ডাক্তারকে সহ-সভাপতির মত পদে মনোনয়ন দিলে পুরো কমিটি দুর্বল হয়ে যেতে পারে! স্যার কোন দিকে তাকাননি। বিষয়টা উল্লেখ করছি এই কারণে যে- দলের হিস্যা, দলকে তুলে ধরা, দলের দাবির বিষয়ে আপসহীনতা, দলের কাউকে তুলে ধরা এসব-ই ছিল স্যারের নীতি-আদর্শ। শিশির স্যারকে নিয়ে অনেক কথা লেখা যায়। কিভাবে সাম্প্রদায়িক শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন লড়াই করেছিলেন। স্যারের কাছে থেকে শোনা একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আমাদের কলেজে বেশ অনেক হিন্দু শিক্ষক ছিলেন। কয়েকজন হাতে গোনা অধ্যাপক টিচার্স লাউঞ্জে গো-মাংস ভক্ষণ করতেন বেশ উল্লাসে আমোদে। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু শিক্ষকদের জন্য বিষয়টা বিব্রতকর ছিল। স্যারের হস্তক্ষেপে বিষয়টার মীমাংসা হয়েছিল সেসময়। সম্ভবত আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষে। শহরে নাট্য উৎসব চলছে। উদীচী পরিবেশন করবে রবীন্দ্রনাথের ‘রথের রশি’। একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছি। হঠাত দেখি আমার পাশে শিশির স্যার। নাটক শেষে স্যার জিজ্ঞেস করলেন ‘কি বুঝলা’?। আমি বললাম, ভালো লাগলো। স্যার বললেন ‘নিম্নবর্গের মানুষ হাল না ধরলে সমাজ চলে না। ‘শ্রেণিসংগ্রাম- বুঝলা?, শ্রেণিসংগ্রাম।’ আমাদের অধ্যাপক শিশির মজুমদার স্যার ছিলেন আমৃত্যু বিপ্লবী। এমন সহজ, সাধারণ সৎ নিষ্ঠাবান আপোষহীন সাহসী ব্যক্তিত্বের মৃত্যু নেই। তিনি অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবেন বর্তমান-আগামীর প্রতিমুহূর্তের মানবমুক্তির সংগ্রামে। রবীন্দ্রনাথের ‘পরিচয়’ দিয়েই শিশির স্যারের সঙ্গে পরিচয়। ‘সেতারেতে বাঁধিলাম তার, গাহিলাম আরবার- মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক। আর কিছু নয় , এই হোক শেষ পরিচয়’।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..